জাদুমন্ত্রে দুঃখ ভ্যানিশ, দেখাল হ্যারি

ছবি: কলকাতার হ্যারি

পরিচালনা: রাজদীপ ঘোষ

অভিনয়ে: সোহম চক্রবর্তী, প্রিয়াঙ্কা সরকার, লাবনী সরকার, অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায়, দীপঙ্কর দে, প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, রাজ চক্রবর্তী, অভিজিৎ গুহ, সুদেষ্ণা রায়, ঐশিকা গুহঠাকুরতা, সুদীপা বসু, প্রেমেন্দু বিকাশ চাকি

দৈর্ঘ্য: ২ ঘণ্টা ১২ মিনিট

RBN রেটিং: ৩/৫

বিশ্বাস না থাকলে ম্যাজিক হয় না, হ্যারি সবসময় বলতো। আসলে আমরাও তো বলি বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর। সেরকমই, যদি ম্যাজিকে বিশ্বাস করা যায় তবেই একমাত্র তা সত্যি হয়, এ কথা হ্যারি মনপ্রাণ দিয়ে মানতো। ওর প্রিয় বন্ধুদেরও তাই শেখাত। ছোট্ট বন্ধুদের তো বটেই, এমনকি সদা-গম্ভীর, অবিশ্বাসী, সন্দেহপ্রবণ মোহরকেও সে এই কথা শিখিয়েছিল। অথচ যখন তার নিজের চারপাশটা অন্ধকার হয়ে এল, তখন হ্যারির মন্ত্রগুলোও যেন মিলিয়ে গেল। 



গল্পের হ্যারি হলো বাস্তবের স্কুলবাস ড্রাইভার হরি (সোহম)। তার বাসের নাম আব্বুলিশ। সেই রূপকথার রাজ্যের মতো বাসে করে স্কুলে যায় আগডুম, বাগডুম, তিতলি আর তাদের বন্ধুরা। বাচ্চাদের সকলের প্রিয় হ্যারি তাদের গল্প শোনায় আর ম্যাজিক দেখায়। সেই সঙ্গে তাদের চোখে এঁকে দেয় স্বপ্ন, যোগায় সাহস, আত্মবিশ্বাস। হ্যারি এমন এক মানুষ যাকে দেখলে প্রথমটায় মনে হতে বাধ্য এমন বাস ড্রাইভার আবার হয় নাকি! আবার একটা সময় তার সহজ সরল কথাগুলো যখন অন্যদের মনেও স্বপ্ন দেখার অভ্যাস জাগিয়ে তোলে তখন মনে হয় ‘এমন কেন সত্যি হয় না আহা!’

আরও পড়ুন: সব কান্নার শব্দ হয় না, বেজে উঠল পটদীপ

হ্যারি বা হরির কথার জাদুতে মুগ্ধ হয় তিতলির দিদি মোহর (প্রিয়াঙ্কা)। প্রথমে সন্দেহ করলেও পরে সে বিশ্বাস করতে থাকে হ্যারির জাদুতে। পটারের ম্যাজিক মন্ত্র ‘অকুলাস রেপারো’ ও ‘উইংগার্ডিয়াম লেভিওসা’র স্পর্শে হ্যারি সকলকে ভালো রাখতে চায়।

অফিসের কাজের চাপে জমে যাওয়া মোহরের হতাশার পাহাড়কে হ্যারির মন্ত্র যেন এক নিমেষে উধাও করে দেয়। কিন্তু মোহর-তিতলির মায়ের (লাবণী) বড় স্কুলের স্বপ্ন, ছোট মেয়ের ওপর অত্যধিক প্রত্যাশার চাপ, অযথা বাচ্চাকে বকাঝকা করা, সব মিলিয়ে তিতলি এবং হ্যারির জীবনটাও অনেকটা জটিল হয়ে যায়। আব্বুলিশের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হয় তিতলি ও তার বন্ধুদের। তবে কি সত্যিই হ্যারি ম্যাজিশিয়ন নয়? তবে কি সে মুখোশের আড়ালে কোনও খারাপ লোক?

আরও পড়ুন: বছরের শেষে দুই ফেলুদা?

‘কলকাতার হ্যারি’র মাধ্যমে ছবির পর্দায় এক মন ভালো করা রূপকথার জগত বুনেছেন রাজদীপ যা কোথাও গিয়ে বড়দেরও বিশ্বাস করতে বাধ্য করায় যে ম্যাজিক আজও ঘটে, শুধু বিশ্বাসটা রাখতে হয়। ছবির অনেকটা জুড়ে ভিএফএক্স রয়েছে যা রূপকথার দুনিয়াকে দর্শকের সামনে উপস্থাপন করে এক ছেলেমানুষী ভালোলাগায়। ছোটদের সঙ্গে হ্যারির সম্পর্ক এবং মোহর ও হরির রসায়ন দেখতে ভালো লাগে। 

তবে কিছু জায়গায় আরও একটু যত্ন নিলে ভালো হতো। যেমন দুই বোনের মধ্যে বন্ধুত্বের অভাব, যেটা আছে বলা হলেও সেভাবে দেখা গেল না। তিনদিন পর বাড়ি ফিরে মোহর সবটা শুনে প্রথমেই হরিকে খুঁজতে বেরিয়ে যায়, সত্যিটা না জেনেই। প্রথমেই তো তার বোনের কাছে যাওয়া উচিত ছিল। বোনের মনের নাগাল পাওয়ার কোনও চেষ্টাই তার মধ্যে দেখা গেল না। 

আরও পড়ুন: নব্বইয়ের ‘সত্যান্বেষী’, বাদ পড়লেন ব্যোমকেশ

হরির চাকরি যাওয়ার অন্য কারণও দেখানো যেতে পারত। শুধুমাত্র একজন অভিভাবকের অভিযোগে সাধারণত পুরোনো ড্রাইভারের চাকরি যায় না। বাচ্চা খেলায় মেতে গিয়ে পড়াশোনা করছে না, শুধু এই অভিযোগে বরখাস্ত হওয়া একটু অদ্ভুত লাগল।

এছাড়া প্রসেনজিতের চরিত্রটির উপস্থাপনা অন্যভাবে আসতে পারত। বিশেষভাবে সক্ষম কোনও শিশুর বাবা হলেই সর্বত্র দুঃখ বয়ে বেড়াতে হবে, এটা আজকের দিনে তেমন বাস্তবোচিত নয়।

হরিকে গ্রেফতার করার আগে বা পরে পুলিশের তরফে কোনওরকম অনুসন্ধানের চেষ্টাও দেখা গেল না। যেটা এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে জরুরি ছিল।

আরও পড়ুন: বেহিসেবী জীবনযাপন, আজ স্মৃতির অতলে সৌমিত্র

সব শেষে বলা যায় আদ্যোপান্ত একটা ছোটদের ছবি হতে গিয়েও কোথাও যেন বড়দের ছবি হয়ে গেল ‘কলকাতার হ্যারি’। বর্তমান পৃথিবীতে শৈশব এমনিই বড় কম সময়ের জন্য আসে। সেটাকেও বড়দের জটিল দুনিয়ার গোলকধাঁধায় ফেলে আস্ত একটা রূপকথার রাজত্বকে পঙ্কিল না করলেও হতো। কারণ পড়াশোনার চাপ, বড়দের চাহিদা, বকাবকি বা পরীক্ষার ফল খারাপের মতো বহু সমস্যার মধ্যে দিয়ে আজকের বাচ্চাদের প্রতিনিয়ত যেতে হয়। 

তবু ম্যাজিক, স্বপ্ন, হিংসুটে দৈত্য আর ভালোবাসার গল্পে রূপকথাকে জুড়ে দেওয়ার এক সুন্দর প্রয়াস দেখিয়েছেন রাজদীপ। ভালো লাগে ছবি শুরুর সময়ে ছোটদের গল্প বলার দৃশ্যটি। বিরতির আগে মোহরের স্বপ্নদৃশ্য মনে রাখার মতো। ক্যাফে তৈরির স্বপ্ন নিয়ে হরির প্রচেষ্টা, বা আব্বুলিশের সঙ্গে তার বিচ্ছেদের দৃশ্য মন ছুঁয়ে যায়। আরও বেশ কিছু দৃশ্য সুন্দর আবেগঘন মুহূর্তের সৃষ্টি করে।

আরও পড়ুন: শেষের সেদিন, উপস্থিত ছিলেন শুধু মহেশ ও ড্যানি

নিজের চরিত্রে সকলেই সার্থক রূপদান করেছেন বলা যায়। ছোট-ছোট ভূমিকায় প্রত্যেকেই যথাযথ। আবেগী চরিত্রে সোহমকে বরাবরের মতোই ভালো লেগেছে। প্রিয়াঙ্কার মোহর সত্যি যেন রূপকথার ছোঁয়া এনে দেয়। তাঁকে দেখতেও খুব সুন্দর লেগেছে। এছাড়া উল্লেখযোগ্য লাবণীর অভিনয়। সাধারণত ভালোমানুষ মায়ের চরিত্রেই তাঁকে দেখতে অভ্যস্ত বাংলা ছবির দর্শক, যেখানে অভিনেত্রীর বিশেষ কিছু করার থাকে না। বহুদিন পর লাবণীকে পাওয়া গেল স্বমহিমায়। দুই মূল চরিত্রের বাবা হিসেবে অরিন্দমের ভূমিকা আরও একটু রাখা যেত। আলাদাভাবে উল্লেখ করতেই হয় ছোট্ট ঐশিকার অভিনয়। তাঁর মতো করে দুঃখের মুহূর্তগুলোকে অনুভব করাতে সম্ভবত আর কেউ পারেনি। অত্যন্ত সহজ ও সহজাত অভিব্যক্তির মাধ্যমে তিতলিকে জীবন্ত করে তুলেছে ঐশিকা। 

রোহিত দে ও সৌম্য নন্দীর কাহিনী ও চিত্রনাট্য প্রশংসার দাবি রাখে। জিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের সুরে ছবির গানগুলি শ্রুতিমধুর।

বহুদিন বাদে বাচ্চাদের জন্য রূপকথার ছবি দেখা গেল বাংলায়। গভীর মনস্তাত্বিক কচকচির ভিড়ে কয়েক দশক আগে হারিয়ে যাওয়া সহজ রূপকথা যে এখনও বাচ্চাদের সুস্থ ও সতেজ করে তুলতে অনেক বেশি কার্যকরী, তা আবারও প্রমাণ করল হ্যারির কাহিনী। এক অন্যধারার ‘ফিল গুড’ গল্পে এমন ছবি মন ভালো করে দিতে বাধ্য। 



Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Swati

Editor of a popular Bengali web-magazine. Writer, travel freak, nature addict, music lover, foody, crazy about hill stations and a dancer by passion. Burns the midnight oil to pen her prose. Also a poetry enthusiast.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *