কর্মফলই শেষ কথা, শেক্সপিয়রের সার্থক বিনির্মাণ

সিরিজ়: মন্দার

অভিনয়ে: দেবাশিস মণ্ডল, সোহিনী সরকার, দেবেশ রায়চৌধুরী, অনির্বাণ ভট্টাচার্য, শঙ্কর দেবনাথ, লোকনাথ দে, সজল মন্ডল, সুদীপ ধাড়া, সুমনা মুখোপাধ্যায়, কোরক সামন্ত, দোয়েল রায় নন্দী, দিগন্ত সাহা

পরিচালনা: অনির্বাণ ভট্টাচার্য

দৈর্ঘ্য: ৩ ঘন্টা ৪২ মিনিট (পাঁচ পর্বে)

RBN রেটিং: ৪/৫

ক্ষমতার লোভ থেকে আসে পাপের চিন্তা। সেই চিন্তা রূপ পায় হত্যার ষড়যন্ত্রে। হত্যার পর পাপকার্য সম্পন্ন হয় ঠিকই, কিন্তু বাকি রয়ে যায় প্রতিশোধ। সঙ্গত দেয় পাপ-পরবর্তী আত্মগ্লানি। সব মিলিয়ে প্রমাণ হয়, কর্মফলই শেষ কথা। পরপর এই সুরগুলিকে একত্র করলে যে নাটকের নাম পাওয়া যায়, তা উইলিয়ম শেক্সপিয়রের ‘ম্যাকবেথ’। এই নাটক অবলম্বনে বহু ছবি নির্মিত হয়েছে। বাংলায় এই প্রথম ‘ম্যাকবেথ’কে ওয়েব সিরিজ়ে নিয়ে এলেন অনির্বাণ।




স্কটল্যান্ডের প্রেক্ষাপট বদলে হয়ে গেছে গেইলপুর। রাজা ডানকান এখানে স্থানীয় ডন ডাবলুভাই (দেবেশ)। ম্যাকবেথ ওরফে মন্দার (দেবাশিস) তার সামন্ত নয়, বরং অর্থ দিয়ে পুষে রাখা গুণ্ডা। মন্দারের সবসময়ের বন্ধু বঙ্কাদা (শঙ্কর)। দর্শক যদি ‘ম্যাকবেথ’ পড়ার পর এই সিরিজ় দেখতে বসেন, তাহলে অনায়াসেই বুঝতে পারবেন বঙ্কাদা আসলে ব্যাঙ্কো চরিত্রের বিনির্মিত রূপ। একইভাবে ব্যাঙ্কোর পুত্র ফ্লিয়ান্স হয়েছে ফোনটুস, লেডি ম্যাকবেথ হয়েছে লাইলি (সোহিনী)।

আরও পড়ুন: নেপথ্যে গাইলেন জলি, স্টেজে দাঁড়িয়ে ঠোঁট মেলালেন রাহুল দেব বর্মণ

‘ম্যাকবেথ’ এক আদ্যোপান্ত রাজনৈতিক নাটক। সেই নাটক অবলম্বনে নির্মিত ‘মন্দার’-এর প্রেক্ষাপটে রাজনীতি সরাসরিভাবে যুক্ত নয়। গেইলপুর জেলেপাড়া, মাছের ভেড়ির এলাকা। সেখানকার ভেড়ির মালিকানা নিয়ে যে রাজপাট, তার ক্ষমতার লড়াই নিয়েই ‘মন্দার’-এর সূচনা। তবে ম্যাকবেথ অবলম্বনে হলেও, কাহিনী কিছুটা বিনির্মাণ করেছেন চিত্রনাট্যকার প্রতীক দত্ত ও অনির্বাণ। সেই বিনির্মাণের জেরেই কুখ্যাত তিন ডাইনির রূপ বদলে গিয়েছে। এখানে ডাইনিরূপে কালা নামে এক বেড়ালকেও দেখা গিয়েছে। তাদের ভবিষ্যদ্বাণীর নির্যাস এক থাকলেও, কাহিনী অনুসারে বদলেছে তার রকমও। সর্বোপরি কর্মফলের সঙ্গে কালও যে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তা দেখিয়েছেন অনির্বাণ-প্রতীক জুটি।

এই সিরিজের বেশিরভাগ অভিনেতাই নাট্যব্যক্তিত্ব। পোড়খাওয়া দেবেশ ও সোহিনী অনবদ্য। দেবাশিসের জন্য কোনও প্রশংসাই যথেষ্ঠ নয়। এছাড়া অন্যদের মধ্যে অনেককে দেখে বোঝাই যায়নি যে তাঁরা সকলেই মঞ্চ থেকে পর্দায় পা রাখলেন। ট্রেলার মুক্তি পাওয়ার পরে সোহিনীকে লেডি ম্যাকবেথ হিসেবে নির্বাচন করায় সমালোচনা হয়েছিল। তবে এই সিরিজ় দেখলে দর্শক বুঝতে পারবেন, সোহিনী ছাড়া অন্য কেউ থাকলে তা হয়তো এতটা নিখুঁত হতো না।

আরও পড়ুন: হাফপ্যান্ট পরে অভিনয়, কিশোরের প্রস্তাবে সত্যজিতের অট্টহাসি

অন্যান্য চরিত্রের মধ্যে শঙ্করের অভিনয় মনে দাগ কেটে যায়। এছাড়া দুই ডাইনি মজনু ও পেদোর ভূমিকায় সজল ও সুদীপের অভিনয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। একই সঙ্গে তাঁদের রূপসজ্জায় সোমনাথ কুণ্ডুর অনবদ্য প্রচেষ্টাকে কুর্ণিশ। তবে মুকদ্দর মুখার্জি (অনির্বাণ) নামের পুলিশ অফিসার চরিত্রটি একটু বিরক্তির উদ্রেক করে। প্রশাসনের প্রতিনিধি হিসেবে পুলিশ একান্তই অপরিহার্য বলেই হয়তো এই চরিত্রের অবতারণা।

মূল ‘ম্যাকবেথ’ পাঁচ অঙ্কের, এই সিরিজ়ও তাই। প্রতিটি পর্বের নাম বাংলায় মাছের সঙ্গে সম্পর্কিত হলেও, ইংরেজি নামকরণ হয়েছে নাটকের কোনও উদ্ধৃতি দিয়ে। ‘ম্যাকবেথ’-এর মধ্যে যেমন প্রচুর পরিমাণে সিম্বোলজি বা রূপকের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়, এই সিরিজ়েও তাই। পরিচালক অত্যন্ত যত্নে প্রতিটি রূপকের প্রতি সুবিচার করেছেন। একই সঙ্গে ‘ম্যাকবেথ’-এ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু মনোলগ পাওয়া যায়। কিন্তু সেই মনোলগ পর্দায় দেখালে তা একঘেয়ে এবং বিরক্তির উদ্রেক করতে পারতো। সেই জন্য পরিচালক কিছু সংলাপহীন দৃশ্যপট রচনা করেছেন, যা রীতিমতো মনোমুগ্ধকর।

আরও পড়ুন: শেষের সেদিন, উপস্থিত ছিলেন শুধু মহেশ ও ড্যানি

দৃশ্যগ্রহণে সৌমিক হালদার বিশেষ প্রশংসার দাবি রাখেন। বেশ কিছু দৃশ্য অনেকদিন মনে থেকে যাবে। ড্রোন শটগুলি যথাযথ এবং নিখুঁত। একই সঙ্গে শুভদীপ গুহর আবহ গোটা সিরিজ় নাটকীয়তা বজায় রাখে। সংলাপ ভৌমিকের সম্পাদনাও যথাযথ।

নানা খুঁটিনাটি ডিটেলিংয়ের দিকে নজর রেখেছেন প্রতীক ও অনির্বাণ। বিভিন্ন রূপকের পাশাপাশি তাঁরা সমুদ্রকে এমনভাবে ব্যবহার করেছেন যে জে এম সিংয়ের ট্রিটমেন্ট মনে পড়ে যায়। একই সঙ্গে টিভিতে বা ফোনে চলা সিনেমাগুলিও নিছক অপ্রয়োজনে ব্যবহার হয়নি।



‘ম্যাকবেথ’ শেক্সপিয়রের সংক্ষিপ্ততম রাজনৈতিক ট্র্যাজেডি। তবু সিরিজ়ে প্রতিটি পর্বের দৈর্ঘ্য একটু ক্লান্তিকর। মূল নাটক পড়া থাকলে হয়তো তা মনে হবে না। কিন্তু সাধারণ দর্শক সিরিজ়ের দৈর্ঘ্য দেখে একটু বিড়ম্বিত হতেই পারেন।

প্রায় অর্ধশতকেরও আগে ‘নায়ক’ ছবিতে অরিন্দমরূপী উত্তমকুমার বলেছিলেন, ‘ক্যামেরার সামনে অতিঅভিনয় চলে না! একটু বাড়িয়েছ কী দশগুণ বেড়ে যাবে।’ বেশ কয়েকটি দৃশ্যে থিয়েটার থেকে ক্যামেরার সামনে আসা নবাগত শিল্পীদের অতিঅভিনয় চোখে পড়ে। আগামীতে এই ব্যাপারটি থাকবে না আশা করা যায়।

পরিচালক হিসেবে এই প্রথম ক্যামেরার পেছনে এলেন অনির্বাণ। এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, পরিচালক হিসেবে তিনি সফল। দর্শক আগামীতে তাঁর কাছে আবার কোনও ক্লাসিকের এমন সার্থক বিনির্মাণ প্রত্যাশা করতেই পারেন।



Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Diptajit

An avid reader and a passionate writer of crime fiction. Poems and verses are his second calling. Diptajit is the editor of a Bengali magazine. Nothing makes him weaker than books, films and food

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *