আর কিছুটা আবাদ করলে হয়তো সোনাই ফলতো
ছবি: মানবজমিন
পরিচালনা: শ্রীজাত বন্দোপাধ্যায়
অভিনয়ে: পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, প্রিয়াঙ্কা সরকার, পরান বন্দোপাধ্যায়, খরাজ মুখোপাধ্যায়, অরুণাভ দত্ত
দৈর্ঘ্য: ২ ঘণ্টা ১৩ মিনিট
RBN রেটিং ★★★★★☆☆☆☆☆
‘এমন মানবজমিন রইল পতিত আবাদ করলে ফলতো সোনা, মন রে কৃষিকাজ জানো না।’ মানুষের কত স্বপ্নই তো প্রতিদিন অধরা থেকে যায়। অথচ স্বপ্ন ছাড়া কেউই বাঁচে না। যার কিছু নেই সেও স্বপ্ন দেখে। তবু ক’টা স্বপ্নই বা পূরণ হয়! তখন পড়ে থাকে শুধু আফসোস। কী হতে পারত, আর কেন হলো না। তাও কিছু মানুষ তাদের স্বপ্নের পিছনে দৌড়ে বেড়ায়। যেমন এই ছবিতে কুহু (প্রিয়াঙ্কা) ও সংকেত (পরমব্রত) তাদের স্বপ্নের জন্য অনেকটা হেঁটে গিয়েও বাধা পায় কিন্তু থেমে যায় না।
প্রত্যন্ত গ্রামের মেয়েদের বিয়ে আটকানোর জন্য, তাদের ভবিষ্যত তৈরির জন্য কুহুর এনজিওর তরফে সরকারি গ্রান্ট থেকে অবৈতনিক মানবজমিন নামক উচ্চবিদ্যালয় তৈরি হবে, এমনটাই কথা ছিল। এই উদ্যোগে কুহুর পাশে ছিল সংকেতও। বলা যায় সংকেতের উৎসাহই বেশি ছিল। তবু শেষ মুহূর্তে এসে হতাশ করে ঈপ্সিতাদি (রূপাঞ্জনা)। জানা যায় যে গ্রান্ট মানবজমিনের পাওয়ার কথা ছিল, তা পেয়েছে অন্য এক এনজিও।
আর কোনও রাস্তা নেই ভেবে হতাশ হতে গিয়েও শেষ মুহূর্তে কুহুর মনে পড়ে সংকেতের জ্যেঠু বরেন্দ্রর (পরান) কথা। একসময়ের সফল ব্যবসায়ী, অকৃতদার বরেন্দ্রের অগাধ টাকা। সে টাকা তিনি বিস্তর খরচও করেন, কিন্তু শুধু সেখানেই যেখানে কিঞ্চিৎ পুণ্যের আশা আছে। তার পুণ্যের ডায়েরিতে রোজের জমার হিসেব লেখা হয়। সেখানে কুকুরকে বিস্কুট খাওয়ানো থেকে শুরু করে গাছে জল দেওয়া, তীর্থ করা এবং পুজোর চাঁদা দেওয়া, সবটাই পুণ্যের হিসেব হয়ে খাতায় থেকে যায়। এইসব পুণ্যফল যোগ করে বরেন্দ্র যে মরার পর সটান স্বর্গে যাবেন, এ ব্যাপারে তার নিজের কোনও সন্দেহ নেই। এদিকে পুজোর চাঁদা চাইতে আসা পাড়ার ছেলেদের যিনি এক হাজারের জায়গায় পাঁচ হাজার টাকা যেচে দিয়ে দেন, তিনি ভাইপোর স্বপ্নের স্কুল বানাতে একটা টাকাও দিতে নারাজ।
তুমুল অশান্তি করে সংকেত তার জ্যেঠুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। এর মধ্যে বরেন্দ্রর কাছে এসে হাজির হয় জীবন (খরাজ) ও বিজন (অরুণাভ)। তাদের দাবি, তারা স্বর্গের জমি বেচে। আকাশপ্রদীপ প্রজেক্টের ফেজ় ওয়ানের কাজ শুরু হয়ে গেছে। তাই স্বর্গে যাওয়ার আগেই নিজের পরকালের বাসস্থানের ব্যবস্থা করে রাখলে ভালো হয়।
আরও পড়ুন: শেষ দৃশ্যে ভাঙা হোল্ডার, সত্যজিতের জয়জয়কার
গ্রামের ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যত, অবৈতনিক স্কুল, নিজেদের জীবনে মোটামুটি সফল দুটি ছেলেমেয়ের স্বপ্নের ঠিকানা, শুরুটা ভালোই যাচ্ছিল। তবে সম্ভবত কমেডির প্রয়োজনেই জীবন এবং বিজনের আগমনে গল্পের তাল কেটে গেল। শুধু কমেডি হলেও মানা যেত। বহু ছবিতেই এমন নির্দোষ কমেডি দৃশ্য থাকে শুধুমাত্র বিনোদনের উদ্দেশ্যে। কিন্তু এখানে মূল গল্পের সঙ্গে সেই অবাস্তব ঘটনাকে জুড়তে চেয়ে ছবির গুরুত্ব এক ধাপে যেন কিছুটা নেমে গেল। জ্যাঠা-ভাইপোর মধ্যে আবেগ ও যুক্তির লড়াই যেভাবে উত্তেজনা বাড়াচ্ছিল, তাতে কোনও একজন চরম সিদ্ধান্ত নিলে ছবির মোড় অন্যদিকে ঘুরতে পারত। মানবজমিন প্রজেক্টের গাম্ভীর্য ও গুরুত্বও তাতে বজায় থাকত পূর্ণমাত্রায়। সে পথে যাওয়ার সব রসদ মজুত থাকতেও কেন গল্প এমন মাঝপথে খেই হারিয়ে ফেলল বোঝা গেল না। শিক্ষিত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন কোনও মানুষ তার মহৎ ইচ্ছাপূরণের জেদে যে কোনও রাস্তা অবলম্বন করতে পারে, এমনটা বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠল না।
কিংবদন্তী অভিনেতা ছবি বিশ্বাসের নকল খরাজ বরাবরই ভালো করেন। কিন্তু শুধু সেই কারণে গল্পে এমন একটা অদ্ভুত পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হাসির চেয়ে বেশি বিরক্তি উদ্রেক করে।
আরও পড়ুন: শেষের সেদিন, উপস্থিত ছিলেন শুধু মহেশ ও ড্যানি
যুক্তি দিয়ে দেখলে টাকার প্রয়োজনে সংকেত বাড়ির অংশ দাবি করতে পারত, অন্তত বাস্তবে এমনটাই হয়ে থাকে। সে জ্যেঠুকে বাক্যবাণে বিদ্ধ করলেও এমন কোনও দাবিই জানাল না। উল্টোদিকে একজন মিথ্যেবাদী ঠগকে চেক লিখে দিয়েছেন জেনে এতদিনের ব্যবসায়ী বরেন্দ্র ব্যাঙ্কে ফোন করে সেই চেক স্টপ না করিয়ে তাদের খুঁজতে বেরোলেন কেন? এমনকি ছবির শেষ দৃশ্যও বেশ অমানবিক বলেই মনে হয়।
ইন্ডাস্ট্রির ফার্স্ট বয় নামে নিজেকে নিয়ে মজা করেছেন বিশেষ ভূমিকায় থাকা সৃজিত মুখোপাধ্যায়। এ ধরনের মজা তিনি এবং তাঁর বন্ধু পরিচালক গণমাধ্যমে করেই থাকেন। তবে সেটা যে সব জায়গায় ঠিক মানানসই হয় না, এটা দুই পরিচালকেরই বোঝা উচিত ছিল। এছাড়া তাঁর সমাজসেবার ফিরিস্তিটা ছবির গল্পে না ঢুকলেই ভালো লাগত।
আরও পড়ুন: গল্প বলার নিজস্ব ভাষার পাশাপাশি সাহসের পক্ষে মত প্রসূন, অনির্বাণদের
এবার আসা যাক ছবির ভালো দিকগুলিতে। বেশ কিছু দৃশ্যের বিগ স্ক্রিন এফেক্ট মনে রাখার মতো। দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ জমি বারবার দেখতেও ভালো লাগে। সুপ্রিয় দত্তের চিত্রগ্রহণ ঝকঝকে ও সুন্দর। গল্প যাই হোক, পরিচালকের কবিমনের কারণেই বোধহয় ছবিটি আপাদমস্তক ভারী দৃশ্যনন্দন হয়ে উঠেছে। আউটডোর দৃশ্য ছাড়াও ঘরের ভেতরের দৃশ্যে অন্দরসজ্জা নজর কাড়তে বাধ্য। সাবর্ণী দাসের পোশাক পরিকল্পনায় প্রিয়াঙ্কাকে দেখতে অসাধারণ লেগেছে আগাগোড়াই। ঘনিষ্ট দৃশ্যগুলিতে পরমব্রত ও প্রিয়াঙ্কা, দুজনকেই খুব সাবলীল ও সুন্দর লেগেছে।
ছবির বেশ কিছু সংলাপ মজাদার। যেমন, ‘মরবেন এখানে, বাড়ি উঠবে ওখানে’, ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা যেন কোন বাবুর ছবি? কোনও বাবুর ছবি নয়, ওটা বাবুর বাবার ছবি’, ‘এখানে রিয়াল এস্টেট, ওখানে সুরিয়াল এস্টেট’, এরকম বেশ কিছু সংলাপে অসাধারণ কমিক টাইমিং পাওয়া গেল পরান ও খরাজের কথোপকথনে।
‘মানবজমিন’ সম্ভবত মনে থেকে যাবে একটাই কারণে। ‘মন রে কৃষিকাজ জানো না,’ এই একটিমাত্র গানে মাতিয়ে দিলেন অরিজিৎ সিংহ। বিভিন্ন ধারার গান কী অনায়াসে গেয়ে ফেলতে পারেন তা আরও একবার এই রামপ্রসাদী গানের মাধ্যমে মনে করিয়ে দিলেন অরিজিৎ। এছাড়া অন্যান্য গানের মধ্যে জয় সরকারের সুরে ও শ্রীজাতর কথায় শ্রেয়া ঘোষালের গাওয়া ‘দুঃখ কোথায় যাবে তুমি সুখী হলে’ গানটি রেশ রেখে যায়। গল্পের নানা বাঁকে শঙ্খ ঘোষের কবিতা ও শ্রীজাতর নিজের রচনা শুনতে ভালো লাগে। তবে সম্পাদনা আরও একটু টানটান হলে ছবির দৈর্ঘ্য দু’ঘণ্টার ভেতর রাখা যেত।
পরমব্রত এবং প্রিয়াঙ্কাকে এর আগে জুটি হিসেবে দেখা গেলেও, এমন প্রবল রোমান্টিক জুটি হিসেবে দর্শকের সামনে আসেননি তাঁরা। নতুন বছরে এই ঝকঝকে জুটির রসায়ন এবং অরিজিতের গান শুনতে একবার প্রেক্ষাগৃহে ঢুকে পড়াই যায়।