সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনছবি

ছবি: একান্নবর্তী

পরিচালনা: মৈনাক ভৌমিক

অভিনয়ে: অলকানন্দা রায়, অপরাজিতা আঢ্য, সৌরসেনী মৈত্র, অনন্যা সেন, সুদীপ মুখোপাধ্যায়, কৌশিক সেন, বিশ্বনাথ বসু

দৈর্ঘ্য: ২ ঘন্টা ১৩ মিনিট

RBN রেটিং: ৩/৫

‘একান্নবর্তী’ শুনলেই মনে হয় বাবা, জ্যাঠা, কাকা, পিসি, দাদু, ঠাকুমা সবাই একসঙ্গে এক ছাদের তলায় মিলেমিশে থাকা। এক হেঁসেলে সংসারের সকলের রান্নার তোড়জোড়। কিন্তু বর্তমান ব্যস্ত যুগের সময়ের মাপকাঠিতে ‘একান্নবর্তী’র এই সংজ্ঞা ফলপ্রসু হয় না। কেউ চাকরির খাতিরে দেশের বাইরে, কেউ বা পড়াশোনার জন্য শহর থেকে দূরে কোনও হোস্টেলে বা মেসে, আবার কেউ-কেউ একই শহরে মা-বাবার থেকে আলাদা থাকে। শেষ পর্যন্ত পড়ে থাকে একটা পুরোনো বাড়ি আর একরাশ স্মৃতি। কলকাতার অলিতে গলিতে, শুধু স্মৃতিকে আঁকড়ে রেখে এরকম  অনেক বাড়ি আজও দাঁড়িয়ে আছে। কোনওটা হয়তো প্রমোটারের লোভী চোখের শিকার হয়, ওঠে বহুতল বা শপিং কমপ্লেক্স, কোনওটা বা সিনেমা ও সিরিয়ালের শ্যুটিং স্পটে পরিণত হয়। মৈনাকের ‘একান্নবর্তী’ও সেরকম একটা বাড়ির কথা বলে। বুঝিয়ে দেয়, একই পরিবারের সদস্য না হয়েও একসঙ্গে এক ছাদের তলায় থাকাকেও ‘একান্নবর্তী’ বলা যায়।




মানুষ আদতে ভীষণভাবে সামাজিক। সে কিছুতেই একা বাঁচতে পারে না। তার দরকার সঙ্গী, লোকজন, পরিবার। বারাসতের ব্যানার্জী পরিবারের বিশাল বাড়ি সামলান মিসেস ব্যানার্জী (অলকানন্দা)। তার সঙ্গী বহু পুরোনো কাজের লোক রতন ও ঝুম্পা। স্বামী মারা যাওয়ার আগে প্রচুর টাকা ঋণ নেওয়ায় এই সুবিশাল বাড়ি এখন ব্যাঙ্কের কাছে বন্ধক। এক মেয়ে মালিনীর (অপরাজিতা) বিয়ে হয়েছে কলকাতায়। তার দুই মেয়ে শীলা (সৌরসেনী) ও পিঙ্কি (অনন্যা)। শীলা নিজের মতো কাজে ব্যস্ত, পিঙ্কি বেঙ্গালুরুতে হোটেল ম্যানেজমেন্ট পাঠরত। স্বামী সুজন (সুদীপ) পরকীয়ায় লিপ্ত।

আরও পড়ুন: নেপথ্যে গাইলেন জলি, স্টেজে দাঁড়িয়ে ঠোঁট মেলালেন রাহুল দেব বর্মণ

হঠাৎই এক গাড়ি দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয় সুজন। মালিনী তার স্বামীর এই পরকীয়ার কথা জানতে পারে। পায়ের তলার মাটি সরে যায়। অন্যদিকে ঋণ শোধ করার জন্য বাড়ির দুর্গাপূজার মধ্যেই একটি ওয়েব সিরিজ় শুটিংয়ের অনুমতি দেন মিসেস ব্যানার্জী। স্বামীকে হাসপাতালে রেখেই মালিনী ও তার দুই মেয়ে পুজোয় বাপের বাড়ি চলে আসে। পুজোর চারটে দিন ধীরে-ধীরে মালিনীর মনের মধ্যে জমে থাকা সব আক্ষেপ, অভিমান, রাগ অন্য এক সংজ্ঞা খুঁজে নেয়। শ্যুটিং দলের সকলের সঙ্গে এই বাড়ির সদস্যদের এক অন্যরকম সম্পর্ক তৈরি হয়। ওয়েব সিরিজ়ের পরিচালক অভ্রজিতের (কৌশিক) সঙ্গে নিজের সমস্ত পাওয়া না পাওয়ার কথা বলতে গিয়ে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে মালিনীর।

আরও পড়ুন: নব্বইয়ের ‘সত্যান্বেষী’, বাদ পড়লেন ব্যোমকেশ

সমাজের তৈরি করা চেহারাগত সৌন্দর্য নিয়ে ছবিতে উষ্মা প্রকাশ করেছেন মৈনাক। শারীরিকভাবে বেশ মোটা হওয়ায় পিঙ্কি অবসাদের শিকার। সে মনে করে, তার সমস্ত গুণ শারীরিক অসৌন্দর্যে চাপা পড়ে গেছে। তাই শ্যুটিং দলের অমিত যখন তার প্রশংসা করে, পিঙ্কি ভাবে তাকে দয়া দেখানো হচ্ছে। অবসাদের কারণে মদ, গাঁজা, সিগারেট তার সঙ্গী। খাবার খেয়ে গলায় আঙুল দিয়ে বমি করে রোগা হওয়ার চেষ্টা করে সে। হতাশার গ্রাসে একটা সময় হাতের শিরায় ব্লেডও টানে পিঙ্কি। এরকম বহু পিঙ্কি আমাদের চোখের সামনেই ঘুরে বেড়ায়। তাদের নিয়ে হাসিঠাট্টা করে আরও অবসাদের দিকে ঠেলে দিই আমরা। সবদিক থেকে নিজেকে একা মনে করলেও শেষ পর্যন্ত পিঙ্কি তার পরিবারকে আঁকড়ে ধরে। পরিবারের প্রত্যেকের ব্যক্তিগত সমস্যা থাকা স্বত্ত্বেও একসঙ্গে মিলেমিশে বাঁচতে শেখে তারা। এখানেই তারা হয়ে ওঠে ‘একান্নবর্তী’। খুব সুন্দর ও প্রাসঙ্গিক একটি বার্তা দিয়ে ছবিটি শেষ করেছেন মৈনাক।



অভিনয়ে প্রত্যেকই যথাযথ। অপরাজিতা তাঁর নিজভঙ্গিতে ভীষণ সাবলীল। সবার মধ্যে আলাদা জায়গা করে নিয়েছেন অনন্যা। একমুখ সারল্যের মাঝেও অসাধারণ অভিনয় দক্ষতা ফুটিয়ে তুললেন তিনি। ভালো লাগে সৌরসেনীকেও। সকলের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে নিজেকে শক্ত প্রমাণ করার চেষ্টা করলেও শেষ পর্যন্ত কারোর একজনের কাঁধ খোঁজে সেও। ভিতরে চলতে থাকা অন্তর্দ্বন্দ্বকে শেষ করে নিজের মতো করে সে ঘুরে দাঁড়ায়। অলকানন্দা, কৌশিক, রবি সাউ, গৌরব রায়চৌধুরী, মধুরিমা ঘোষ সকলেই তাঁদের অভিনয়  ক্ষমতার প্রমাণ দিলেন। ভালো লাগে অলকানন্দার নিজের গলায় রবীন্দ্রসঙ্গীত। লগ্নজিতার কণ্ঠে ‘বেহায়া’ ইতিমধ্যেই সকলের পছন্দের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে।

পুজোর রেশ শেষ হয়ে গিয়েও যেন ফের ফিরে আসে ‘একান্নবর্তী’তে। প্রয়াত পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষকে শ্রদ্ধাও জানালেন মৈনাক। ফিরে এল ‘দোসর’, ‘বাড়িওয়ালি’ ও ‘উৎসব’-এর স্মৃতি। স্বামীর পরকীয়া, পুজোয় সকলের একসঙ্গে হওয়া, বনেদী বাড়ির ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা এবং শ্যুটিং করতে আসা পরিচালকের সঙ্গে বাড়ির মানুষগুলোর রসায়ন, সবকিছুই মিলেমিশে গেল ‘একান্নবর্তী’তে। ছবির শেষে তাঁর প্রিয় ঋতুদাকে কৃতজ্ঞতাও জানিয়েছেন মৈনাক। ঋতুপর্ণর মতোই সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনছবি ‘একান্নবর্তী’। উৎসবের আমেজ থাকতে-থাকতে পরিবারের সকলকে নিয়ে যা একবার অন্তত দেখাই যায়।



Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Gargi

Travel freak, nature addict, music lover, and a dancer by passion. Crazy about wildlife when not hunting stories. Elocution and acting are my second calling. Hungry or not, always an over-zealous foodie

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *