নব্বইয়ের ‘সত্যান্বেষী’, বাদ পড়লেন ব্যোমকেশ
‘সত্যান্বেষী’ বলতে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় সৃষ্ট গোয়েন্দা ব্যোমকেশ বক্সীকেই বোঝায়। ‘গোয়েন্দা’ শব্দটি ব্যবহারে প্রবল আপত্তি ছিল শরদিন্দুর। ‘সত্যান্বেষী’ তাঁরই মস্তিষ্কপ্রসূত শব্দ। অর্থাৎ এমন এক ব্যক্তি যিনি সত্য অন্বেষণ করেন। তবে সত্য উদঘাটন ছাড়াও ব্যোমকেশের কাহিনী তৎকালীন বঙ্গসমাজের এক লিপিবদ্ধ দলিল হিসেবে রয়ে গিয়েছে, যাকে ইংরেজিতে সোশ্যাল কমেন্টরি বলা হয়। কিন্তু অদ্ভুতভাবে, নব্বই দশকের গোড়ার দিকে সম্প্রচারিত ‘সত্যান্বেষী’ টেলিভিশন সিরিজ় থেকে বাদ পড়েছিল ব্যোমকেশ নিজেই। কেন?
১৯৯১ সালে বাংলা সাহিত্যের ছয়জন জনপ্রিয় গোয়েন্দা চরিত্র নিয়ে সীমিত পর্বের একটি সিরিজ়ের চিন্তাভাবনা করছিলেন বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব বিভাস চক্রবর্তী। তিনি সেই সময় দূরদর্শনে কর্মরত। প্রাথমিকভাবে হেমেন্দ্রকুমার রায়ের জয়ন্ত-মানিক, প্রেমেন্দ্র মিত্রের পরাশর বর্মা, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যের হুকাকাশি, নীহাররঞ্জন গুপ্তর কিরীটি রায়, সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা ও শরদিন্দুর ব্যোমকেশকে নিয়ে এই সিরিজ়টি তৈরি করার কথা ভেবেছিলেন তিনি। পঞ্চাশের দশকে একাধিক রহস্য ছবি তৈরি হলেও ফেলুদা ও ব্যোমকেশের মতো জনপ্রিয় গোয়েন্দা চরিত্র তখনও বড়পর্দায় আসেনি। এমনকি প্রেমেন্দ্র মিত্র ‘কালো ছায়া’, ‘হানাবাড়ি’, ‘চুপি চুপি আসে’র মতো ছবি পরিচালনা করলেও পরাশর বর্মাকে কখনও সেলুলয়েডে আনার কথা ভাবেননি। হুকাকাশিও কখনও রূপোলি পর্দার আসেনি।
আরও পড়ুন: ঋষিকে হারিয়ে দিয়েছিলেন রাজেশ?
নীহাররঞ্জনের সেজমেয়ে করবী গুপ্ত একবার সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন যে কীরিটিকে নিয়ে ছবি করার প্রস্তাব নিয়ে স্বয়ং উত্তমকুমার তাঁর বাবার কাছে হাজির হয়েছিলেন। উত্তমকুমারের পরণে চুনোট করা ধুতি, গিলে পাঞ্জাবি। নীহারবাবু তাঁকে দেখে যারপরনাই খুশি। একথা-সেকথার পর ঝুলি থেকে বেড়াল বের করলেন উত্তম। তিনি কিরীটির ভূমিকায় অভিনয় করতে চান। শোনামাত্র মুখ থমথমে হয়ে গেল কিরীটি স্রষ্টার। এক কথায় না করে দিলেন উত্তমকুমারকে। নীহাররঞ্জন মনে করতেন যে কিরীটি চরিত্রটির প্রতি সুবিচার করতে পারতেন একমাত্র অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে অজিতেশেক তিনি এ কথা কোনওদিনও বলেননি। হয়ত চেয়েছিলেন বাংলার নাট্যমঞ্চের এই দাপুটে অভিনেতা নিজেই সেই ইচ্ছা প্রকাশ করুক।
যাই হোক, পরিকল্পনামাফিক কাজ শুরু করলেন বিভাস। সেই সময় লেখকদের মধ্যে সত্যজিৎ ছাড়া কেউ জীবিত নেই। বিশপ লেফ্রয় রোডের বাড়িতে সত্যজিতের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন বিভাস। অনেক অনুরোধ-উপরোধের পর সত্যজিৎ অনুমতি দিলেন ঠিকই, তবে এটাও বলে দিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কেই যেন ফেলুর ভূমিকায় নেওয়া হয়। বিভাসের নিজেরও সৌমিত্রকেই পছন্দ ছিল। কিন্তু বাদ সাধলেন স্বয়ং অভিনেতা। সৌমিত্র তখন পঞ্চাশোর্ধ্ব। প্রস্তাব শুনেই নাকচ করে দিলেন। অবশ্য তার কারণও ছিল। ১৯৮৬ সালে টেলিভিশনের পর্দায় সন্দীপ রায়ের পরিচালনায় ‘সত্যজিৎ রায় প্রেজে়ন্টস’ সিরিজ়ের ‘কিসসা কাঠমাণ্ডু মে’র পর্বে পঞ্চাশোর্ধ্ব স্থুল শশী কাপুরকে দেখেছিলেন দর্শক। সমালোচনার ঝড় উঠেছিল। তবে বিভাস সত্যজিতের উল্লেখ করার পর রাজি হন সৌমিত্র। সত্যজিৎ শর্ত রেখেছিলেন যে চিত্র্যনাট্য আগে তাঁকে দেখিয়ে নিতে হবে। অতঃপর ‘ঘুরঘুটিয়ার ঘটনা’র স্বত্ব পেলেন বিভাস। তোপসে হিসেবে নিলেন ইন্দ্রনীল হালদারকে। নকল কালীকিঙ্করের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন অরুণ মুখোপাধ্যায়।
আরও পড়ুন: ‘মহাভারত’-এর গানে সোনু, প্রকাশ্যে ১৯৮৯ সালের ভিডিও
পরাশর বর্মার স্বত্বের জন্য বিভাসকে বেগ পেতে হয়নি। ‘পরাশর বর্মা ও ভাঙা রেডিও’ গল্পটি নির্বাচন করেন তিনি। পরাশরের চরিত্রে অভিনয় করেন অনুপ কুমার। গল্পের পটভূমি বম্বে (এখন মুম্বই) থেকে পার্ক স্ট্রিটে এনে ফেললেন পরিচালক। পরাশরের সহকারী কৃত্তিবাস ভদ্রর ভূমিকায় ছিলেন অজয় বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘সত্যান্বেষী’তে হেমেন্দ্রকুমারের জয়ন্ত-মানিকের সিরিজ়ের গল্প ‘ব্রহ্মরাজের পদ্মরাগ’-এও ছিলেন অজয়। পুলিশ অফিসার সুন্দরবাবুর চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। জয়ন্ত ও মানিকের ভূমিকায় ছিলেন সন্তু মুখোপাধ্যায় ও অয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলা ভাষায় একমাত্র জাপানি গোয়েন্দার হুকাকাশির চরিত্রে অভিনয় করেন রমাপ্রসাদ বণিক। মনোরঞ্জনের ‘পদ্মরাগ’ গল্পটি বেছেছিলেন পরিচালক। হুকাকাশির সহকারী রণজয়ের জন্য প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত হয়েছিলেন কুশল চক্রবর্তী। পরে অবশ্য দেবাংশু সেনগুপ্ত সেই চরিত্রে অভিনয় করেন। ‘সত্যান্বেষী’ সিরিজ়ের সঙ্গীত পরিচালকও ছিলেন দেবাংশু।
এরপরেই শুরু হলো গোলমাল। কিরীটি রায়ের জন্য বিভাস ভেবেছিলেন রঞ্জিৎ মল্লিকের কথা। সেটা নীহাররঞ্জনের পরিবারকে জানাতেই তাঁরা বেঁকে বসেন। কিরীটি হিসেবে অজিতেশকে দেখার যে ইচ্ছে স্রষ্টার ছিল, তা জানিয়ে তাঁরা বলেন এমন কোনও অভিনেতাকে নিতে, যিনি অজিতেশের সমকক্ষ। মাথায় হাত বিভাসের। ততদিনে ‘সত্যান্বেষী’র সম্প্রচার শুরু হয়ে গেছে। এমতাবস্থায় নতুন করে কিরীটির চরিত্রে অভিনেতা খোঁজা অসম্ভব। কাজেই, সে আশা ছাড়তে হলো।
সেই সময় বিভাস ভেবেছিলেন শরদিন্দুর ব্যোমকেশেরই কোনও কাহিনীকে দুটি পর্বে ভাগ করে সিরিজ়টা শেষ করবেন। ব্যোমকেশের ভূমিকার জন্য বিভাস বেছেছিলেন দীপঙ্কর দে-কে। কিন্তু আবারও বিধি বাম। শরদিন্দুর সব গল্পের স্বত্বাধিকারী ছিলেন প্রবীর চক্রবর্তী। দীপঙ্কের নাম শুনেই তিনি না করে দিলেন।
এবার প্রবল সংকটে পড়লেন বিভাস। ফের সত্যজিতের শরণাপন্ন হলেন তিনি। দুই পর্বে ‘গোলকধাম রহস্য’ সম্প্রচার করার পরামর্শ দিলেন সত্যজিৎ। এদিকে হাতে সময় কম। তড়িঘড়ি কাস্ট ঠিক করা হল। সিধুজ্যাঠার ভূমিকায় এলেন মনোজ মিত্র, নীহার দত্তের চরিত্রে অসিত মুখোপাধ্যায় ও ইন্সপেক্টর বক্সী হলেন শ্যামল ঘোষাল। একাধিক ধারাহবাহিকে ব্যস্ত ইন্দ্রনীলের ডেট পাওয়া গেল না। তোপসে হিসেবে এলেন সম্রাট সেনগুপ্ত।
সিরিজ়ের নামকরণ ‘সত্যান্বেষী’ হলেও, শেষমেশ বাদই রয়ে গেলেন ব্যোমকেশ।