বিনোদনই শেষ কথা

ছবি: মির্জ়া পার্ট ১

পরিচালনা: সুমিত-সাহিল

অভিনয়ে: অঙ্কুশ হাজরা, ঋষি কৌশিক, ঐন্দ্রিলা সেন, কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়, শোয়েব কবির, জ্যামি বন্দ্যোপাধ্যায়, শঙ্কর দেবনাথ, শান্তিলাল মুখোপাধ্যায়

ছবির দৈর্ঘ্য: ২ ঘণ্টা ৪৫ মিনিট

RBN রেটিং ★★★★★★☆☆☆☆

ইদানিংকালের বেশিরভাগ বাংলা ছবিই কোনও না কোনও বার্তা দিতে চায়। সেটা সামাজিক ছবির মোড়কেই হোক, বা রহস্যের মাধ্যমে। তবু বড়পর্দার ছবিতে আজও বিনোদনই শেষ কথা। যতক্ষণ ছবি চলবে, ততক্ষণ আনন্দ, উল্লাস, আবেগে ভেসে যাওয়া। প্রেক্ষাগৃহ থেকে বেরোলেই তো আবার সেই জীবন সংগ্রামে ফিরতে হবে। তাই ঘণ্টা তিনেকের জন্যও যদি সেই দৈনন্দিন লড়াই ভুলে থাকা যায়, ক্ষতি কী? প্রথম ছবিতে সেই পথেই হাঁটলেন পরিচালকদ্বয় সুমিত-সাহিল। তাঁদের ‘মির্জ়া পার্ট ১: জোকার’ (Mirza Part 1: Joker) যাকে বলে পুরো ‘পয়সা উসুল’ ছবি।   



কলকাতার বুকে ক্রমে ডালপালা বিস্তার করছে মাদক পাচার চক্র। শহরকে এই চক্র থেকে মুক্ত করার দায়িত্ব পড়ে তরুণ পুলিশ অফিসার কৌস্তুভ সেনের (ঋষি) ওপর। চক্রের মাথাদের সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে গিয়েই সে জানতে পারে সুলতান (কৌশিক), সুলতানের ছেলে (শোয়েব) এবং মির্জ়ার (অঙ্কুশ) কথা। মির্জ়ার কথা দিয়েই শুরু হয় ছবির কাহিনি। সে নাম করতে চায় না, সম্মান চায়। সেই উদ্দেশ্যে মির্জ়া স্বেচ্ছায় এসে সুলতানের দলে যোগ দেয়। কাজ বুঝে নেওয়ার সময় তার জীবনে আসে মুসকান (ঐন্দ্রিলা)। এদিকে বিভিন্ন দলের মধ্যে দলাদলিতে দর্শকের পরিচয় ঘটে উসমান (জ্যামি) ও মালিকভাইয়ের সঙ্গে (শঙ্কর)। তদন্ত করার সময় কৌস্তুভের পরিচয় হয় প্রাক্তন পুলিশ অফিসার মুর্শিদের (শান্তিলাল) সঙ্গে। কিন্তু প্রশ্ন হলো মির্জা কে? কোত্থেকে সে এল? কী চায় সে?

আরও পড়ুন: ডুংরুতেই ভরসা রাখছেন সন্দীপ রায়

ছবিটি লেখার সময় সুমিত-সাহিল ও চিত্রনাট্যকার অর্ণব ভৌমিক বোধহয় ফেলুদার সেই মশলা ছবি সংক্রান্ত বেদবাক্যটি মাথায় রেখেছিলেন: দেড় ঘণ্টা লাগবে জট পাকাতে, দেড় ঘণ্টা ছাড়াতে। সত্যিই পৌনে তিন ঘণ্টার এই ছবিটির প্রথমার্ধে যতগুলো প্রশ্ন দর্শকের মনে জমা হয়, দ্বিতীয়ার্ধে প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দিতে পরিচালকেরা কসুর করেন না। অর্ণবের লেখা এতটাই টানটান যে মুহূর্তের জন্যও ক্লান্তির উদ্রেক হয় না। প্রতিটি চরিত্রকে প্রয়োজনীয় মাত্রায় জায়গা দিয়েছেন পরিচালকদ্বয়। এমনকী মির্জ়া বা মুসকানের অতীতকাহিনির ব্যাখ্যার দিকেও অনেকটা সময় ব্যয় করেছেন তাঁরা।

কেন্দ্রীয় চরিত্রে অঙ্কুশ (Ankush Hazra) এই ছবিতে নায়কোচিত যা-যা করা সম্ভব, সবকিছুই উজাড় করেছেন। ‘লাভ ম্যারেজ’-এর মতো কমেডি এবং ‘কুরবান’-এর মতো সিরিয়াস ছবির পর অ্যাকশনধর্মী রূপে তাঁকে পর্দায় দেখতে ভালোই লাগে। নায়িকা মুসকানের চরিত্রে ঐন্দ্রিলা (Oindrila Sen) যথাযথ। সাধারণত মশলা ছবির নায়িকাদের দর্শক যেমনভাবে দেখতে অভ্যস্ত, তার চেয়ে একটু অন্যরকম রূপেই ঐন্দ্রিলাকে পাবেন তাঁরা। বাপ-বেটা খলনায়কের ভূমিকায় কৌশিক (Kaushik Ganguly) ও শোয়েব দুর্দান্ত। পরিচালক কৌশিকের ছায়ায় অভিনেতা কৌশিক ঢাকা পড়ে গেছেন, এ অভিযোগ অনেকদিনের। কৌশিক নিজেও নিশ্চয়ই সেটা জানতেন। একেবারে অন্যরকম একটি চরিত্রে খোলস ছেড়ে বেরোলেন তিনি। এছাড়া ক্যামিও চরিত্র কাঞ্চন মল্লিক ও সুমিত গঙ্গোপাধ্যায়কে দেখতে বেশ ভালো লাগে।

আরও পড়ুন: সত্যজিতের আরও দুটি ছবি সংরক্ষণের কাজ শুরু

উসমানের চরিত্রে জ্যামি এবং সুলতানের দলের সরকারি লোক মালিকভাইয়ের ভূমিকায় শঙ্কর তাঁদের পক্ষে যতটা দেওয়া সম্ভব সবটুকুই দিয়েছেন। আশ্চর্যজনকভাবে আড়ষ্ট লাগে ঋষি কৌশিককে (Rishi Kaushik)। পুলিশ অফিসার হিসেবে তাঁর থেকে অনেক প্রত্যাশা থাকলেও তা পূরণ হয় না। মির্জ়ার অতীতে বড় ভূমিকা নেওয়া অফিসার মুর্শিদ শেখের চরিত্রে শান্তিলাল দুর্দান্ত। এছাড়া, ছবিতে মির্জ়ার সঙ্গে যে শিশুশিল্পীদের ব্যবহার করা হয়েছে, তাদের প্রত্যেকের পর্দায় উপস্থিতি অত্যন্ত ভালো।

গানের থেকেও এই ছবিতে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল আবহ। সেই আবহ নির্মাণে সম্পূর্ণ সফল অনীক ধর ও ঈশান মিত্র। অনিমেষ ঘোড়ুই চিত্রগ্রহণের কাজ যথাযথভাবে সামলালেও পোস্ট-প্রোডাকশনের সময়ে ছবির ভিএফএক্সে আরও একটু মনোযোগ দেওয়া উচিত ছিল। কোনও-কোনও উদ্যত হাতে মলোটভ ককটেলের শিখা না জ্বললে বা জ্বলন্ত কারখানার আগুন আরও একটু বিশ্বাসযোগ্য হলে ছবির গুণগত মান আরও বাড়ত সন্দেহ নেই। সংলাপ ভৌমিক সম্পাদনায় আরও একটু যত্নবান হতে পারতেন। কয়েকটি জায়গায় হঠাৎ করেই দৃশ্য কাট হয়ে যাওয়া চোখে লাগতে পারে।



তবে এই ছবিতে যার অভাব নেই, তা হলো বিনোদন। পরিচালকদ্বয় ভালো করেই জানেন এই ধরনের ছবিতে কী-কী ব্যাপার দর্শকের পক্ষে অনায়াসে অনুমান করে ফেলা সম্ভব। তাই সেগুলোকে সহজভাবে দেখিয়ে তার সঙ্গে তাঁরা কাহিনিতে যে মোচড়গুলি এনেছেন তা প্রশংসার দাবি রাখে। মশলা ছবির চিরাচরিত ফর্মুলা ভেঙে নায়িকা এখানে ড্যামজ়েল ইন ডিসট্রেস নয়, বরং রীতিমতো রণংদেহী।

ছবির ব্যবসায়িক সাফল্য যে টিম ‘মির্জ়া’র কাছে ততটাও গুরুত্বপূর্ণ নয়, তা পরিষ্কার হয়ে যায় যখন এই ছবির মধ্যেই তাঁরা অন্ততপক্ষে সাত মিনিট সময় নেন দ্বিতীয় ভাগ ‘টাইগার’-এর সঙ্গে দর্শককে পরিচয় করিয়ে দিতে। কয়েকটি সূত্রও তাঁরা রেখে যান পরবর্তী পর্বের জন্য দর্শককে আগ্রহী করে তুলতে।

যাঁরা পর্দায় বিভিন্ন ঘটনার যুক্তি খুঁজতে যান, এ ছবি তাঁদের জন্য নয়। কিন্তু তিন ঘণ্টা ভরপুর বিনোদন পাওয়াই যদি কারও উদ্দেশ্য হয়, তাহলে মির্জ়া প্রেক্ষাগৃহে দেখে আসাই যায়।




Like
Like Love Haha Wow Sad Angry
1

Diptajit

An avid reader and a passionate writer of crime fiction. Poems and verses are his second calling. Diptajit is the editor of a Bengali magazine. Nothing makes him weaker than books, films and food

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *