ফেলুদার ছায়ায় জম্পেশ গোয়েন্দাগিরি চারুলতার

সিরিজ়: ডিটেকটিভ চারুলতা

পরিচালনা: জয়দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়

অভিনয়ে: সুরাঙ্গনা বন্দ্যোপাধ্যায়, অনুজয় চট্টোপাধ্যায়, মল্লিকা মজুমদার, দেবমাল্য গুপ্ত, পায়েল কাঞ্জিলাল, চৈতি ঘোষাল, মানস মুখোপাধ্যায়

পর্ব সংখ্যা: পাঁচ

RBN রেটিং ★★★★★★☆☆☆☆

বাঙালি গোয়েন্দা মানেই কিছু বিশেষ গুণ থাকা অবশ্য প্রয়োজন। অন্তত বাঙালি এমন হলেই খুশি হয় আর কী! বাঙালি গোয়েন্দাকে শখের গোয়েন্দাগিরি করতে হবে। পুলিশ ডিপার্টমেন্ট তাকে বেশ সমঝে চলবে। কারণ পুলিশ যা খুঁজে পায় না সেই সবকিছু এই গোয়েন্দারা খুঁজে পেয়ে যায়। আর সর্বশেষ গুণ হলো তাকে ফেলুদার ভক্ত হতে হবে। প্রয়োজনে ফেলুদার সবকিছু নকল করে ফেলতে হবে। অন্তত গল্পে ফেলুদার একটু ছোঁয়া না থাকলে ঠিক যেন গোয়েন্দা হয়ে ওঠা যায় না। এই সিরিজ় তার ব্যতিক্রম তো নয়ই, বরং তার চেয়েও এক কাঠি এগিয়ে রয়েছে। কাহিনিসূত্রে ঢোকার আগে এই নতুন ডিটেকটিভের পরিচয় দেওয়া যাক।



চারুলতা ক্রিমিনাল সাইকোলজিতে গোল্ড মেডালিস্ট। কিন্তু সে চাকরি বা পড়াশোনা কোনওকিছুতেই আগ্রহ না দেখিয়ে আপাতত শখের গোয়েন্দাগিরি করে বেড়াচ্ছে। তার বাসস্থান কাকার বাড়ি। বাবা-মা গত হয়েছেন অনেক আগেই। ঠিক ফেলুদার মতোই। কাকা-কাকিমার একমাত্র ছেলে তপুই হলো চারুলতার অ্যাসিস্ট্যান্ট। অর্থাৎ তোপসের মিনি-কপি। কাকা চারুলতার কেরিয়ার এবং বিয়ে নিয়ে একটু ব্যস্ত হলেও কাকিমা বেশ প্রশ্রয়ের চোখেই দেখেন ভাসুরঝির এই গোয়েন্দাগিরিকে। দেদার স্বাধীনতাও দেন। এখানে অবশ্য ফেলুদার একেবারে উল্টো, সেখানে প্রশ্রয় কাকা দিতেন।

আরও পড়ুন: বিশিষ্ট বাঙালির চরিত্রে সইফ, শুটিং শুরু শীঘ্রই

চারুলতা ধূমপান করে, তবে বর্তমানে ছেড়ে দিতেই চাইছে, এবং সে কারণে-অকারণে তার আশেপাশের সবাইকে নিয়ে নানারকম তদন্ত চালিয়েই যায় এবং সেই নিয়ে ভাই তপুকে জ্ঞান দিতেও ভোলে না। এক্কেবারে ফেলুর লেডি সংস্করণ যাকে বলে! আর চারুলতা এখনও অবধি যেসব কেসের সমাধান করেছে সেগুলো জুটেছে তারই এক দিদি, পুলিশের উচ্চ-আধিকারিক সিদ্ধেশ্বরী বসুর বিশেষ প্রশ্রয়ে। এই দিদিকে চারুলতা ডাকে সিধুদি (জ্যাঠা নয়) বলে! ও হ্যাঁ, চারুলতার পুরো নাম চারুলতা মিত্র।

Detective Charulata

শখের গোয়েন্দা চারুলতা (সুরাঙ্গনা) এক নতুন একজন ম্যানেজার নিয়োগ করে তার ওয়েবসাইট ইত্যাদি সামলানোর জন্য। সেই ম্যানেজার ম্যাডির (পামেলা) সূত্রে জানা যায় তন্ত্রবিদ পরমা সেন (চৈতি) তার সমস্যা সমাধানের জন্য একজন গোয়েন্দা খুঁজছেন। কী সমস্যা? পরমা জানান তিনি আর কিছুদিন পরেই মারা যাবেন, এটা তিনি তন্ত্রবলে জেনেছেন। তার ছেলে আদিত্য দিনের পর দিন এক জঘন্য অপরাধ করে যাচ্ছে যা আটকানোর দায়িত্ব তিনি চারুলতাকে দিয়ে যেতে চান। যদিও তিনি বলে দেবেন না তার ছেলের অপরাধ কী, তবে তদন্তের পারিশ্রমিক স্বরূপ তিনি চারুলতার নামে ব্ল্যাঙ্ক চেক লিখে দিয়ে যান।

আরও পড়ুন: নারীর মানসিক দৃঢ়তাকে শ্রদ্ধাঞ্জলি

অদ্ভুতভাবে সেই নির্দিষ্ট দিনেই পরমা মারা যান। পুলিশের দ্বারা বিশেষ সুবিধে করে ওঠা সম্ভব হয় না বলে সিদ্ধেশ্বরী কেসটি চারুলতার হাতে সঁপে দেন। তদন্তে সাহায্য করার জন্য সঙ্গে থাকেন ইন্সপেক্টর অরিন্দম লস্কর (অনুজয়)। অনুসন্ধান করতে গিয়ে চারুলতা বুঝতে পারে শহরে যে একের পর এক খুন হয়ে চলেছে সেগুলো সবই একজন লোকের কীর্তি। অর্থাৎ সিরিয়াল কিলিং! সেই সিরিয়াল কিলার আবার খুনগুলো করছে বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন গল্প-উপন্যাস থেকে পাওয়া খুনের প্রক্রিয়ায়। বিচিত্র এই সাহিত্যপ্রেমী সিরিয়াল কিলারকে খুঁজতে চারুলতার প্রায় নাজেহাল অবস্থা হয়, যদিও সূত্র মেলে সেই ফেলুদার মধ্যেই। 

আরও পড়ুন: বড়পর্দা থেকে নাটকের মঞ্চে ‘সপ্তপদী’

কাহিনিকার সৌমিত দেব ফেলুদা এবং সত্যজিৎ রায়কে মাথায় রেখেই গল্প লিখেছেন সেটা বোঝা যায়। অতিরিক্ত ফেলু ট্রিবিউট কিছুটা একঘেয়েমি এনে দেয় ঠিকই কিন্তু রহস্য এবং খুনের মোডাস অপারেন্ডি বা পদ্ধতি বেশ অভিনব তাতে সন্দেহ নেই। খুনের কারণ হিসেবে তিন দশক আগের যে ঘটনাকে ট্রিগার হিসেবে দেখানো হয়েছে তাও যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত। সেই প্রাচীন অপরাধীর ছদ্মবেশে খুন করার মধ্যেও রয়েছে অভিনবত্ব।

Detective Charulata

জয়দীপের পরিচালনায় যথেষ্ট স্মার্টনেস রয়েছে ঠিকই কিন্তু কিছু ছোটখাটো ত্রুটি থেকেই গিয়েছে। একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ যিনি নিজের কাজ নিয়ে অত্যন্ত সিরিয়াস, এই যুগের মেয়ে হয়েও কেরিয়ার বিসর্জন দিয়ে অপরাধীর পিছনে ছুটছেন, তিনি ম্যানেজার নিয়োগের ক্ষেত্রে এত অসাবধানী হন কী করে! কোনওরকম ব্যাকগ্রাউন্ড চেক না করেই কাউকে নিজের সমস্ত তথ্য দিয়ে দেওয়া খুব একটা বুদ্ধির পরিচয় দেয় না। এছাড়া চারুলতার কাকা ললিতমোহন নামের একটি ছেলের সঙ্গে তার বিয়ে ঠিক করেন। সাধারণ বাঙালি সমাজে যা বেশ অদ্ভুত একটা ব্যাপার। কোনও বিশেষ কারণ ছাড়া অবাঙালি পাত্রের হাতে নিজের কন্যাসমা ভাইঝিকে তিনি কেন তুলে দিতে চান স্পষ্ট হয় না।

আরও পড়ুন: আবারও একসঙ্গে জন-অক্ষয়?

পাঁচ এপিসোডের ঘটনাক্রমে যথেষ্ট আভাস দিয়েও মৃত শরীর থেকে অঙ্গ পাচার কাণ্ডের কোনও সুরাহা করাই হলো না। ধরে নেওয়া যায় আগামী সিজ়নের জন্য এই গল্পকে তুলে রাখা হলো। কিন্তু তা হলেও অন্তত আরও কিছুটা গভীরে যাওয়া যেতে পারত। গল্পের ওই পর্যায় ধোঁয়াশায় ঢেকে রইল। চারুলতার এন্ট্রি সিন হোক বা পরবর্তী অ্যাকশন দৃশ্য, সুরাঙ্গনা যথেষ্ট চেষ্টা করলেও খামতি থেকে গিয়েছে। ফাইট সিনের কোরিওগ্রাফিতে আরও গতির প্রয়োজন ছিল।



চারুলতার ভূমিকায় সুরাঙ্গনা দারুণ মানিয়ে গিয়েছেন। পরবর্তী সিজ়ন আসবে আশা রাখা যায়। তেমন হলে এক নতুন মহিলা গোয়েন্দা পাবে বাঙালি দর্শক। তবে ফেলুদার ছায়ায় অতিরিক্ত ঢেকে থাকলে আলাদা পরিচিতি তৈরি করা কঠিন হবে চারুলতার পক্ষে। তবু ফেলুদায় ডুবে থাকা চারুলতার ভূমিকায় সুরাঙ্গনা সফল। আগাগোড়া তাঁর অভিনয় গল্পের গতিকে মোলায়েমভাবে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে। তপুর ভূমিকায় দেবমাল্য সাবলীল। পামেলাও তাঁর ভূমিকায় যথাযথ। মল্লিকা দক্ষ অভিনেত্রী। তাঁকে অন্যরকম চরিত্রে দেখতে ভালো লেগেছে। ছোট্ট চরিত্রে চৈতি দাপুটে অভিনয়ের সাক্ষর রেখেছেন। বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় মানসের কথা। কাহিনি ক্রমশ এগোনোর সঙ্গে-সঙ্গে নিজেকে মেলে ধরার সুযোগ পেয়েছেন তিনি। তবে আফসোস রয়ে গেল অনুজয়ের মতো অভিনেতা এত কম জায়গা পেলেন বলে। আরও কিছুটা পরিসর তাঁকে দেওয়া যেতে পারতো। অরিন্দমের চরিত্র লেখার সময়ে সেভাবে যত্ন নেননি চিত্রনাট্যকার।

প্রতি পর্বের চিত্রগ্রহণ যথাযথ। তিন দশক আগের ঘটনার দৃশ্যকল্প বেশ নাটকীয় লেগেছে। সিরিজ়ের আবহ গল্পের সঙ্গে মানানসই। সব মিলিয়ে বেশ বুদ্ধিদীপ্ত সিরিজ় বলা চলে। হাতে বেশ কিছুটা সময় থাকলে হাল্কা মেজাজে কফি আর স্ন্যাক্স নিয়ে বসে পড়লে ‘ডিটেকটিভ চারুলতা’ (Detective Charulata) নিরাশ করবে না। 




Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Swati

Editor of a popular Bengali web-magazine. Writer, travel freak, nature addict, music lover, foody, crazy about hill stations and a dancer by passion. Burns the midnight oil to pen her prose. Also a poetry enthusiast.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *