‘আমার শিক্ষাগুরু ঋত্বিক ঘটক, কর্মগুরু তপন সিংহ’

‘আপনজন’ ছবি দিয়ে আত্মপ্রকাশের পরে ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’, ‘আলো ছায়া’, ‘সাগিনা মাহাতো’, ‘আলোর ঠিকানা’, ‘সবুজ দ্বীপের রাজা’, ‘ধন্যি মেয়ে’ ও আরও অজস্র ছবিতে বাঙালির চিরচেনা অভিনেতা তিনি। আজকের প্রজন্ম তাঁকে জেনেছে ‘কাহানি’ দেখে। কিছুদিন আগেই অভিনয় করেছেন ‘শেষের গল্প’ ছবিতে। সাদাকালো ছবির জগতের সেই পাড়ার ছেলের ইমেজ থেকে, উত্তমকুমার-সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের তুলনা কিংবা দিলীপকুমার প্রসঙ্গ থেকে আজকের বাংলা ছবির অবস্থা, সবকিছু নিয়ে রেডিওবাংলানেট-এর সঙ্গে খোলামেলা আড্ডা দিলেন তপন সিংহ থেকে শুরু করে সুজয় ঘোষের ছবির অভিনেতা কল্যাণ চট্টোপাধ্যায়।

সেই ষাটের দশক থেকে ছবিতে কাজ করছেন আপনি। বাংলা ইন্ডাস্ট্রির কি কি পরিবর্তন দেখলেন?

বাংলা ছবিতে পেশাদারিত্ব চিরকালই কম। তবু আগে যে যার কাজটা নিজে করতেন। আজকাল একে অন্যের কাজে নাক গলায়। প্রযোজক নিজেই চিত্রনাট্য লিখছেন, গানের ক্ষেত্রেও তিনিই নাক গলাচ্ছেন। আগে তো প্রযোজক ফ্লোরেই আসতেন না। এখন বুঝুন না বুঝুন, সব ব্যাপারে তাঁদের মতামত দেওয়াটাই নিয়ম।




সাদাকালো ছবির না কি হালের ওয়েব সিরিজ়ের যুগ, কোন প্রজন্মের সঙ্গে কাজ করতে আপনি বেশি স্বচ্ছন্দ?

অবশ্যই আগে বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করতাম। তখন একটা দিন সবাইকে ডেকে চিত্রনাট্য পড়ানো হত। তপনদা এটা করতেন। আরও অনেকেই করতেন। পুরো ব্যাপারটা খুব নিয়ম মাফিক হত। এখন অনেকের মধ্যেই সেই কনফিডেন্স দেখি না। এখন তো ঘটনাভিত্তিক ছবি বেশি হচ্ছে। ফলে মাঝেমধ্যে চিত্রনাট্যও বদলায়। কিন্তু তখন অনেক আগে তৈরি চিত্রনাট্য আমরা হাতে পেতাম। পরিচালক আমাদের সঙ্গে আলোচনা করতেন ছবি সংক্রান্ত বিষয়ে। এডিটিংয়ের দিন থেকে ছবি রিলিজ়ের দিন, সবই আমাদের জানানো হত। এখন তো পুরো ব্যাপারটাই অনেক জটিল হয়ে গেছে। একটা হলে ছ’টা ছবি চলছে একই সঙ্গে। তাই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমাদেরকেও পাল্টাতে হচ্ছে।

আপনার প্রথম ছবি তো ‘আপনজন’। কি ভাবে সুযোগ পেয়েছিলেন সেখানে?

আমি পুনে ফিল্ম ইন্সটিটিউট থেকে পাশ করি ১৯৬৭-এ। ‘আপনজন’ নয়, প্রথম কাজ করি একটি অসমীয়া ছবিতে। দেবকী বসুর ছেলে দেবকুমার বসু ছিলেন পরিচালক। নিপন গোস্বামী, অসমীয়া ছবির অভিনেতা ও আমার বন্ধু, আমাকে অভিনয়ে নিয়ে আসে। এরপরে বাংলায় প্রথম ছবি ‘আপনজন’। আমি তো দিল্লীর ছেলে। বাবা ওখানে চাকরি করতেন, আমার পড়াশোনাও দিল্লীতে। তার আগে গোয়ালিয়রে ও দুন স্কুলেও পড়েছি। অভিনেতা না হলে আমি এয়ারফোর্সে যেতাম। কিন্তু অভিনয়ে চলে এলাম। তখন তো বম্বেতে তিন নায়ক। দেব আনন্দ, দিলীপকুমার আর রাজে কাপুরের যুগ। আমি অনুপ্রাণিত হই দিলীপকুমারকে দেখে।

আরও পড়ুন: এবার মার্কিন মুলুকে দৃষ্টিহীন চিত্রকরের কাহিনী

উত্তমকুমারের সঙ্গে অনেক ছবিতে কাজ করেছেন আপনি। কাছ থেকে দেখে কেমন লাগত তাঁকে?

উত্তমকুমার সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার নেই। সবাই সব জানেন। তবে ওঁকে আমি অন্যভাবে চিনতাম। অনিল চট্টোপাধ্যায় ছিলেন আমার নিজের ছোটকাকা। সেই সূত্রে উত্তমকুমার আগে থেকেই আমাকে চিনতেন। তাই একটা আলাদা স্নেহ ছিলই। উত্তমকুমার খুব ভালোবাসতেন ছোটকাকাকে। আর ওনাকেই একমাত্র উনি ‘তুই’ বলে সম্বোধন করতেন। বাকি সকলকে ‘তুমি’ বলতেন।

বাঙালির চিরকালের প্রিয় তর্কের বিষয় উত্তম বনাম সৌমিত্র। আপনি কোন পক্ষে?

অবশ্যই উত্তমকুমার। উনি সবকিছু পারতেন। সৌমিত্রদার একটা পেশাদারী ইমেজ ছিল। কমেডি ভালো পারতেন না। নাচও পারতেন না। যদিও তখন নাচের যুগ আসেনি, তবু উত্তমদা প্রয়োজনে সেটাও করেছেন। আর গানে লিপ দেওয়ার ব্যাপারে আমি আর কি বলব, সকলেই জানে উত্তমদা কেমন ছিলেন। সেখানে হেমন্ত আর উত্তম মিশে যেতেন। আলাদা করা যেত না। তবে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দুজনেই অনেক ভালো চরিত্র পেয়েছেন, উত্তমদা অসাধারণ অভিনয় করে গেছেন সেই সব রোলে। আর এখন সৌমিত্রদাও ভাল চরিত্র পেয়ে দারুণ অভিনয় করছেন।

আরও পড়ুন: জনপ্রিয় মেগা-ধারাবাহিকে স্টেপ ইন সৌরভের

তপনবাবুর সঙ্গে তো আপনি প্রচুর ছবি করেছেন। ওঁর সম্পর্কে আপনার অভিজ্ঞতা কেমন?

আমি সবসময় বলি আমার শিক্ষাগুরু ঋত্বিক ঘটক। পুনেতে যখন ফিল্ম স্টাডিজ় পড়ছি তখন উনি ওখানে ভাইস প্রিন্সিপাল ও আমার প্রোফেসর ছিলেন। অভিনয় জীবনে আমার কর্মগুরু ছিলেন তপনদা। প্রায় বারো-চোদ্দটা ছবি ও টেলিফিল্মে তপনদার সঙ্গে কাজ করেছি। বড় বড় স্টারদের সঙ্গেও কাজ করেছি ওঁর সূত্রেই। ওনার সঙ্গে কাজ করা মানে পুরোটাই শেখা।

স্টারের প্রসঙ্গে আসা যাক তাহলে। দিলীপকুমার তো আপনার প্রিয় অভিনেতা ছিলেন। তাঁর সঙ্গে ‘সাগিনা মাহাতো’তে আপনি কাজ করেছেন। কেমন ছিল সেই অভিজ্ঞতা?

দুর্দান্ত। আমাকে অনিলের ভাইপো বলে খুব স্নেহ করতেন উনি। কার্শিয়ংয়ে একসঙ্গে শ্যুটিং করেছি অনেকদিন। দিলীপকুমার খুব ভালো ক্রিকেট খেলতেন। আমি মাঝে মাঝে ওনাকে কপি করতাম। সেই দেখে আমাকে বলতেন, ‘শালা, তুম মেরা নকল মারতা হ্যায়?’ একদিন একটা দামী কথা বলেছিলেন আমাকে। তখন তিনধরিয়া লুপে শ্যুটিং করছি আমরা। আমাকে ডেকে বললেন, ‘তোমাকে একটা কথা বলছি দাদা হয়ে, বা তোমার কাকার বন্ধু হয়ে, কথাটা মনে রেখো। সবসময় তাদের সঙ্গেই মিশবে যারা তোমার কাজকে আরও উন্নত করবে, আর যারা তোমার চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান।‘ তখন এই কথাগুলোর মানে না বুঝলেও পরে বুঝতে পেরেছিলাম। এখন তো উনি খুবই অসুস্থ, শুনলে খুব খারাপ লাগে।

আরও পড়ুন: বিশ্বনাথের বারাণসী, বারাণসীর বিসমিল্লাহ

সেই সময়টায় আপনি যে সব ছবিতে অভিনয় করেছেন, তা সে ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ হোক বা ‘আপনজন’ কিংবা ‘এখনই’, আপনার অভিনীত চরিত্রগুলো মোটামুটি একই ধাঁচের হত। পড়াশোনা করেও চাকরি না পেয়ে অন্যভাবে বাঁচার চেষ্টা করা এক বিদ্রোহী যুবক। আপনি নিজের জীবনে কি এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন কখনও?

এটা ঠিক যে আমার একটা অ্যাংরি ইয়াং ম্যান ইমেজ তৈরি হয়ে গিয়েছিল সেই সময়। তবে আমি জীবনেও চাকরি করিনি। দরকার পড়েনি। তখন একের পর এক ছবি করছি। আমার প্যাশন বা প্রোফেশন যাই বলো, সবই ছিল ওই অভিনয়। অল্প কিছু নাটকেও অভিনয় করেছি। শ্যামানন্দ জালানের পরিচালনায় বাদল সরকারের নাটক ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’-এ নাম ভূমিকায় অভিনয় করতাম আমি। হিন্দীতে হয়েছিল নাটকটা। ইংরেজি নাটকও করেছি, তবে সেও অল্পই। সময় ছিল না তখন।  

‘কাহানি’র প্রসঙ্গে আসি। আপনাকে এই প্রজন্মের অনেকেই চেনেন ‘কাহানি’র অভিনেতা হিসেবে। কীভাবে পেলেন ওই চরিত্রটা?

আমার সঙ্গে সুজয়ের আগে আলাপ ছিল না। ওর একটা বাড়ি আছে হরিশ মুখার্জী রোডে। সেখানে আমাকে একদিন ডেকেছিল। শাশ্বতও (চট্টোপাধ্যায়) ওখানে ছিল সেদিন। আমাকে দুটো লাইন ব্রিফ করেছিল সুজয়। তারপর বলল, ‘তোমাকে এটা করতেই হবে।’ এইভাবেই হয়ে গেল। ছবিটা যে কেমন হয়েছিল সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। নওয়াজ়উদ্দিন সিদ্দিকী তো ওই ছবির পরেই বিখ্যাত হয়ে গেল। তার আগে তো ও সেভাবে সুযোগই পায়নি।




আপনার নিজের করা চরিত্রগুলোর মধ্যে এখনও অবধি সবচেয়ে কঠিন ছিল কোনটা?

সুজিত গুহর প্রথম ছবি, রামকৃষ্ণকে নিয়ে। সেখানে আমি গদাইয়ের চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম। ছবিটা সুপারহিট হয়েছিল। আমার খুব কঠিন লেগেছিল এই চরিত্রটা। একটা টাইপের চরিত্র করে এসেছি আমি, সেই ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ বা ‘আপনজন’-এর ওরকম ইমেজের পরে সম্পূর্ণ আলাদা একটা চরিত্রে ঢোকা নিয়ে আমার মনে সংশয় ছিল। বাকি কোনও চরিত্র তেমন কঠিন লাগেনি কখনও। কিছুদিন আগে একটা ছবিতে রামকৃষ্ণর চরিত্রে কাজ করলাম। বিশ্বনাথ (বসু) নরেন হয়েছিল। এই ধরণের কাজগুলো আমার বেশ কঠিন লেগেছে। বাকি কোনও ছবি করতে গিয়ে কখনও মনে হয়নি যে এটা পারব না বা ওটা কঠিন।

সদ্য ‘শেষের গল্প’ করলেন। আগামী দিনে আর কোন কাজ করছেন? টেলিভিশনে কিছু করছেন কি?

কিছুদিন আগে অভীক মুখোপাধ্যায়ের একটা ছবি করলাম। তবে টেলিভিশনে কাজ করব না আর। ওখানে কোনও মোটিভেশন নেই, দিনের পর দিন একই গল্প টেনে নিয়ে যায়। একঘেয়ে লাগে। শেষ ধারাবাহিক করেছি ‘সিঁদুরখেলা’। তারপর আর ইচ্ছে করেনি করতে।

বর্তমানে বাংলা ইন্ডাস্ট্রিতে প্রচুর কাজ হচ্ছে। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই নতুন ছবি আসছে। কিন্তু খুব কম ছবিই মনে দাগ কাটতে পারছে। এটা কেন হচ্ছে বলে আপনার মনে হয়?

হ্যাঁ, অজস্র ছবি, অথচ একটাও ভালো নয়। কারণ শুধু টাকা দিয়ে ছবি হয় না। এখন ইন্ডাস্ট্রিতে টাকার জোগান আছে, কিন্তু ছবিটা কিভাবে করতে হবে সেটাই কেউ জানে না। আমি এই ছবিগুলোকে বলি শুক্রবারে আবিষ্কার, সোমবারে পরিস্কার। একটা গল্পকে ভালো ভাবে প্রেজ়েন্ট করতে পারার ক্ষমতা লাগে। নন্দিতা রায়-শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়, অঞ্জন দত্ত এদের কাজ অনেক পরিণত। আরও কয়েকজন আছেন। অঞ্জন যেমন জানে কোন বিষয়টা নিয়ে ও ভালো ছবি করতে পারবে। পরিস্কার চিন্তাভাবনা নিয়ে কাজ করলে ছবিটাও ভালো হবে, আগে যে ব্যাপারটা ছিল। প্রত্যেকে নিজের জায়গাটা জানত—আমি এই ধরণের ছবি করতে পারি—সেটাই করব। এখান ওখান থেকে নকল করে, অন্য ভাষার ছবি থেকে টুকে বা যে কোনও বিষয়ে ছবি করে ফেললাম, এই পাকামিটা ছিল না বলেই তখন ভালো ছবি হত।

ছবি: রাজীব মুখোপাধ্যায়

Amazon Obhijaan



Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Swati

Editor of a popular Bengali web-magazine. Writer, travel freak, nature addict, music lover, foody, crazy about hill stations and a dancer by passion. Burns the midnight oil to pen her prose. Also a poetry enthusiast.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *