নস্টালজিয়া ছাড়া আর কোনও প্রাপ্তি নেই
ছবি: যমালয়ে জীবন্ত ভানু
পরিচালনা: কৃষ্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায়
অভিনয়ে: শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়, অম্বরীশ ভট্টাচার্য, শুভাশিস মুখোপাধ্যায়, সাহেব চট্টোপাধ্যায়, সন্দীপ ভট্টাচার্য, পরান বন্দ্যোপাধ্যায়, দর্শনা বণিক, দেবলীনা দত্ত, বাসবদত্তা চট্টোপাধ্যায়
দৈর্ঘ্য: ২ ঘন্টা ৯ মিনিট
RBN রেটিং:★★★★★☆☆☆☆☆
বাংলা ছবি বা বলা ভালো ভারতীয় ছবিতে শুধুমাত্র অভিনেতা বা অভিনেত্রী হিসেবে একজন শিল্পীর বিচার হয় না। বিচার হয় তাঁর অভিনীত একাধিক চরিত্রের ধরনের হিসেবে। যেমন নায়ক, নায়িকা, খলনায়ক এবং কৌতুকাভিনেতা। মুশকিল হচ্ছে কৌতুকাভিনয় সম্ভবত সবচেয়ে কঠিন অভিনয়ের ফর্ম। তবু যুগ-যুগ ধরে কমেডিয়ানরা কমেডিয়ানই থেকে যান, অভিনেতা হয়ে ওঠা হয় না তাঁদের। এই আক্ষেপ যেমন এ যুগের শিল্পী অম্বরীশ বা শুভাশিসের রয়েছে তেমনই সে যুগে সম্ভবত স্বয়ং ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়েরও ছিল, কারণ এ আক্ষেপ চিরকালীন। সেই সব কৌতুক অভিনেতাদের এক জায়গায় নিয়ে এসেই কৃষ্ণেন্দু বানিয়েছেন ‘যমালয়ে জীবন্ত ভানু’ (Jamalaye Jibonto Bhanu)। বায়োপিক না হয়েও ভানু এখানে এক আলাদা চরিত্র, যাকে ছাড়া এ গল্প অচল।
দুই সাম্যময় বন্দ্যোপাধ্যায় একইসঙ্গে পর্দায়, ব্যাপারটা বেশ মজার। সাম্যময় অর্থাৎ ভানু স্বয়ং। সেই নাম তিনি পেশার ক্ষেত্রে ব্যবহার করেননি। আবার অম্বরীশও এখানে সাম্যময়। সে এক বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক। শোনা যায় ভানু নিজে সত্যেন্দ্রনাথ বসুর প্রিয় ছাত্র ছিলেন। যাই হোক, এ যুগের সাম্যময় এবং তার নতুন আবিষ্কার টাইম মেশিন যার নাম জাতিস্মর, সেই নিয়েই এ ছবির গল্প। এক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় সাম্যময়ের এবং স্বর্গে গিয়ে তার দেখা হয় কিংবদন্তী ভানুর সঙ্গে। ইন্দ্রের সঙ্গে বিশেষ যোগসাজসে যার বয়স এখনও পঞ্চাশ, কারণ উর্বশী-রম্ভা-মেনকাদের এখনও নৃত্যশিক্ষা সম্পূর্ণ হয়নি। অর্থাৎ সেই ‘হাম হাম গুড়ি গুড়ি’ নাচ শেখানো এখনও চলছে। স্বর্গে আর এক বাঙালিকে পেয়ে উচ্ছ্বসিত ভানু রাজি হয়ে যান সাম্যময়ের সঙ্গে তার টাইম মেশিনের ভরসায় অতীতে পাড়ি দিতে।
অবশ্য এর পরেও গল্প আছে। সেটাই মূল গল্প। তবে প্রথমার্ধের বেশিরভাগ সময়টাই কাটবে বিভিন্ন ছবিতে অভিনেতা ভানুর ভূমিকা দেখে কারণ এটাই এ ছবির একমাত্র ইউএসপি।
আরও পড়ুন: অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে ফারুকী, তৈরি করবেন তথ্যচিত্র
ছবির কাহিনি খুব আঁটোসাঁটো না হওয়ায় চিত্রনাট্য যথেষ্ট দুর্বল। সবথেকে বেশি কানে লাগে পূর্ববঙ্গীয় উচ্চারণ। ভানুর উচ্চারণ—তাঁকে যারা জানেন তাদের—কানে বাজে। এখানেই তুখোড় অভিনেতা হয়েও কিঞ্চিৎ হোঁচট খেয়েছেন শাশ্বত। ওপার বাংলার উচ্চারণ তাঁর মুখে শুনতে সাবলীল লাগে না। যেহেতু যে কোনও ভাষার বিশেষ উচ্চারণ অনেকটাই বলার অভ্যাস, স্বাভাবিক ছন্দ ও বিশেষ কিছু ঝোঁকের ওপর নির্ভর করে, তাই নতুন শিখে বলতে গেলে সেই মোলায়েম গতি আসা সম্ভব নয়। সেটাই কানে লাগে। শাশ্বত তবু অনেকটাই নিজের অভিনয় দক্ষতায় সামলে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন কিন্তু অন্যান্য অভিনেতাদের মুখে রীতিমতো বেমানান লেগেছে এই বিশেষ উচ্চারণ।
আরও পড়ুন: হরর-কমেডি সিরিজ়ে ৩ ভূতের রোজনামচা
এছাড়াও চিত্রনাট্যের বেশ কিছু জায়গায় যুক্তির অভাব স্পষ্ট। সাম্যময়ের বাড়িতে সাংবাদিক সম্মেলনে তার সহকারী ছাড়া আর কেউ উপস্থিত নেই। কোনও বিখ্যাত মানুষ এভাবে সাংবাদিক বৈঠক করেন না। এছাড়া গাড়ি দুর্ঘটনার জায়গাও খুবই অদ্ভুত, কারণ তিন রাস্তার মোড়ে বন্ধ গাড়ি রেখে কেউ চলে যায় না। অন্তত একপাশে সরিয়ে রাখে। ইন্দ্রের সভায় মোবাইল ফোনে ভানুর ভিডিয়ো তোলাও মনে প্রশ্ন জাগায়, ভানুর কাছে মোবাইল এল কী করে। তিনি সাম্যময়ের থেকে সেটি নিয়েছেন, কোথাও এমন দেখানো হয়নি। এছাড়াও বর্তমানকালের কোনও বিখ্যাত মানুষের মৃতদেহ কাঠের চুল্লিতে পোড়ানো হচ্ছে, অন্তত শহর কলকাতায় এ একেবারেই অবাস্তব।
তবে সবথেকে কানে লাগে ‘সাড়ে চুয়াত্তর‘ ছবির মালপোয়া খাওয়ার দৃশ্যে নিচ থেকে ‘কাদের’ বলে ডাকডাকি। এই ছবিতে ভানু অভিনীত চরিত্রের নাম ছিল কেদার, এ কথা জানে না এমন বাঙালি বোধহয় নেই। সেই নাম পাল্টে দেওয়া হলো কেন? কপিরাইটের কারণে যদি পাল্টাতে হয়, তাহলেও কি অন্য নাম রাখা যেত না? ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবির প্রেক্ষাপটে ‘কাদের’ নাম অত্যন্ত বেমানান।
আরও পড়ুন: পুলিশ-অপরাধীর খেলা নিয়ে নতুন থ্রিলার
তবে বেশ কিছু মজার দৃশ্য দর্শককে আনন্দ দেবে। ছোট-ছোট সংলাপের খোঁচা যেমন, ‘একদিন ইতিহাসে বাংলা পড়ানো হবে’, ‘রাজনীতি আর ধর্মের বাটিচচ্চড়ি’, ‘মর্ত্যে থাকা আর নরকে থাকা একই ব্যাপার’ শুনতে মজা লাগে। চিত্রগুপ্তের ভূমিকায় শুভাশিস খুবই মানানসই। একই কথা প্রযোজ্য যমরাজের ভূমিকায় থাকা সন্দীপের ক্ষেত্রেও। বিধাতা পুরুষের ভূমিকায় পরানের বিশেষ কিছুই করার ছিল না। ইন্দ্রের চরিত্রে সাহেব বেশ মজার, তবে চরিত্রটিকে এতটা লঘু না করলেও চলত। সাম্যময়ের চরিত্রে অম্বরীশ বরাবরের মতোই বেশ ভালো তবে তাঁকে সঠিকভাবে ব্যবহার করার মতো চরিত্র খুব একটা লেখা হয় না।
আর অবশ্যই শাশ্বত। তিনি এই ছবির প্রাণ। তাঁকে দেখতেই দর্শক প্রেক্ষাগৃহে যাবেন। যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন তিনি, যদিও চিত্রনাট্য তাঁকে খুব একটা সাহায্য করেনি। পুরোনো দিনের ছায়াছবির দৃশ্যের পুনঃনির্মাণ দেখতে ভালো লাগে। সবকটি দৃশ্যেই শাশ্বতকে মানিয়ে গেছে। ‘মিস প্রিয়ংবদা’, ‘সাড়ে চুয়াত্তর’, ‘আশিতে আসিও না’ ছবিগুলি থেকে নেওয়া প্রত্যেকটি দৃশ্যে ভানুর শরীরী ভাষা রপ্ত করার চেষ্টা করেছেন শাশ্বত এবং সফল হয়েছেন। অতীতের নায়িকাদের রূপে দর্শনা, বাসবদত্তা এবং নীলিমা দেবীর ভূমিকায় দেবলীনা মানানসই। তবে গোটা ছবিতে ওই পুরোনো ছবির দৃশ্যগুলোই একমাত্র প্রাপ্তি। এর বাইরে বিশেষ কিছু পাওয়ার নেই।
রাজা নারায়ণ দেবের সুরে ‘তুমি আকাশ এখন যদি হতে’ গানটির ধাঁচে ‘যদি রূপের সাগর হও তুমি’ দেখতে এবং শুনতে ভালো লাগে। অন্বেষা দত্তগুপ্তর কণ্ঠে ‘নেচে ওঠে মন’ গানটিও বেশ ভালো। তবে স্বর্গ এবং দেবলোক নিয়ে ২০২৪-এর ছবিতে আরও কিছু ভিএফএক্স রাখা যেত।
একঝাঁক শক্তিশালী অভিনেতার কাঁধে ভর করে দুর্বল চিত্রনাট্য সত্ত্বেও মোটামুটি দেখতে ভালোই লাগে ছবিটি। দু’ঘণ্টার জন্য হাসি-মজায় থাকতে চাইলে একবার প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে দেখে আসাই যায় ‘যমালয়ে জীবন্ত ভানু’।