হ্যাংওভার প্রকট তবু অভিনয়গুণে সমৃদ্ধ
সিরিজ়: তালমার রোমিও জুলিয়েট
পরিচালনা: অর্পণ গড়াই
অভিনয়ে: দেবদত্ত রাহা, হিয়া রায়, অনির্বাণ ভট্টাচার্য, অনুজয় চট্টোপাধ্যায়, জয়দীপ মুখোপাধ্যায়, উজান চট্টোপাধ্যায়, দুর্বার শর্মা, পায়েল দে, শিলাদিত্য চট্টোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব দাস, কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়
দৈর্ঘ্য: ৩ ঘণ্টা ২১ মিনিট (৬ পর্বে)
RBN রেটিং:★★★★★★☆☆☆☆
উইলিয়ম শেক্সপিয়রের সৃষ্টি কালে-কালে মানুষের মনে ছাপ ফেলেছে। প্রতিটি শতকের মানুষ নিজেদের মতো করে তাঁর কাহিনিগুলির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে পেরেছে। তাঁর নাটকগুলি বহুবার, বহুরকমভাবে চলচ্চিত্রের পর্দায় এসেছে। বিদেশে তো বটেই, বাংলায় শেক্সপিয়রের নাটক আজও নিয়মিত মঞ্চস্থ হয়। এমনকী খোদ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ‘দ্য কমেডি অফ এররস’ অবলম্বনে লিখেছিলেন ‘ভ্রান্তিবিলাস’। সেই তালিকায় নবতম সংযোজন ‘তালমার রোমিও জুলিয়েট’ (Talmar Romeo Juliet)।
উত্তরবঙ্গের এক ছোট্ট শহর তালমা। সেখানকার মজুমদার ও চৌধুরী দুই প্রতাপশালী পরিবার। ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে এই দুই পরিবার একে-অপরের যুযুধান প্রতিপক্ষ। সেই লড়াইয়ে ঘি পড়ে, যখন চৌধুরী পরিবারের বড়মেয়ে জাহানারার (হিয়া) সঙ্গে মজুমদারদের ছোটছেলে রানার (দেবদত্ত) ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। জাহানারার বাবা লিয়াকৎ (জয়দীপ) ও রানার বাবা বাদলের (কমলেশ্বর) মধ্যে বহুদিনের শত্রুতা। পেশিশক্তির আস্ফালনে এলাকায় লিয়াকতের প্রভাব বিস্তার করে রাখে তার ভাইপো মোস্তাক (অনির্বাণ)। স্থানীয় বিধায়কও তার পকেটে।
অপরদিকে বাদলের বড়ছেলে সোমনাথ (অনুজয়) সরাসরি ক্ষমতা দখল করতে চায়। সে জানে, মানুষ হলো ক্ষমতা হাতে পাওয়ার আসল অস্ত্র। এই কাজে তাকে সাহায্য করে তার বাল্যবন্ধু তপন (দুর্বার)। রানার সেসবে বিশেষ মন নেই, পারিবারিক বেকারির ব্যবসাতেও না। সে নিজের প্রেমের জীবন এবং দুই বন্ধু পাপাই (উজান) ও দীপকে (শিলাদিত্য) নিয়েই সময় কাটায়। বাবা-দাদার কাছে বকুনি খেলেও সামলে দেয় বৌদি মৌসুমী (পায়েল)। কিন্তু রানা-জাহানারার প্রেমের পথে অনেক কাঁটা। সেসব কাঁটা উপড়ে ফেলে মিলন হবে কি?
শেক্সপিয়রের মূল নাটক ‘রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট’-এর কাহিনি প্রায় সকলেরই জানা। সে জন্যই নাটকটিকে বাংলার প্রেক্ষাপটে নিয়ে চিত্রনাট্যকার দুর্বারের জন্য বেশি কঠিন কাজ ছিল। তিনি তাঁর দায়িত্বে সফল। রোমিও-জুলিয়েট সফলভাবে হয়ে উঠেছে রানা-জাহানারা, টাইবল্ট হয়ছে মোস্তাক। কাপুলেট ও মন্টাগু পরিবার হয়ে গিয়েছে চৌধুরী ও মজুমদার বংশ। মূল নাটকের পারিবারিক অশান্তি এখানে বদলে গেছে ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে। সঙ্গে রয়েছে ধর্মভেদ।
চিত্রনাট্যে স্বাভাবিক কারণেই বেশ কিছু পরিবর্তনও এনেছেন দুর্বার। তাতে তার নিজস্বতা প্রকাশ পেয়েছে। এই সিরিজ় দেখতে বসে দর্শকের অনকেরই মনে হতে পারে, তাঁরা তাঁদের নিজের পাড়ার কোনও ঘটনা দেখছেন, কেবল চরিত্রগুলো বদলে গেছে। তবে প্রতিটি চরিত্র রূপায়ণে যতখানি সময় দেওয়া হলো, তার তুলনায় সিরিজের পরিণতি টানতে গিয়ে কি একটু তাড়াহুড়ো হয়ে গেল না?
নায়কের ভূমিকায় দেবদত্ত যথেষ্ট সাবলীল। তবে কয়েকটি দৃশ্যে নবাগতা হিয়ার সামান্য আড়ষ্টতা চোখে পড়ে। খলচরিত্রে অনির্বাণকে নিয়ে অভিযোগ রয়ে যায়। শোনা যায়, একসময় উত্তমকুমার নাকি প্রয়োজনের অতিরিক্ত সময় নিয়ে অভিনয় করতেন, যাতে পর্দায় তাঁর বেশিক্ষণ উপস্থিতি থাকে। পরিচালকেরাও তা মেনে নিতেন। গোটা সিরিজ় জুড়ে অনির্বাণকেও সেই একই কায়দায় ‘ফুটেজ’ নিতে দেখা গেল, যার কোনও প্রয়োজন ছিল না। বেশ কিছু দৃশ্যে তা বিরক্তির উদ্রেক করে। আবার কোনও তারকাকে দেখতেই দর্শক জমায়েত হয়, এ ধারণাকেও ভ্রান্ত করে দেয় এই সিরিজ়। অনুজয়, উজান এবং শিলাদিত্যের পার্শ্বচরিত্র হিসেবেই পর্দায় দাপট রীতিমতো চোখে পড়ার মতো। গুণ্ডা সিদ্দিকির চরিত্রে বুদ্ধদেব বিশেষ প্রশংসার দাবি রাখেন। কিছু-কিছু দৃশ্যে অনুজয়ের সামনে ম্লান হয়ে গিয়েছেন অনির্বাণও।
সিরিজ়ের অন্যতম প্রাণ দেবরাজ ভট্টাচার্য, শুভদীপ গুহ, বলরাম কংসবণিকের সুরে গান এবং শুভদীপ গুহর আবহ। মিষ্টি প্রেমের গল্পের সঙ্গে বিষাদগাথা ও রোমাঞ্চকে একসুতোয় বাঁধতে তাঁরা সফল। বেশ কিছু প্রাকৃতিক দৃশ্য, রাত্রিকালীন ঘটনাক্রম এবং ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের দৃশ্যগুলি চিত্রায়ণের জন্য সৌমিক হালদারের বিশেষ প্রশংসা প্রাপ্য। সংলাপ ভৌমিকের সম্পাদনা একটু বেশিই নির্মম। নির্মেদ সিরিজ়ের জন্য সম্পাদনা করতে গিয়ে তা একটু বেশিই টানটান হয়ে গেছে। আরও মিনিট দশেক দীর্ঘ হলে বিশেষ ক্ষতি হতো না বলেই মনে হয়।
আরও পড়ুন: হরর-কমেডি সিরিজ়ে ৩ ভূতের রোজনামচা
পরিচালনায় অর্পণের তেমন নিজস্বতা দেখা গেল না। বরং ‘মন্দার’-এর মতো একই ছকে বাঁধার ছাপ চোখে পড়ল। সৃজনশীল পরিচালকের পরিবর্তে অনির্বাণ নিজের নামটা অর্পণের সঙ্গে যুগ্মপরিচালক হিসেবে রাখতেই পারতেন। তবে পরিচালক হিসেবে অনির্বাণকে পরিধি বাড়াতেই হবে। ‘মন্দার’, ‘অথৈ’, ‘তালমার রোমিও জুলিয়েট’, বড্ড বেশি শেক্সপিয়র-নির্ভর হয়ে যাচ্ছেন তিনি। ‘মন্দার’-এর চমক কিন্তু প্রতিবার ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে না। একটা সময়ের পর দর্শক নতুন বোতলে নতুন মদই চাইবে।