‘ফ্যাতাড়ুদের ওড়া কোনওদিনও বন্ধ হবে না’

২০০৪-এ শুরু। সেই প্রথমবার মঞ্চে আসে অধুনা বাংলা সাহিত্যের অন্যতম আইকনিক সৃষ্টি নবারুণ ভট্টাচার্যের ‘ফ্যাতাড়ু’। এরপর গত দেড় দশক ধরে লাগাতার অভিনয় হতে থাকলেও মাঝেমধ্যেই বদলে গেছে এই নাটকের চিত্রনাট্য। বছর খানেক বিরতির পর আবারও মঞ্চে ফিরেছে ডি এস, মদন ও পুরুন্দর ভাট। আবারও শোনা যাচ্ছে ফ্যাৎ ফ্যাৎ, সাঁই সাঁই শব্দ। এবারের চিত্রনাট্য আরও চাঁচাছোলা, আরও সাংঘাতিক। এত বছর ধরে চলে আসা এই নাটকের একইভাবে জনপ্রিয়তা ধরে রাখার কারণ কী? পরিবর্তিত চিত্রনাট্যের ‘ফ্যাতাড়ু’ নিয়ে রেডিওবাংলানেট-কে একান্ত সাক্ষাৎকার দিলেন পরিচালক দেবেশ চট্টোপাধ্যায়। 

কেন বারবার ফিরে আসে ‘ফ্যাতাড়ু’? 

আসলে সময়ের নিয়ম মেনে ফ্যাতাড়ুদের ফিরতে হয়। তারা চিরকাল ক্ষমতার বিরুদ্ধে কথা বলে এসেছে। যে কোনও অরাজকতা দেখলেই তারা প্রতিবাদ করবে। তাই সময়ই তাকে ফিরিয়ে দেয়। যখনই কোনওরকম অচলায়তন গড়ে উঠবে, তখনই ফিরে আসবে ‘ফ্যাতাড়ু’। তবে এই নাটকটা আমরা বন্ধ করিনি কখনও। গত পনেরো বছর ধরে ‘ফ্যাতাড়ু’ হয়ে আসছে। মাঝে কিছুদিন অভিনেতা সতীশ সাউয়ের অসুস্থতা ও মৃত্যুর জন্য নাটকটা বন্ধ ছিল। ও সেই সময় ডি এস-এর চরিত্রে অভিনয় করত। ওর মৃত্যুতে এক বছর বন্ধ থাকলেও আমরা আবারও ফিরিয়ে এনেছি ‘ফ্যাতাড়ু’কে। কেন না গত কয়েক বছর ধরেই দেখছি ফ্যাতাড়ুদের ওড়ার অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। তাই তাদের ফিরে আসাটাই স্বাভাবিক। 




কিন্তু সময়ের সঙ্গে ‘ফ্যাতাড়ু’র চিত্রনাট্যও বদলেছে বার বার। এমনটা তো আর কোনও নাটকের ক্ষেত্রে দেখা যায় না

(হেসে) না, সেটা একেবারেই স্বাভাবিক ব্যাপার নয়। কেন না সেটা সম্ভবও নয়। আমার অন্য নাটকগুলো, যেমন ‘তুঘলক’ বা ‘সওদাগরের নৌকা’তে আমি চাইলেও চিত্রনাট্য বদলাতে পারব না। সেখানে একটা বাঁধা গল্প থাকে। কিন্তু ‘ফ্যাতাড়ু’ সবসময়েই প্রাসঙ্গিক। ২০০৪-এ একরকম চিত্রনাট্য নিয়ে কাজ হয়েছে। তারপর ২০০৭-০৮ এ সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম হওয়ার পর পরিস্থিতি পাল্টে যায়। নবারুণদা তখন জীবিত। সেই সময় তিনি কিছু কবিতা লিখেছিলেন। আমাদের চিত্রনাট্যও তখন পাল্টালো। বিভিন্ন সময় যে যখন ক্ষমতায় এসেছে, ফ্যাতাড়ুরা তখন তার বিরুদ্ধে কথা বলেছে। এটা নবারুণদারই সিদ্ধান্ত ছিল যে ফ্যাতাড়ুরা কখনও ক্ষমতার পক্ষে কথা বলবে না। দরকারে চিত্রনাট্য পাল্টানো হবে, কিন্তু ফ্যাতাড়ুদের ওড়া কোনওদিনও বন্ধ হবে না। এই নাটকও কখনও থেমে যাবে না।

আরও পড়ুন: তিন মূর্তি ও পায়ের তলায় সরষে

অর্থাৎ এই চিত্রনাট্যের রদবদলটা সমসাময়িক রাজনীতির চলন দেখে বদলাতে থাকে

হ্যাঁ সেটা করতে হয়। তবে মূল চিত্রনাট্যের গঠনটা একই থাকে। কিছুটা করে অংশ বদলে যায়। এটা চলতেই থাকে। আমাদের দেশে সারাক্ষণই তো কিছু না কিছু ঘটছে, তাই ‘ফ্যাতাড়ু’তে প্রতিবাদের বিষয়ের অভাব হয় না কখনও। আগামীদিনেও চারপাশে যা কিছু ঘটতে দেখব তাই নিয়ে ইম্প্রোভাইজ়েশন চলতে থাকবে। ‘ফ্যাতাড়ু’ তো একেবারে নিম্নবর্গীয় মানুষের কথা বলে। তারা শোষিত বা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এমন যা কিছু আসবে তাই নিয়েই ফ্যাতাড়ুরা সরব হবে। 

এক্ষেত্রে একটা প্রশ্ন এসেই যায় যে এই নাটক যেহেতু ক্ষমতার বিরুদ্ধে কথা বলে, তার মানে তো চরিত্রগুলোকে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের দিকে আঙুল তুলতে হয়। সেটা করতে গিয়ে কখনও রাজনৈতিক দিক থেকে কোনও বাধা আসেনি? 

না, ‘ফ্যাতাড়ু’র ক্ষেত্রে কখনও বাধা আসেনি। বাম আমলে আমারই নাটক ‘উইঙ্কল টুইঙ্কল’-এর সময় সরকার থেকে শো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। তবে ‘ফ্যাতাড়ু’ নিয়ে এখনও পর্যন্ত কোনও সমস্যা হয়নি। 

আরও পড়ুন: এদেশে সবকিছুই হাস্যকর, পুরস্কারের মনোনয়ন ফিরিয়ে বিস্ফোরক স্বস্তিকা

এই মুহূর্তে আপনার নাট্যদল সংসৃতির ছ-সাতটা নাটক একসঙ্গে চলছে। তার মধ্যে এই যে বদলে যাওয়া চিত্রনাট্যে এই নাটকটা মঞ্চস্থ হয়, সেটা নিয়ে রিহার্সলের ক্ষেত্রে কোনও অসুবিধা হয় না? 

না, এটার ক্ষেত্রে কোন সমস্যাই হয় না। বরং অন্যান্য নাটকগুলোর ক্ষেত্রে চিত্রনাট্য পাল্টালে অসুবিধায় পড়তে পারি। তবে সেগুলোর চিত্রনাট্য পাল্টানো প্রায় অসম্ভব। ‘ফ্যাতাড়ু’র চিত্রনাট্যটা আসলে মগজে ভরা থাকে। আর যারা অভিনয় করেন তারাও এতটাই আন্তরিকভাবে এই নাটকটার সঙ্গে যুক্ত যে বছরে যতগুলো শো-ই থাকুক না কেন কোনও সমস্যায় পড়তে হয় না। 

২০০৪-এ ‘ফ্যাতাড়ু’র মূল তিনটি চরিত্রে যাঁরা অভিনয় করতেন, এখন তাঁরা করেন না। অভিনেতা পাল্টে গেল কেন? এর ফলে ধারাবাহিকতার অসুবিধা হয় না?

সেটা আসলে পাল্টাতে হয়েছে কারণ রুদ্রনীল (ঘোষ) ওর ফিল্ম কেরিয়ারে এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল যে সময় দিতে পারছিল না। ও পুরুন্দরের চরিত্রটা করত। সেই সময় আমি নিজেও বহুদিন ওর চরিত্রটা করেছি। এখন যাঁরা করছেন তাঁদের মধ্যে শান্তিলাল (মুখোপাধ্যায়) ব্যস্ত অভিনেতা হলেও ও থিয়েটারের মানুষ। তাই এটার জন্য ওর সময়ের অভাব হয় না। এমনিও আমরা যারা ‘ফ্যাতাড়ু’ করি, তারা আদর্শগত দিক দিয়ে নাটকটার প্রতি বিশ্বাস রাখি। সেটা ভীষণ জরুরী। নাহলে এই নাটকটা করা সম্ভব হতো না। 

Amazon Obhijaan



Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Swati

Editor of a popular Bengali web-magazine. Writer, travel freak, nature addict, music lover, foody, crazy about hill stations and a dancer by passion. Burns the midnight oil to pen her prose. Also a poetry enthusiast.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *