“এখানে কেউ সিনেমা ভালোবাসে না”
এ বছরের প্রথমদিকে মুক্তি পেয়েছিল ‘পারিয়া’ (Pariah)। সেই ছবির শেষাংশ দেখেই বোঝা গিয়েছিল, এই ছবির দ্বিতীয় ভাগে আরও বেশ কিছু কথা বলবেন পরিচালক। সেই দ্বিতীয় ভাগ নিয়ে খুব বেশি অপেক্ষা করতে হচ্ছে না দর্শককে। কিছুদিন আগেই মুক্তি পেয়েছে ‘পারিয়া’র দ্বিতীয় ভাগ ‘কালভৈরব’-এর পোস্টার। রেডিওবাংলানেট-এর সঙ্গে আড্ডা দিলেন পরিচালক তথাগত মুখোপাধ্যয় (Tathagata Mukherjee)।
‘পারিয়া’ দর্শকের প্রশংসা পেয়েছিল, বিশেষ করে পশুপ্রেমীদের মধ্যে। সাধারণত কোনও ছবির দ্বিতীয় ভাগের জন্য দর্শককে অনেকটা সময় অপেক্ষা করতে হয়। এই ছবির দ্বিতীয় ভাগ এত তাড়াতাড়ি আনার পরিকল্পনা কি প্রথম থেকেই ছিল?
তথাগত: এই ছবিটা সেভাবে বানানো নয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দর্শককে অপেক্ষা করতে হয় কারণ নির্মাতারা ছবির সাফল্যের ওপরে নির্ভর করে দ্বিতীয় ভাগ বানান। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমি যখন ‘পারিয়া’র প্রথম ভাগ লিখছিলাম, তখনই প্রযোজক আমাকে ক্রিয়েটিভ লিবার্টি দিয়ে রেখেছিলেন। বলেছিলেন, ছবি যেমনই চলুক না কেন, ‘পারিয়া’র দ্বিতীয় ভাগ তাঁরা আনবেন, আমি যেন সেভাবেই গল্পটা লিখি। অনেক প্রশ্নের উত্তর প্রথম ভাগে পাওয়া যায় না, যেমন লুব্ধক কোত্থেকে এল, কেন কুকুরটার জন্য সে এত লড়াই করছে বা তার আসল পরিচয় কী, এসব জানা যায় না। সে একটা নিছক চরিত্র হয়েই রয়ে যায়। এই সবকিছুর উত্তর পাওয়া যাবে পরের ভাগে।
‘পারিয়া’ কেবলই লুব্ধকের পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন রেখে যায় না। সেই কুকুরছানাটাকে লুব্ধক খুঁজে পাবে কিনা, সে প্রশ্নও রেখে যায়। নায়ক কি এই ভাগে কুকুরটাকে পাবে?
তথাগত: তার জন্য সিনেমাটা দেখতে হবে। এটুকু বলতে পারি, ‘পারিয়া’র প্রথম ভাগ যেমন কুকুরছানাটাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে, দ্বিতীয় ভাগেও কুকুরছানাটার একটা বড় ভূমিকা রয়েছে। ‘পারিয়া’র দুটো পর্বেরই প্রধান আইডিয়া ছিল, আমরা নিজেদের স্বার্থ এবং সুবিধার জন্য অবলা প্রাণীদের ওপর অত্যাচার করি, সে চিড়িয়াখানায় জীবজন্তু রাখা হোক বা বাড়ির অ্যাকোয়ারিয়ামের মাছ। পুরোটাই নিজেদের শখের জন্য। খাদ্যশৃঙ্খলের ক্ষেত্রেও মানুষ অন্য প্রাণীদের খায় এবং তার আগে তাদের ওপর অপরিসীম অত্যাচার করে। এটা হচ্ছে মূল আইডিয়া। সেই আইডিয়ার একটা অংশ ‘পারিয়া’র প্রথম ভাগে। দ্বিতীয় ভাগে আমরা আরও বৃহত্তর একটা জগৎ দেখতে পাব। কুকুরছানাটা তো একটা মস্ত ভূমিকা নেবেই, কিন্তু তাকে কেন্দ্র করে অন্যান্য প্রাণীরাও এসে পড়বে। সে জন্যই ‘পারিয়া’র দ্বিতীয় ভাগকে ‘কালভৈরব’ বলা হচ্ছে।
জীবজন্তু নিয়ে ছবি করার কোনও বিশেষ কারণ আছে?
তথাগত: আমি বরাবরই প্রকৃতি নিয়ে ছবি করেছি। আমার প্রথম ছবি ‘ইউনিকর্ন’-এ জলের তলার পৃথিবী, টেলিপোর্টেশন, নারীমুক্তি, এসব আসছে। প্রকৃতি সেখানে একটা বড় ভূমিকা নিয়েছিল। ‘ভটভটি’র ক্ষেত্রেও প্রকৃতির ভূমিকা আমরা দেখেছি। তবে আমার ছবিতে এতদিন প্রকৃতি কেবল পরোক্ষ ভূমিকা নিয়েছে। ‘পারিয়া’ থেকে তা প্রত্যক্ষ ভূমিকা নিতে শুরু করল কারণ কথাগুলো এখন মানুষকে বলা প্রয়োজন। এগুলোর মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করা দরকার।
আরও পড়ুন: আবারও বাংলা ছবিতে সায়ন মুন্সি, সঙ্গে জয়া আহসান
নব্বইয়ের দশক এবং তার পরেও অনেকদিন বাংলা ছবির অন্যতম আকর্ষণ ছিল অ্যাকশন। ‘পারিয়া’য় তা আবার ফিরে এল। ‘মির্জা’ও অ্যাকশনধর্মী। বাংলা ছবিতে অ্যাকশন ফেরানোয় ‘পারিয়া’ কি পথপ্রদর্শক?
তথাগত: পথপ্রদর্শক কিনা জানি না, তবে যাঁরা পারিয়া দেখেছেন, তাঁরা জানেন, এই ছবিটি একেবারেই স্বতন্ত্র। রামগোপাল ভর্মার ছবিতে আমরা কিছু রিয়েলিস্টিক অ্যাকশন দেখেছিলাম। ‘ভটভটি’র সময়ে আমি যে নিরীক্ষা করেছিলাম, ‘পারিয়া’র সময়ও একই কাজ করেছিলাম। সেটা হলো মূলধারার ছবি একইসঙ্গে কী করে বাস্তবধর্মী এবং বিনোদনমূলক হতে পারে, তার প্রচেষ্টা করা। আগামীতেও যত কঠিন বিষয়ই হোক না কেন, এই নিরীক্ষা আমি জারি রাখব। আমরা যারা উন্নত সিনেমা, মানে আজকের দিনে দাঁড়িয়ে আধুনিক সিনেমা তৈরি করতে চাই, তাদের সবারই লড়াই এটা। পারিয়ার মাধ্যমে আমি সেই চেষ্টাই করেছি। এই জঁরে প্রথম হওয়ার দরুণ তা খুবই আনন্দের বিষয়।
আরও পড়ুন: নজরুল ইসলামের ভূমিকায় কিঞ্জল নন্দ
‘পারিয়া’তে সৌম্য মুখোপাধ্যায়কে এক নতুন রূপে দেখা গেছে। দর্শক কি আবার এরকম কোনও ডার্ক খলনায়ককে দেখতে পাবেন, যার জীবনদর্শন বড্ড বেশি সত্য কথা বলে?
তথাগত: নিশ্চিতভাবে। সত্য কথা বললেই আজকাল ডার্ক মনে করা হয়। সৌম্যর থেকেও অনেক বেশি ডার্ক চরিত্র আমরা ‘পারিয়া’র দ্বিতীয় ভাগে পাব যার দর্শন সত্যি হবে, কথাগুলো সত্যি হবে। লুব্ধককে আমরা সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে দেখব। তার অতীত সম্পর্কে দর্শক কিছুই জানেন না। পারিয়ার এই দ্বিতীয় ভাগ একইসঙ্গে প্রিক্যুয়েল ও সিক্যুয়েল। লুব্ধকের একটা কালো অতীত আমরা যেমন দেখতে পাব, তেমনই তার ভবিষ্যতেও বেশ কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যও আমরা দেখব, যা আমি ইচ্ছে করে প্রথম ভাগে রাখিনি।
‘ভটভটি’র মতো সমকালীন রাজনীতিমনস্ক ছবি আবার থেকে কবে পাওয়া যাবে?
তথাগত: এ বছরই ‘গোপনে মদ ছাড়ান’ মুক্তি পাবে। এই ছবিটা একটা ডার্ক কমেডি। অনেকটা ‘ফ্যাতাড়ু’র মতো। ফ্যাতাড়ুদের মতো এখনকার ছেলেরাও কিন্তু ধ্বংস করতে চায় না। তারা কেবল সময়টার মধ্যে বাঁচতে চায়। কাদার মধ্যে, পাঁকের মধ্যে পড়ে থেকেই সেখান থেকে কিছু ফয়দা লুঠতে চায়। এই ছবির প্রধান চরিত্রে থাকা লোকগুলোকে আমি নগ্ন করে দেখিয়েছি। লোকে বলে এক রাতে নাকি জীবন বদলে যায়। না, সেটা সম্ভব নয়। আমি সেই চেষ্টাও করিনি। এখনকার সময়, রাজনীতি, ছেলেমেয়ে, পুলিশ, মধ্যবিত্ত মানুষ কীভাবে ভাবছে, সেই সবকিছুকেই আমি নগ্ন করেছি এই ছবিতে। তবে অনেকের পক্ষে এই ছবিটা হজম করা মুশকিল, তার কারণ এর ভাষা। মানুষ যে সেক্সিস্ট কমেন্ট করে, তাতে পাশের লোকটা হাসে, তার কোনও শাস্তি হয় না, বাবা-মাকে গাল দেয়, এই রূপগুলোইকেই নগ্ন করে দেখানো হয়েছে ছবিতে। আমি মনে করি, ‘ভটভটি’র পর ‘গোপনে মদ ছাড়ান’ একটি আদ্যন্ত পলিটিক্যাল ছবি।
বাংলায় এখন বেশিরভাগ ছবিই হয় সম্পর্ক নির্ভর, নাহলে থ্রিলার। এরকম অবস্থায় এই ইন্ডাস্ট্রির ভবিষ্যৎ কী বলে তোমার মনে হয়?
তথাগত: আমি বাংলা ভালোবাসি, তাই বাংলাতে ছবি বানাই। ভবিষ্যতেও বানাব। আগামীদিনে চেষ্টা করব আরও উন্নত এবং বড় সিনেমা করতে যাতে দর্শক প্রেক্ষাগৃহে যায়। ওটিটি এসে যাওয়ার পর দর্শক নিছক সম্পর্কের গল্প দেখতে আর প্রেক্ষাগৃহে যায় না। তাদের কোনও একটা এক্স-ফ্যাক্টর দিতে হবে যা একমাত্র হলে গিয়েই দেখা যাবে। সেই জন্যই আমি এই ছবিগুলো এত বড় স্কেলে করছি। আমার কি ইচ্ছে করে না সম্পর্কের গল্প বলতে? কিন্তু আমি জানি, এই সময়টা তার জন্য সঠিক নয়।
আরও পড়ুন: থাকছেন না সঞ্জয় দত্ত
তার মানে তথাগতর থেকে পারিবারিক ছবি পাওয়া যাবে না
তথাগত: ঠিক তা নয়। আমি যদি কখনও কোনও পারিবারিক ছবি করি, সেটাও বিরাট স্কেলেই হবে। কারণ, হাজার আর্থিক অনটনের মধ্যেও কিছু এক্সক্লুসিভ দেখার আশায় মানুষ সিনেমাহলে যায়। আমার ক্ষেত্রে সেটাই প্রাথমিক লক্ষ। অন্যদের কথা বলতে পারব না, তবে অভিনেতা হিসেবে এতদিন এই ইন্ডাস্ট্রিতে থাকার ফলে আমি নিজের কথা বলতে পারি। এখানে কেউ সিনেমা ভালোবাসে না। জানি, সিনেমার একটা ব্যবসায়িক দিক আছে। কিন্তু ভালোবাসাটা থাকাও খুব দরকার। প্রচুর মানুষ বড় চাকরি ছেড়ে সিনেমাকে ভালোবেসে এখানে এসেছে। কিন্তু এখন ব্যাপারটা কেবল নামযশের দিকে চলে গেছে। আমি যে জিনিসটাকে ভালোবাসি, সেটাকে আমি এমনভাবে লালন করে সকলের কাছে পেশ করব যাতে সকলেই তাকে ভালোবাসে। যদি আমার ভালোবাসাই না থাকে, তাহলে সিনেমাটা হবে কী করে? আমার মনে হয় বাংলা সিনেমার মূল সমস্যা হলো, যাঁরা সিনেমা বানাচ্ছেন, অভিনয় করছেন, যাঁরা বিভিন্ন কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত, তাঁরা প্রত্যেকেই শুধু এবং শুধুমাত্র ব্যক্তিস্বার্থের জন্যই কাজ করছেন। তাঁদের কেউ সিনেমা ভালোবাসেন না। কাউকে কনটেন্ট ক্রিয়েট করতে হবে, কাউকে কনটেন্ট ডেলিভারি দিতে হবে, কাউকে অভিনয় করতে হবে। সিনেমা কনটেন্ট হতে পারে না। সিনেমার মধ্যে একটা অদ্ভুত রোম্যান্টিসিজ়ম আছে। সিনেমাকে ভালোবাসলে তবেই ব্যবসা হবে। কোনও আর্টফর্মকেই ভালো না বাসলে ব্যবসা হওয়া সম্ভব নয়। সিনেমার মতো কোনও কোলাবোরেটিভ আর্টে আমি আমার সঙ্গে থাকা বাকিদের মধ্যে যদি সেই ভালোবাসাটা ছড়িয়ে না দিতে পারি, তাহলে উন্নতমানের ছবি বানানো কখনওই সম্ভব নয়।