রং বেরঙের স্বপ্নকে ফিরিয়ে দেবে ‘পক্ষীরাজের ডিম’

ছবি: পক্ষীরাজের ডিম

পরিচালনা: সৌকর্য ঘোষাল

অভিনয়ে: মহাব্রত বসু, অনুমেঘা বন্দ্যোপাধ্যায়, অনির্বাণ ভট্টাচার্য, শ্যামল চক্রবর্তী, অ্যালেক্স ও নীল, দেবেশ রায়চৌধুরী, অনুজয় চট্টোপাধ্যায়

দৈর্ঘ্য: ২ ঘণ্টা ১৩ মিনিট

RBN রেটিং ★★★★★★★★☆☆

কিছু-কিছু অবাস্তব কল্পনা আছে যেগুলোকে মন ভালো করার একান্ত নিজস্ব সিন্দুকে রেখেই আমরা ভারী আনন্দ পাই। শৈশব থেকে মনের কোণে এইসব অবাস্তব কল্পনারা নিজেদের খাস জমি বানিয়ে সেই যে বাসা করেছে  এই মধ্য বয়সে এসেও তাদের আর নড়ানো যায় না। তার মধ্যে পক্ষীরাজ বা ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমি যেমন আছে তেমনই আছে সরল চোখে বড় হয়ে ওঠার স্বপ্নও। এমন বড় যাতে উল্টোদিকের মানুষগুলো সম্ভ্রমের চোখে তাকায়। শুধুমাত্র অঙ্ক পারে না বলে কেউ যেন ঠাট্টা না করে। এই ছোট-ছোট চাওয়াগুলো আজকাল আর তেমন করে পাওয়া যায় কই! তেমন কিছু চাওয়া কেমন করে যেন সত্যি হয়ে গেল সৌকর্যর নতুন ছবি ‘পক্ষীরাজের ডিম’ (Pokkhirajer Dim) দেখতে বসে।




২০১৮ সালে মুক্তি পেয়েছিল ‘রেনবো জেলি’ (Rainbow Jelly)। সেই ছবিকে চোখ বুজে এ যুগের অন্যতম সেরা ছোটদের ছবির তকমা দেওয়া যায়। ‘রেনবো জেলি’র ঘোতনের জীবনের পরবর্তী গল্পই সৌকর্য বলেছেন ‘পক্ষীরাজের ডিম’ ছবিতে। যদিও আগের ছবিটি দেখা না থাকলেও কিছু এসে যাবে না। এই ছবিতে ঘোতন এসে পড়ে আকাশগঞ্জ গ্রামে। কীভাবে, কেন, সে সব জেনে কাজ নেই। রূপকথার গল্পে অমন অনেককিছু এমনি এমনিই হয়। ঘোতন এখানে কিরণদিমাসীর তত্বাবধানে দিব্যি সুখে আছে। তার একখানা একেবারে নিজস্ব আস্তানাও রয়েছে এ বাড়িতে। দাদুর সুপারিশে আকাশগঞ্জ হাই স্কুলে পড়ার সুযোগ পেয়েছে সে। যদিও পড়াশোনার ব্যাপারটায় ঘোতনের কিঞ্চিৎ দুঃখ আছে। ভূগোলের ব্যাপারে কলকাতা থেকে ভিডিও কলে তাকে সাহায্য করে পপিন্স (অনুমেঘা)। পপিন্স ঘোতনের একমাত্র বন্ধু। কিন্তু অঙ্কের আতঙ্কটা কিছুতেই এড়ানো যাচ্ছে না। তার মধ্যে বটব্যাল স্যার (অনির্বাণ) আবার ক্লাস টেনের টেস্ট পরীক্ষায় ঘোতনকে ১০০ র মধ্যে ০ দিয়ে দেন। স্যার আবার যে সে মাস্টার নন। স্যারের ফিজিক্সের ক্লাস মানেই অভিনব সব প্র্যাকটিকাল। ল অফ ফ্রিকশন বোঝাতে গিয়ে তিনি স্কুলের উঠোনে মোবিল ঢেলে হেঁটে আসা ছাত্র শিক্ষক সকলের পড়ে যাওয়া পর্যবেক্ষন করে নিয়মের সপক্ষে যুক্তি দেন। এ হেন বটব্যাল স্যার রাজি হলে তবেই ঘোতনের রিটেস্ট হবে, হেডস্যারের কড়া নির্দেশ। ওদিকে স্বয়ং হেডস্যারকে উঠোনে আছাড় খাওয়ানোর কারণে তিনি নিজেই স্কুল থেকে টিসি পেয়েছেন। এবার ঘোতন কী করে? মাধ্যমিকে বসতে না পারলে তো মহা বিপদ!

Pokkhirajer Dim

ইদানিং আধুনিক স্কুলে এরকম কান্ডকারখানা বিশেষ না ঘটলেও একটা সময় হামেশাই ঘটত। সেই সময়টাকে মনে করিয়ে দেবে এই ছবি। একইসঙ্গে নির্ভেজাল বাঙালিয়ানা, যাকে কয়েক প্রজন্ম আগেও একেবারে আটপৌরে চেহারাতেই পাওয়া যেত সেই আমেজটা বয়ে আনে ঘোতনের দুনিয়া। এর সঙ্গে সাপরাজ বাবা, উড়ন্ত মন্দির, ম্যাজিক পাথর, ভিলেন সাহেব সব মিলে ঘোতনের পক্ষীরাজের স্বপ্নকে আরও মজাদার করে তুলেছে। সত্যি সত্যি পক্ষীরাজ নাই বা থাকলো, তাই বলে ভাবতে তো কেউ বারণ করেনি। তার বদলে যা রয়েছে তাও যে বড় কম নয়। বিজ্ঞান কি সৌরজগতের সবটা জেনে ফেলেছে? নাকি এখনও অনেকটা জানা বাকি তার? আলো সত্যিই সরলরেখায় চলে কিনা, কিংবা মানুষের আবেগ মাপা যায় কিনা এইসব নিয়ে এখনও তো কেউ কেউ প্রশ্ন তোলে। লোকে তাদের পাগল বললেও তারা আসলে বৈজ্ঞানিক। তারা ভেবেছেন বলেই তো পৃথিবীর বুকে মানুষ একটার পর একটা আবিষ্কার করে অসাধ্য সাধন করেছে। শুরুর প্রশ্নটা তোলা যেমন জরুরি তেমনই সঠিক স্বপ্নটাও দেখা জরুরি। স্বপ্নই না থাকলে তা আর সত্যি হবে কী করে? সেই স্বপ্নের দুনিয়ায় সোয়া দু’ঘণ্টার জার্নি করিয়ে এনে সৌকর্য বুঝিয়ে দেন আমাদের ভেতরের সেই ছেলেবেলাটা এখনও কোথাও যেন থেকে গেছে।

Pokkhirajer Dim

ছোটদের ছবি? নাকি বড়দের? ছোটরা নিশ্চয়ই এই ছবির মাধ্যমে অনেক কিছু নতুন দেখবে শুনবে জানবে, হয়তো ভাবতেও শিখবে। কিন্তু বড় অথবা আধবুড়োর দল এই ছবিতে খুঁজে পেতে পারে একটা আস্ত নস্টালজিক ছোটবেলা। সঙ্গে শীর্ষেন্দু-সত্যজিতের দেখানো পথে একটা কিছু না জীবন থেকেও অনেকটা কিছু খুঁজে পাবার সেই মহামন্ত্র ফিরে পাওয়া যাবে এই ছবিতে। হোক না সে আবোল তাবোল কিংবা আজগুবি, অমন অদ্ভুত ভাবনাগুলোই তো বাকি জীবনটায় লড়ে যাওয়ার ক্ষমতা জোগায়।

Pokkhirajer Dim

ঘোতনের চরিত্রে মহাব্রতর অভিনয়কে বোধহয় অভিনয় বলাই উচিত হবে না। এত সাবলীল এবং স্বাভাবিকভাবে গোটা ছবিতে ঘোতন বিচরণ করেছে যে দর্শক বাধ্য হবেন ওই বয়সের সারল্যে আবার ফিরে যেতে। খুব গম্ভীর পপিন্সের ভূমিকায় অনুমেঘাকে সত্যিই পরীর মতোই লেগেছে গোটা ছবি জুড়ে। আর অনির্বাণ। শেষ কবে তিনি পর্দায় এসে এতটা আনন্দ দিয়েছেন মনে করতে গেলে গুগল ঘাঁটতে হবে মনে হয়। বটব্যাল স্যারের ভূমিকায় তিনি অনবদ্য এবং তুখোড়। দুই বয়সের পরস্পরবিরোধী চরিত্রেই অসম্ভব বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠা সম্ভবত অনির্বাণ বলেই সম্ভব। এছাড়াও সাপরাজ বাবা, হেডমাস্টার, কিরণদি প্রত্যেকে যেন জীবন্ত চরিত্র। বাড়ির অভিভাবকসম পরিচারকের ভূমিকায় বড় বেশি মায়ায় জড়িয়ে গেলেন শ্যামল চক্রবর্তী। এমন স্নেহও তো আজকাল পাওয়া যায় না আর। বিধায়কের ভূমিকায় দেবেশ এবং ভিলেন সাহেবের ভূমিকায় অ্যালেক্স দুজনেই দুর্দান্ত। আলাদাভাবে উল্লেখ্য অনুজয়ের বিল্টু চরিত্রটি। গ্রাম দেশের ওভারস্মার্ট গুণ্ডার চরিত্রে, শরীরী ভাষায় অবাক করেছেন অনুজয়। যে কোনও চরিত্রেই নিজের ছাপ রাখতে জানেন তিনি, আবারও দেখালেন।

আরও পড়ুন: ট্রোলাররা তো জঞ্জাল, কেন পাত্তা দেব: ঋত্বিক

নবারুণ বসুর আবহ এই ছবির সম্পদ। বিশেষ বিশেষ দৃশ্যে ঢাক ও ঢোলের ব্যবহার প্রশংসনীয়। তেমনই মজাদার ছবির গানগুলিও। অনির্বাণের কণ্ঠে ‘অঙ্কে জ়িরো’ শুনতে বেশ লাগে। লগ্নজিতা চক্রবর্তীর কণ্ঠে ‘কী হবে তার’ গানটি আলাদা রেশ রেখে যায়। সৌমিক হালদারের চিত্রগ্রহণ যথাযথ। সোয়া দু’ঘন্টার ছবিতে একটুও অস্থির না লাগার জন্য নিঃসন্দেহে টান-টান সম্পাদনাই দায়ী। এমনকি ছবি শেষ হয়ে গেলেও কেমন যেন মনখারাপের রেশ রয়ে যায়, ঘোতনের দুনিয়া থেকে বেরিয়ে আবার বাস্তবের দুনিয়ায় পা রাখতে হবে ভেবে। নিজেদের ছোটবেলাটাকে আর একবার সামনে থেকে দেখতে আর পক্ষীরাজ থেকে ইউএফওর স্বপ্নগুলোকে আর একবার বেঁচে নিতে আকাশগঞ্জ স্টেশনে একবারের জন্য হলেও নেমে পড়তেই হবে।




Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Swati

Editor of a popular Bengali web-magazine. Writer, travel freak, nature addict, music lover, foody, crazy about hill stations and a dancer by passion. Burns the midnight oil to pen her prose. Also a poetry enthusiast.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *