কলকাতার বুকে ক্যাফে থিয়েটারের অভিনব প্রয়াস
RBN Web Desk: স্বপ্ন তো অনেকেই দেখে। কিন্তু সেই স্বপ্নকে সত্যি করতে যে মূল্য দিতে হয় তা ক’জন দিতে পারে? আবার সব মূল্য চুকিয়েও কি পৌঁছনো যায় অভীষ্ট লক্ষ্যে? প্রশ্ন থেকেই যায়, তবু নিজের সর্বস্ব বাজি রেখেও আকাশ ছুঁতে চায় কেউ-কেউ। হয়ত ছুঁয়েও ফেলে উজ্জ্বলতম সেই স্বপ্নকে। কারোর স্বপ্ন আবার সপাটে মুখ থুবড়ে পড়ে বাস্তবের কঠিন মাটিতে। রুপোলি পর্দাকে ঘিরে বিনোদন দুনিয়ায় জায়গা করে নেওয়ার স্বপ্ন আর স্বপ্নভঙ্গের ধাক্কাকে নাটকের মাধ্যমে তুলে ধরল অভ্রজিৎ সেনের নাটক ‘তারামন্ডল’।
থিয়েটার বলতে সাধারণভাবে যা বোঝায় তা হলো মঞ্চে বা মুক্ত প্রাঙ্গনে পরিবেশিত অভিনয়। তবে সময়ের সঙ্গে পাল্টায় পরিবেশনের মাধ্যম। হোল নাইন ইয়ার্ডস নাট্যদল তাই বেছে নিয়েছে অভিনব ফুড অ্যান্ড থিয়েটার বা কালিনারি থিয়েটারের মাধ্যম। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে জনপ্রিয় এই ধারার থিয়েটারে ক্যাফে বা রেস্তোরাঁয় খাওয়ার অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিউজ়িক্যাল থিয়েটারকে একই তালে বেঁধে দেওয়া হয়, যেখানে দর্শক নিজেই নাটকের অংশ হয়ে ওঠেন। নাটকের অন্তর্গত চরিত্রদের হাসি, কান্না, আনন্দ, বেদনা তাদেরকেও স্পর্শ করে যায় গভীরভাবে। ‘তারামন্ডল’ এমনই এক অভিনব উদ্যোগ। ২০১৭ থেকে কলকাতার বুকে নানা জায়গায় পরিবেশিত হয়েছে এই নাটক।
আরও পড়ুন: আবারও স্করসেসির সেরায় সত্যজিৎ
২ এপ্রিল দুটি শোয়ের মাধ্যমে এই নাটকের ১৬ ও ১৭তম অভিনয় অনুষ্ঠিত হলো। নীল চৌধুরীর লেখা এই নাটকে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন দীপ্তদীপ চক্রবর্তী, সৌম্যদীপ চক্রবর্তী, দেবপ্রিয় মুখোপাধ্যায়, মনোমিতা চৌধুরী, তনিকা বসু, সুহোত্র মুখোপাধ্যায়, অনন্যা সেন ও রায়ান। সত্যজিৎ রায়ের ছোটগল্প ‘পটলবাবু ফিল্মস্টার’-এর মূল ভাবনাকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে ‘তারামন্ডল’ নাটকটি।
এই ধরণের থিয়েটারের মুখ্য বিষয় হলো একটি ক্যাফেকে কেন্দ্র করে গল্পের ওঠাপড়া ও গতি নির্ধারিত হওয়া। সেই মতোই সেদিন বাইপাসের ধারের একটি ক্যাফেকে কেন্দ্র করে ‘তারামন্ডল’এর টুকরো গল্পের কোলাজ গড়ে উঠেছিল। এখানে কোনও একটি নির্দিষ্ট কাহিনীর ওপর ভিত্তি করে নাটক এগোয় না। তাও পটলদার গল্প ফিরে আসে নাটকের প্রতিটি বাঁকে। বাকি সমস্ত ছন্নছাড়া খামখেয়ালিপনার গল্পগুলোকে যেন বেঁধে রাখে এই একটি গল্প। সব গল্পেই ফিরে-ফিরে আসে স্বপ্ন, অভিনেতা জীবনের হাতছানি, আর তাকে ঘিরে গড়ে ওঠা অজস্র মিথ, ভ্রান্ত ধারণা, হতাশার অন্ধকার। তবু সেই অন্ধকারে আলো দেখায় নিষ্ঠা, জেদ আর হার না মানার অঙ্গীকার।
পুরো নাটক জুড়ে বেশ কিছু অভিনেতাকে একাধিক চরিত্রে অভিনয় করতে দেখা গেল। তবু কখনও তাঁদের অভিনীত দুটি চরিত্র গুলিয়ে যায় না। তাৎক্ষণিকভাবে হুবহু সেই চরিত্রই হয়ে উঠেছেন প্রত্যেকে। ছেঁড়া কিছু গল্পের কোলাজ হলেও চরিত্রগুলিকে জীবন্ত করে তুলেছেন অভিনেতারাই। মঞ্চ, বিশেষ আলো বা অতিরিক্ত সাজসজ্জা ছাড়াই তাঁরা প্রত্যেকে নিজের সময়ে সবটা আলো নিজের দিকে শুষে নিতে সক্ষম। পটলদার ভূমিকায় দীপ্তদীপের অভিনয় এ নাটকের সম্পদ। এছাড়াও বিভিন্ন চরিত্রে সুহোত্র, তনিকা, মনোমিতা, দেবপ্রিয়, অনন্যা, সৌম্যদীপ প্রত্যেকেই অপ্রতিরোধ্য।
আরও পড়ুন: বিপরীত মেরুর রুদ্রিকের সঙ্গে মালাবদল, কোন লড়াইয়ের প্রস্তুতি তিথির?
সাম্প্রতিক কিছু ছবি ও সিরিজ়ের দৌলতে অভিনেতারা অনেকেই চেনা মুখ হলেও অভিনয়ের মুন্সিয়ানায় আগের অভিনীত চরিত্রকে ভুলিয়ে দিয়েছেন প্রায় সকলেই।
দিব্যকমল মিত্রর নির্দেশনায় মেঘাতিথি, রনিতা ও রোহনের সঙ্গতে নাটকে ব্যবহৃত গান ও আবহ সঙ্গীত শুনতে ভালো লাগে। অনবদ্য লাগে রায়ানের কন্টেপোরারি ধারার সহজ সাবলীল নাচও। তবে অভিনয়ের পারদর্শীতায় দর্শকের মন জয় করতে পারলেও সামান্য হলেও অস্বস্তির সৃষ্টি করে নাটকের দৈর্ঘ্য। আড়াই ঘন্টার বেশি সময় ধরে চলা নাটক বর্তমান সময়ে বেশ দীর্ঘ। পরিবেশনার জন্য অনায়াসে নাটকের কিছু অংশ পরিমার্জন করা যেতে পারত। তবে এ কথা পরিষ্কার যে নির্দেশনা ও অভিনবত্বের গুণে নিঃসন্দেহে দর্শকের সমাদর পাবে ‘তারামন্ডল’।
ছবি: স্বাতী চট্টোপাধ্যায়