একটু ফেলুদাকেও রাখা যেত

ওয়েব সিরিজ়: সাবাশ ফেলুদা—গ্যাংটকে গণ্ডগোল

পরিচালনা: অরিন্দম শীল

অভিনয়ে: পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, ঋতব্রত মুখোপাধ্যায়, রুদ্রনীল ঘোষ, ঋত্বিক চক্রবর্তী, ক্রিস্টোফার কলিন্স, দেবপ্রিয় মুখোপাধ্যায়, সৌরসেনী মৈত্র, অরিজিৎ দত্ত, কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়, অরিন্দম শীল

দৈর্ঘ্য: ৫ ঘণ্টা (১০ পর্বে) 

ওটিটি: জ়ি ফাইভ

RBN রেটিং ★★★★★☆☆☆☆☆

কিশোর বয়সের বাঙালির সবচেয়ে ফ্যান্টাসি নির্ভর চরিত্র যদি হয় ‘চাঁদের পাহাড়’-এর শঙ্কর, তবে বাড়ির পাশের সবথেকে চেনা চরিত্রটি অবশ্যই ফেলুদা। অন্তত এক দশক আগেও তেমনটাই হতো। বর্তমান প্রজন্মের কাছে এখন অনেক বিকল্প। হ্যারি পটার থেকে শুরু করে আয়রন ম্যান বা ব্যাটম্যান সকলেই এখন বাঙালি কিশোরের স্বপ্নের সাথী হয়ে উঠেছে। এমতাবস্থায় ফেলুকেও কি তাহলে কিছুটা গ্লোবাল হয়ে উঠতে হচ্ছে বিদেশি সুপারহিরোর সঙ্গে পাল্লা দিতে?



‘গ্যাংটকে গণ্ডগোল’ প্রায় সমস্ত বাঙালির ছোটবেলায় পড়া অতি প্রিয় একটি উপন্যাস। নানা চরিত্রের আনাগোনা ও বিভিন্ন ঘটনার ঘনঘটায় একে ফেলুদা সিরিজ়ের অন্যতম সেরা উপন্যাস বলা চলে। সেই উপন্যাস যখন পর্দায় আসে তখন তা নিয়ে কৌতূহল থাকাই স্বাভাবিক।

মূর্তির ইতিহাস দেখিয়ে মূল গল্পে এনে ফেলেছেন অরিন্দম। এরপর ফেলু-তোপসের গ্যাংটক বেড়াতে যাওয়ার পথে শশধর বোসের সঙ্গে আলাপ এবং সেখানে পৌঁছে শিবকুমার শেলভাঙ্করের দুর্ঘটনার খবর পাওয়া। তারপর ক্রমশ নিশিকান্ত সরকার, হেলমুট উঙ্গার, ডঃ বৈদ্যের আবির্ভাব ও রহস্য আরও ঘনীভূত হওয়া। সিরিজ়ের প্রায় সব দর্শক এই কাহিনী জেনেই দেখতে বসবেন। যারা জানেন না, তারা নিতান্তই হাতে গোনা।

আরও পড়ুন: তপন সিংহের সঙ্গে কোনও মিল থাকবে না, জানালেন মিঠুন

মূর্তির ইতিহাস বা নিশিকান্তের পরিবারের কাহিনী যমন্তককে আলাদা গুরুত্ব প্রদান করেছে তাতে সন্দেহ নেই। তবে তারপরে যা ঘটল তাতে করে মূল গল্প কী ছিল তা মনে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। বেশ কিছু চরিত্র নিয়ে আসা হয়েছে গল্পকে পরিবর্ধিত করার জন্য। তার মধ্যে অন্যতম রিনচেং গাংপো (সৌরসেনী), এমএম (কমলেশ্বর) এবং গণেশ গায়তোন্ডে (দেবপ্রিয়)। এদের প্রয়োজনীয়তা খুব একটা ছিল না, তবু গল্পের খাতিরে মেনে নেওয়া যেতে পারে। 

গল্পে পরিবর্তন এনে, নতুন চরিত্র ঢুকিয়ে সে গল্প আর ফেলুর রইল কি? ১৯৭০-এর কাহিনীকে ২০১৭-তে আনার ফলে ফেলু নিঃসন্দেহে অনেক আধুনিক হয়েছে। কিন্তু তার দক্ষতা একই রইল কি? নাকি প্রযুক্তির কল্যাণে মগজাস্ত্র আর তেমন না খাটালেও চলে? নাহলে যেখানে মোবাইল ফোনের টাওয়ার লোকেশন চেক করেই অপরাধীর গতিবিধি ধরে ফেলা যায়, সেখানে প্রদোষ মিত্র না থাকলেও কেসের সমাধান হতো বলেই মনে হয়। ‘সোনার কেল্লা’ ছবিতে মন্দার বোসের বিছে ধরার দৃশ্যটি শুধু সংলাপ দিয়েই শেষ করেছিলেন সত্যজিৎ রায়। মন্দার বোসের চরিত্রে কামু মুখোপাধ্যায়ের নিজে হাতে বিছে ধরে বোতলে ভরার দৃশ্যটি শুট করেও শেষপর্যন্ত ছবিতে রাখেননি সত্যজিৎ। তাঁর যুক্তি ছিল, এতে মন্দার বোসকে ফেলুর থেকে বেশি সাহসী বলে মনে হবে। এখানে রিনচেং যেভাবে কেসের সমাধানের দিকে এগোচ্ছিল (পুলিশ হিসেবে সেটাই তার কর্তব্য) সেখানে ফেলুদাকে আর কোনওভাবেই অপরিহার্য বলা চলে না। 

আরও পড়ুন: রুক্মিণীতেই ভরসা রাখলেন বিরসা

অতৃপ্তি রয়ে গেল বহু জায়গায়। পাঠকমাত্রই জানেন ‘কৈলাশে কেলেঙ্কারি’ গল্পটি ‘গ্যাংটকে’র পরে লেখা। কিন্তু এখানে ফেলুর আবির্ভাবই হচ্ছে যক্ষীর মাথা হাতে কলকাতার রাস্তায়, গুন্ডাদের টার্গেট হয়ে দৌড় দিয়ে। সিনেম্যাটিক কায়দায় তারপরের অ্যাকশন দৃশ্যের মধ্যে যেভাবে ফেলু সেই সুপ্রাচীন, দুষ্প্রাপ্য ও অমূল্য যক্ষীর মাথা পুলিশের দিকে ছুঁড়ে দিল, আর তিনিও লুফে নিলেন, তাতে দর্শক হিসেবে প্রায় পিলে চমকানোর মতো এক অনুভূতি হয়। সিধুজ্যাঠা সেই জায়গায় থাকলে সম্ভবত অজ্ঞান হয়ে যেতেন! আর গুন্ডা পেটানোর পরে ২০১৭-এর আধুনিক ফেলু ১৯৭৯-এর ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এর একটি সংলাপ বলে ওঠে, ‘ঘুঘু দেখেছ ফাঁদ দেখোনি। এবার সাতদিনের জেল, আর তিনদিনের ফাঁসি।’ ২০১৭ সালে এই সংলাপ অত্যন্ত বেমানান। আপাদমস্তক আধুনিক ফেলুর মুখে এমন সেকেলে সংলাপ আরোপিতই লাগে। 

এই গল্পে তোপসের এক বান্ধবী আছে। থাকতেই পারে। আজকালকার ছেলেপুলেরা সত্তরের দশকের মতো ক্যাবলা নয়। তবে পাহাড়ে বসে তার সঙ্গে স্মার্টফোনে ভিডিও কল করা গেলে, সাধারণ ইন্টারনেট লিংক কেন সে ফোনে খোলে না তাই নিয়ে খটকা থেকে যায়। ওদিকে এমএম চরিত্রটি বলা বাহুল্য মগনলাল মেঘরাজকে মাথায় রেখেই তৈরি। টাইটেল কার্ডে তার যে নামই লেখা হোক না কেন, ‘অর্জুন কো বুলাও’ বা শরবতের সংলাপ যিনি বলেন, তিনি কোন এমএম তা বুঝে নিতে ফেলুভক্তদের সময় লাগবে না। যদিও এই চরিত্রটি সিরিজ়ে চমক ছাড়া আর কিছুই যোগ করে না। 

আরও পড়ুন: ঋত্বিক ঘটকের ভূমিকায় শিলাজিৎ

দশ পর্বের সিরিজ় বানাতে গিয়ে গল্পকে পরিবর্ধিত করা ছাড়া উপায় ছিল না। সেক্ষেত্রে মুম্বইয়ের ব্যাকস্টোরি মন্দ নয়। তবে এক্ষেত্রে প্রশ্ন, গণেশ গায়তন্ডে চরিত্রটির নাম অন্য কিছু ভাবা গেল না কেন? অন্য এক সুপারহিট সিরিজ়ের বিখ্যাত চরিত্রের নাম ধার করতে হলো ফেলু কাহিনীতে, এমনটা আগে ঘটেনি। তবু বলা যায় থ্রিলার কাহিনীতে এই পর্ব দেখতে ভালোই লেগেছে। 

আফসোস রয়ে গেল বেশ কিছু বিশেষ দৃশ্যের ক্ষেত্রে। প্রথমত প্ল্যানচেট। এটি ‘গ্যাংটকে গণ্ডগোল’ কাহিনীর সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্য। সেই দৃশ্যের নির্মাণ খুব দায়সারা লাগল। এত আলোতে প্ল্যানচেটের আবহই তৈরি হলো না। পাওয়া গেল না সেই গা ছমছমে অনুভূতিও। এছাড়া রুমটেক মনাস্টেরির লামা ড্যান্সের মতো এক অভূতপূর্ব দৃশ্যকে এতটাই সাদামাটাভাবে দেখানো হলো যে নিশিকান্তের বর্ণনাও এর থেকে বেশি রোমাঞ্চকর ছিল। ডঃ বৈদ্যের ছদ্মবেশ আগাগোড়াই খুব জোলো মেকআপ বলেই বলে হলো। কোনও স্বাভাবিক মানুষের চেহারা ওরকম হয় না। এছাড়া যমন্তক ফেরত পেয়ে আইবি অফিসারের ভক্তিভরে প্রণামও বেশ চোখে লাগে। কোনও দেশের পুলিশই ডিউটির সময় এমন আবেগ দেখায় না। তবে পাথর গড়িয়ে পড়ার জায়গায় ফেলু-তোপসের মকশো করার দৃশ্য দেখতে ভালোই লাগে। 

এবার আসা যাক অভিনয়ে। পরমব্রত ভালো অভিনেতা হওয়া সত্বেও ফেলু চরিত্রে একটু বেশিই সতর্ক হয়ে পড়ার কারণেই হয়তো তাঁকে বেশ আড়ষ্ট মনে হলো। আর একটু সাবলীল হলে হয়তো চোখে লাগত না। কঠিন গাম্ভীর্যের আড়ালে সেই পাশের বাড়ির দাদা ইমেজটা অধরাই রয়ে গেল। 

আরও পড়ুন: জয়সলমেরে সত্যজিৎ রায়ের মূর্তি, উদ্যোগী রাজস্থান সরকার

তোপসে চরিত্রে ঋতব্রত সমসাময়িক তোপসেদের তুলনায় ভালো। তবে তাঁর স্বাভাবিক লুকে অনেক বেশি তোপসে সুলভ দেখতে লাগে। জোর করে লুক বদল না করলেও চলত। আধুনিকতা মানেই ব্যাক ব্রাশ করে চুল আঁচড়ানো নয়। 

ওদিকে রুদ্রনীলকে সম্ভবত নিশিকান্ত ও জটায়ু দুটো চরিত্রকেই মাথায় রাখতে হয়েছে। নাহলে তিনি এমন অতিঅভিনয় কখনও করেন না। নিশিকান্ত মানুষটি সাদাসিধে, ভীতু, ছাপোষা। কিন্তু এমন ননসেন্স নন। অন্তত গল্পে তাকে এতটা অপদার্থ লাগেনি কখনও। শশধরের চরিত্রে ঋত্বিক বেশ ভালো। তবে অন্য চরিত্রটিতে তিনি সংলাপ বলার ক্ষেত্রে একটু বদল আনতে পারতেন। খেয়াল করলেই চেনা যাচ্ছে। শশধর চরিত্রে তাঁর শরীরী ভাষা প্রশংসার দাবি রাখে। শেলভাঙ্কর চরিত্রে অরিন্দম বেশ মানিয়ে গেছেন। হেলমুটের চরিত্রে ক্রিস্টোফার যথাযথ। সৌরসেনী এবং দেবপ্রিয়, দুজনেই পরিচালক সৃষ্ট চরিত্র হলেও নিজেদের প্রমাণ করেছেন। একাধিক দৃশ্যে দুজনের গতিবিধি বলে দেয় পরবর্তীকালে যে কোনও থ্রিলার কাহিনীতে পুলিশ কিংবা গোয়েন্দা চরিত্রে এঁদের আবারও ডাক পড়তে পারে। গুন্ডার চরিত্রে অরিজিৎ মানানসই। 



বিক্রম ঘোষের সুরে সিরিজ়ের শীর্ষসঙ্গীত শুনতে ভালোই লাগে। তবে গোটা সিরিজ় জুড়ে আবহ খুব একটা মন ভরাল না।

থ্রিলার বা গোয়েন্দা ছবির ক্ষেত্রে অরিন্দম আগেও যথেষ্ট কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। তাই এবারেও তেমনটাই আশা ছিল। সিরিজ় তৈরির ক্ষেত্রে গল্পকে টেনে বাড়ানোর একটা প্রবণতা দেখা যায়। কারণটা স্পষ্ট। যত বেশি পর্ব, তত বেশি ইউআরএল, তত বেশি হিট। যেখানে ছয় বা সাত পর্বে গল্প শেষ করা যেত, সেখান সেটিকে টেনে হিঁচড়ে আরও তিন-চারটি পর্ব ধরে টানার চাপেই এত সাবপ্লট আমদানি করতে হয়েছে। থ্রিলার গল্পে মাদক চক্র, অমূল্য মূর্তি, চেজ়, ইত্যাদি দৃশ্য এনে গল্পকে আরও জমাটি করার প্যাটার্ন খুব জনপ্রিয়। এখানে সেই সবই আছে। তবে গল্পটা ফেলুদাকে নিয়ে, আর সমস্যাটা সেখানেই। এই গল্পে ফেলু না থাকলে নিঃসন্দেহে জমাটি থ্রিলার হতো। কিন্তু যে দর্শক ফেলুদা দেখার আশায় বসে আছে, তাঁর ধাক্কা লাগবেই। তার ভক্তদের কাছে ফেলু বরাবরই একমেবাদ্বিতিয়ম। ফেলুর সেই আত্মবিশ্বাস, দাপট, ব্যক্তিত্ব, মগজাস্ত্র সবটাই এখানে অনুপস্থিত। আগামী সিজ়নে একটু ফেলুদাকেও রাখা যায় কিনা ভেবে দেখতে পারেন অরিন্দম।




Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Swati

Editor of a popular Bengali web-magazine. Writer, travel freak, nature addict, music lover, foody, crazy about hill stations and a dancer by passion. Burns the midnight oil to pen her prose. Also a poetry enthusiast.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *