অধিক সন্ন্যাসীতে দানা বাঁধল না গল্প
ছবি: সাদা রঙের পৃথিবী
পরিচালনা: রাজর্ষি দে
অভিনয়ে: শ্রাবন্তী চট্টোপাধ্যায়, সৌরসেনী মৈত্র, অরিন্দম শীল, ঋতব্রত মুখোপাধ্যায়, স্নেহা চট্টোপাধ্যায়, মল্লিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, দেবলীনা কুমার, ঈশান মজুমদার, অনন্যা বন্দ্যোপাধ্যায়, রিচা শর্মা, সোহিনী গুহরায়, দেবশ্রী গঙ্গোপাধ্যায়, ঐন্দ্রিলা বসু
দৈর্ঘ্য: ২ ঘণ্টা ৩৩ মিনিট
RBN রেটিং ★★★★★☆☆☆☆☆
আর্থিক সংস্থান নেই এমন হিন্দু বিধবাদের অবস্থা এ দেশে কোনওকালেই খুব সুখের ছিল না। সেই কারণেই কাশী এবং বৃন্দাবনে তৈরি হয়েছিল একাধিক বিধবা আশ্রম। রাজনৈতিক, ধার্মিক ও অর্থনৈতিক পেশীশক্তির আস্ফালনে বস্তুত এই দেশে মেয়েরা আজও কোথাও নিরাপদ নয়, সে উত্তরপ্রদেশের বারাণসী হোক বা পশ্চিমবঙ্গের কোনও প্রত্যন্ত গ্রাম। এই ছবির বিষয়ও মূলত সেই আশ্রয়হীন মহিলাদের নিরাপত্তার অভাব এবং তাদের অসহায়তার সুযোগ নিয়ে মহিলা কেনাবেচার এক অন্ধকার চক্রকে ঘিরে।
বিধবা হয়ে যেসব বাঙালি মেয়ে বারাণসীতে এসে পৌঁছয় তাদের বেশিরভাগেরই ঠাঁই হয় আভা সেনের (অনন্যা) মুক্তি মণ্ডপে। গত কয়েক বছর ধরে সেখান থেকে হঠাৎ করেই উধাও হয়ে যেতে থাকে কয়েকজন অল্পবয়সী বিধবা। সমাজসেবী শিবানী দেবী (শ্রাবন্তী) অনেক চেষ্টা করেও কিছু করতে পারে না। কারণ তার যমজ বোন ভবানী রয়েছে এই সব মেয়েদের পাচারের মূলে। ওদিকে আভার প্রাক্তন স্বামী করুণানন্দ বাবাজির (অরিন্দম) একান্ত ইচ্ছা এই বিধবা আশ্রমটি উঠে গিয়ে সেই জায়গায় তৈরি হোক নতুন বিলাসবহুল রিসর্ট।
এদিকে এতগুলো মেয়ে উধাও হয়ে যাওয়ার কারণ খুঁজতে সাংবাদিকের ছদ্মবেশে পথে নামে আইপিএস অফিসার সুন্দরলাল দুবে (ঈশান) ও মিস আগরওয়াল (রিচা)। এরই মধ্যে কাশীতে নতুন আসা বিধবা মেয়ে অলক্ষ্মীকে (সৌরসেনী) ভালো লেগে যায় ভবানীর দলের সুনীলের (ঋতব্রত)। সব মিলিয়ে নানা অসম লড়াই চলতে থাকে কাশীর অন্ধকার গলিতে।
আরও পড়ুন: আবারও ‘গল্প হলেও সত্যি’র রিমেক
একটি ছবির ভেতর অনেক অভিনেতা থাকলে—সকলকে সুযোগ দিতে গিয়ে—গুরুত্বপূর্ণ চরিত্ররা যথেষ্ট জায়গা পায় না। তৈরি হয় না মনে রাখার মতো কোনও ফ্রেমও। এই ছবিতেও তেমনটাই ঘটেছে। গল্প দানা বাঁধতে পারেনি কোথাও। রয়ে গেছে অজস্র লুপহোল। বহু প্রশ্নের উত্তর মেলে না। যেমন সুমতি কেন শিবানীর কাছে যেত? সেখান থেকে সে করুণানন্দের কাছে পৌঁছল কীভাবে? আর এতকিছুর পরেও সে মুক্তি মণ্ডপে থেকে গেল কেন? শিবানীর স্বামী পুলিশ অফিসারকে সামনে পেয়েও গোপন ষড়যন্ত্রের খবর তাকে তখনই না জানিয়ে ডাইরিতে লিখে যেতে চাইল কেন, যেখানে সে জানে অপরাধী আশেপাশেই রয়েছে। এমনকী সেই ডাইরি গুছিয়ে রাখার কোনও চেষ্টাও করল না সে। এছাড়াও আভা চরিত্রটির উদ্দেশ্য কোথাও স্পষ্ট নয়। আশ্রম নষ্ট হয়ে যাওয়ার যে দুঃখ তার মধ্যে শেষে দেখা গেল, তাকে বাঁচিয়ে রাখার ছিটেফোঁটা ইচ্ছেও আগে দেখা যায়নি। গুলি লেগে এতগুলো লোক মারা যাওয়া সত্বেও সেভাবে রক্তের দেখা মিলল না কোথাও। এমনকী কাছ থেকে দেখানোর পরেও গুলি লেগে সুন্দরলালের শরীর থেকে একফোঁটা রক্তও বেরোতে দেখা গেল না।
আরও পড়ুন: জাতীয় পুরস্কার থেকে বাদ পড়ল ইন্দিরা গান্ধী ও নার্গিসের নাম
অকারণ যুক্তিহীন কিছু সংলাপ ছবির তাল কেটে দেয় বারবার। ঘুরে ফিরে ‘বাংলা নিজের মেয়েকেই চায়’-এর মতো সংলাপের কোনও প্রয়োজন ছিল না। আবার ‘বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক’ বলার কোনও যুক্তিপূর্ণ সদুত্তর পাওয়া গেল না। সবথেকে বিরক্তির উদ্রেক করে যত্রতত্র ফেলুদার সংলাপ এবং তার উল্লেখ। বেনারস শহর কি বাঙালিকে শুধুই ফেলুদার প্রসঙ্গ মনে পড়ায়? পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন বাসযোগ্য শহরের আর কোনও মাহাত্ম্য চোখে পড়ে না, শুধুমাত্র ফেলুদার সংলাপ ফিরে-ফিরে আসে। এমনকী বেনারসে বাঙালি গোয়েন্দার কীর্তির কথাও স্মরণ করিয়ে দেয় কেউ-কেউ। এই ক্লিশে হয়ে যাওয়া ব্যাপারগুলো থেকে সম্ভবত বাঙালি দর্শকের মুক্তি নেই। আশির দশকের মতো সহজেই অনুমেয় গল্পের প্লট এবং অকারণে বাংলার রাজনীতিকে সংলাপে জড়িয়ে দিয়ে ছবির মূল বিষয়বস্তুর প্রতি অবহেলা ছাড়া কিছুই পাওয়া যায় না।
চিত্রনাট্য বেশ দুর্বল হলেও অভিনেতারা অনেকেই সেই খামতি পূরণ করেছেন। যথেষ্ট দক্ষতার সঙ্গে দুটি চরিত্রের বৈপরীত্যকে ফুটিয়ে তুলেছেন শ্রাবন্তী (Srabanti Chatterjee)। বিশেষ করে ভবানী চরিত্রে দাপটের সঙ্গে অভিনয় করেছেন তিনি। অলক্ষ্মীর চরিত্রে সৌরসেনীকে (Souraseni Maitra) বেশ ভালো লাগে। আর ভালো লাগে ঋতব্রতর (Rwitobroto Mukherjee) সঙ্গে তাঁর চরিত্রের রসায়ন। ঋতব্রতর শরীরী ভাষা অনবদ্য। মল্লিকার সংযত অভিনয় প্রশংসার যোগ্য। ছোট চরিত্রেও স্নেহা (Sneha Chatterjee) একইরকম সপ্রতিভ। স্বল্প পরিসরে চরিত্রের প্রতি সুবিচার করেছেন ঈশান।
আরও পড়ুন: সিক্যুয়েলেই ভরসা?
সৌমিক হালদারের চিত্রগ্রহণ প্রশংসনীয় হলেও বেনারস শহরকে সেভাবে দেখা গেল না কোথাও। যেটুকু সুযোগ ছিল সেখানেও নির্মমভাবে কেটে দেওয়া হলো গঙ্গারতি এবং মনিকর্ণিকা শ্মশানের দৃশ্য। তার বদলে বহু অপ্রয়োজনীয় দৃশ্য অযথা ভারী ও দীর্ঘতর করল ছবিটিকে। যদিও ছবির টাইটেল কার্ড মুগ্ধ করার মতোই। ভালো লাগে জয়তী চক্রবর্তী ও ইমন চক্রবর্তীর কণ্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত।
কাশীতে নারী পাচারের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে ছবি হলেও দুর্বল চিত্রনাট্য, খাপছাড়া সংলাপ এবং কিছু ক্ষেত্রে অভিনয়ের অক্ষমতার জন্য হতাশ করল ‘সাদা রঙের পৃথিবী’ (Sada Ronger Prithibi)।