মধ্যবিত্ত বাঙালির প্রতিদিন, সেরা অভিনয়

ছবি: পালান

পরিচালনা: কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়

অভিনয়ে: অঞ্জন দত্ত, মমতা শঙ্কর, শ্রীলা মজুমদার, যিশু সেনগুপ্ত, পাওলি দাম, দেবপ্রতিম দাশগুপ্ত, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য

দৈর্ঘ্য: ২ ঘণ্টা ৭ মিনিট 

RBN রেটিং ★★★★★★★★☆☆

সুদূর গ্রামদেশের বাড়ি ছেড়ে বাবার হাত ধরে কলকাতায় এসেছিল পালান। বেলতলার ভাড়া বাড়িতে অঞ্জন সেন ও মমতা সেনের বাড়িতে ফাইফরমাশ খেটে, পুপাইয়ের দেখভাল করে দিন কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু এক শীতের রাত্রে বন্ধ রান্নাঘরে ঘুমোতে গিয়ে দম আটকে গেল পালানের। একটাও ঘুলঘুলি না থাকা রান্নাঘরে বিনা প্রতিবাদে নিশ্চুপে মারা গেল সে। নির্মাণের ভুলে প্রাচীন বাড়ি এক কিশোরের মৃত্যুর কারণ হয়ে থেকে গেল। পালানের মৃত্যু অঞ্জন ও মমতাকেও কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু সত্যি কি তারাও একদিক থেকে পরিস্থিতির শিকার ছিল না? ১৯৮২ সালে মুক্তি পেয়েছিল ‘খারিজ’। চার দশক পেরিয়ে কৌশিকের ছবিতে আবার ফিরে এল পালানের প্রসঙ্গ।



চল্লিশ বছর পরেও একই বাড়িতে থাকে অঞ্জন ও মমতা। ছেলে পুপাই (যিশু) ও পুত্রবধূ পাওলি কসবায় নতুন ফ্ল্যাট কিনেছে। কিন্তু ১২সি/১এ বাড়িটার হাল আজ তথৈবচ। দোতলা থেকে সিমেন্টের চাঙর খসে পড়ে মানুষের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে, অথচ বর্তমান বাড়িওয়ালা সমীর (বুদ্ধদেব) ফ্ল্যাট হবে হলে তিনবছর ধরে আশ্বাস দিয়েও কাজ শুরু করতে অপারগ। পুরসভার নোটিসে তিনদিনের মধ্যে বাড়ি ছাড়তে হবে ভাড়াটেদের, অথচ এই মুহূর্তে অন্য কোনও বাড়ি প্রমোটারের হাতে নেই। অগত্যা ছেলের ফ্ল্যাটে জায়গা না থাকলেও সেখানেই আপাতত ঠিকানা বদল করতে হবে সেন দম্পতিকে। এদিকে বাড়ি ছাড়ার আগেই ঘটে যায় অন্য বিপত্তি। কী করবে এবার সেন দম্পতি? উপর্যুপরি এত বিপদের দায় নেবে কে? পুপাইয়ের ছোট্ট ফ্ল্যাটে স্থান সঙ্কুলানের উপায়ই বা কী? কৌশিকের ছবিতে অঞ্জনের অবস্থা যেন অনেকটাই মিলে যায় পালানের সঙ্গে। 

আরও পড়ুন: দেব আনন্দের বাংলো ভেঙে ২২তলার অট্টালিকা?

‘খারিজ’ ছবিতে শিশুশ্রম, সামাজিক পরিকাঠামো এবং তৎকালীন অর্থনৈতিক চিত্রের অনেকটা উঠে এলেও সবথেকে বেশি নজর কেড়েছিল মৃণাল সেনের সোজাসাপটা ন্যারেটিভ। প্রয়োজনের অতিরিক্ত একটিও শব্দ খরচ না করে শুধুমাত্র অভিব্যক্তির দ্বারা একটা গোটা ছবির কাহিনিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার নিদর্শন বাংলায় তেমন নেই। এই একই কাজ কৌশিক করে দেখালেন ‘পালান’-এর ক্ষেত্রে। খুব সাধারণ এবং মধ্যবিত্ত জীবনযাপনের ছবি স্পষ্টভাবে তুলে ধরলেন ছবির পর্দায়, ঘটনার অভিঘাতে যা দর্শকের মনে আঘাত হানতে বাধ্য। কারণ পরিস্থিতির হাতে কমবেশি সকলেই অসহায়, অনেকটা পুপাইয়ের মতোই। 

‘খারিজ’ দেখে থাকলে এ ছবিকে ছোঁয়া হয়তো অনেকটা সহজ হবে। তবে না দেখে থাকলেও ‘পালান’ দেখতে বাধা নেই। কারণ এ সমস্যা অন্তত মধ্যবিত্ত বাঙালির প্রতিদিনের। উচ্ছেদে অভ্যস্ত হয়ে গেলেও পুনর্বাসন পাওয়া যায় না। কোনও ক্ষেত্রেই না। সেই সঙ্গে উঠে আসে বার্ধক্যের সমস্যা। এই ছবিও তো ঘরে-ঘরে। সামাজিক পরিকাঠামোর কবলে পড়ে প্রতিটি পরিবার এখন অণু থেকে পরমাণুতে এসে ঠেকেছে। সাধারণ আলোচনায় কোনও এক পক্ষকে সহজেই দায়ী করা গেলেও, আসল চিত্র তার থেকে অনেক বেশি জটিল। ইচ্ছে থাকলেও পরিস্থিতির চাপে বাড়ির সকলের এক ছাদের তলায় বসবাস করা আর সম্ভব নয়। ছেলেমেয়েরা দূরে থেকেও যথাসাধ্য করে, বা করার চেষ্টা করে, এ কথা অস্বীকার করার জায়গা নেই। পুপাই আর পাওলিও আন্তরিকভাবে চেষ্টা করে। তবু শিকড় ছিঁড়ে কেনই বা চলে যেতে হবে পুরনো বটগাছদের? পরিস্থিতির হাতে ঠিক কতটা অসহায় হয়ে যায় মানুষ, বা কতটা মেনে নেওয়া যায় সেই নিয়েই এই ছবি।

আরও পড়ুন: এত ‘অরণ্য’ কেন?

এত স্পষ্ট এবং মেদহীন ন্যারেটিভ এমনকী কৌশিকের ছবিতেও কমই নজরে এসেছে। পরিষ্কার ও ঋজু চিত্রনাট্য, ঝকঝকে নির্মাণ এবং সেই প্রয়োজনের অতিরিক্ত একটি শব্দও খরচ না করা, সব মিলিয়ে এ ছবি দর্শককে নাড়িয়ে দেয়। 

অভিনয় নিয়ে বলতে গেলে প্রথমেই ‘খারিজ’-এর প্রসঙ্গ আনতে হয়। অঞ্জন ও মমতার দাম্পত্যের সঙ্গে সেই ছবি থেকে উঠে এসেছে শ্রীলা এবং হরি (দেবপ্রতিম) চরিত্র দুটিও। শেষোক্ত দুটি চরিত্রের আঙ্গিক থেকে অবয়ব সবই পাল্টেছে। হরির কৈশোরের চরিত্রে সংলাপ ছিল সামান্য। তার চেয়ে ঢের বেশি শক্তিশালী ছিল তার দৃষ্টি যা কোথাও যেন তিলে-তিলে পুড়িয়ে দিয়েছিল অঞ্জনকেও। এখানে দেবপ্রতিম অনেক বেশি সপ্রতিভ এবং সবাক। ক্ষুরধার দৃষ্টিতে সমীরকে মেপে নিতে সে কসুর করে না। আগের ছবির মতোই এখানেও উজ্জ্বল হয়েই রইলেন দেবপ্রতিম। আন্তরিক ছিলেন শ্রীলা, আগের ছবিতেও। এখানেও তার অন্যথা হয়নি। তবু তারই মধ্যে কোথাও বেশ কিছুটা স্বার্থও যেন জড়িয়ে আছে। সার্থক অভিনয় করেছেন তিনি। যিশু এবং পাওলি দুজনেই চরিত্র অনুযায়ী মানিয়ে গিয়েছেন। কোথাও খাপছাড়া লাগেনি কাউকেই। দুজনেই মিশে গিয়েছে সেন পরিবারে। বিভ্রান্ত পুপাইকে বেশ ভালো লাগে। আন্তরিক ও সেন্সিবল চরিত্রে পাওলি সহজ, সাবলীল। সমীর চরিত্রে বুদ্ধদেব অনবদ্য এবং যথাযথ। 



আসা যাক মূল দুই চরিত্রের কথায়। ‘পালান’-এর জন্য অঞ্জন জাতীয় পুরষ্কার পাবেন কিনা তা সময় বলবে। তবে বাংলা ছবিতে এমন অসামান্য অভিনয় হাতে গুনে পাওয়া যায় এ কথা ভনিতা না করেই বলা যায়। তাঁর অভিনয় জীবনের অন্যতম সেরা কাজ হয়ে রইল এই ছবি। সত্তর পেরিয়ে আজও তিনি সোজা দাঁড়িয়ে দাপটের সঙ্গে স্টেজ কাঁপিয়ে গান করেন। সেখানে এক অশীতিপর, পঙ্গু মানুষের অভিনয় এবং প্রতিটি অভিব্যক্তি এত নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তোলা সহজ কাজ ছিল না। অঞ্জন তা করেছেন অনায়াসে। অভিনেতা হিসেবে তাঁর মূল্যায়ন করার ক্ষমতা এই সময়ে দাঁড়িয়ে প্রায় অসম্ভবের পর্যায়ে পড়ে। তবু খুব কম পরিচালকই তাঁকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পেরেছেন, এ বড় আফসোসের বিষয়।

গোটা ছবি জুড়ে অঞ্জনের স্ত্রীর চরিত্রে স্বামীকে যোগ্য সঙ্গত করে গেছেন মমতা শঙ্কর। কী তার দাপটের সঙ্গে, কী তার সিদ্ধান্তের দৃঢ়তার সঙ্গে, কী তার রাগের সঙ্গে হাল ধরে থেকেছেন তিনি। এমন চরিত্রও আজকের দিনে বিরল। মমতা শঙ্করই পারতেন, পেরেছেনও। আর বলতেই হয় মমতা শঙ্কর-অঞ্জনের রসায়নের কথা। প্রায় সত্তরের দোরগোড়ায় এসে আজও যে রসায়ন দেখালেন প্রবীণ দুই শিল্পী তার সামনে যিশু-পাওলির সোচ্চার প্রেমও যেন কিছুটা ফিকে হয়ে গেল। 



চিত্রগ্রহণ ও সম্পাদনা দুই বিভাগেই প্রশংসার দাবী রাখে ‘পালান’। বেলতলায় অবস্থিত প্রাচীন বাড়িটি এ ছবির অন্যতম চরিত্র। বাড়ির প্রতিটি ইঁট, কাঠ, পাথরকে চিনিয়ে দেবে বোবা দৃশ্যপট। এর সঙ্গেই যার কথা না বললেই নয় তিনি নীল দত্ত। এ ছবির আবহ সঙ্গীতের অভিঘাত কতটা, সেটা দর্শক মাত্রেই বুঝবেন কারণ কিছু মুহূর্তে আতঙ্ক তাড়া করে বেড়ায় শুধুমাত্র আবহের কারণে। মনে রাখার মতো সঙ্গীত উপহার দেওয়ার জন্য নীলের ধন্যবাদ প্রাপ্য। 

সাধুবাদ কৌশিককেও, ‘খারিজ’কে মনে করিয়ে দেওয়া বা মৃণাল সেনকে ট্রিবিউট দেওয়ার জন্য নয়, বর্তমানকালের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাস্তবধর্মী ছবিটির পাচক হওয়ার জন্য। বড়পর্দায় এ ছবির প্রতিটি দৃশ্য যে রেশ রেখে গেল, তা দর্শককে শিহরিত করবে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।




Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Swati

Editor of a popular Bengali web-magazine. Writer, travel freak, nature addict, music lover, foody, crazy about hill stations and a dancer by passion. Burns the midnight oil to pen her prose. Also a poetry enthusiast.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *