রক্তস্রোতের সঙ্গে মিশল স্যাটায়ার
ছবি: ভাগ্যলক্ষ্মী
পরিচালনা: মৈনাক ভৌমিক
অভিনয়ে: ঋত্বিক চক্রবর্তী, শোলাঙ্কি রায়, লোকনাথ দে, নীল মুখোপাধ্যায়, সুব্রত দত্ত, যুধাজিত সরকার, স্বস্তিকা দত্ত, দেবপ্রিয় মুখোপাধ্যায়
দৈর্ঘ্য: ২ ঘণ্টা ১৫ মিনিট
RBN রেটিং ★★★★★★★☆☆☆
লাগ ভেলকি…’ভাগ্যলক্ষ্মী’! না, এই ছবির নামকরণের সঙ্গে লটারির কোনও যোগ নেই। মানে, সরাসরি কোনও যোগ নেই। তবে শেষে একখানা ভেলকি আছে বটে! যেটা আপাদমস্তক একটা থ্রিলারকে, আংশিক কমেডি বলে ভাবাতে পারে। কীভাবে? উত্তর নিয়ে হাজির মৈনাক।
নিঝুম রাতে, শুনশান শহরের রাস্তায় ব্যাগবন্দি লাশ নিয়ে ঘুরছে বিভ্রান্ত সত্য (ঋত্বিক) আর কাবেরী (শোলাঙ্কি)। মজার ছলে পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে সেই লাশ পুঁতে দিচ্ছে মাটিতে। এদিকে মন্ত্রী ঘনিষ্ঠ রানাদার (লোকনাথ) ₹১০ কোটি গায়েব। সে টাকার জন্য চাপ দিচ্ছে ছোটবেলার বন্ধুকে, যে এখন মন্ত্রী। অন্যদিকে পুলিশ হন্যে হয়ে খুঁজছে ড্রাগ পাচারকারীদের। এই তিনটি বিন্দুকে ঘিরে রহস্য দানা বেঁধেছে মৈনাকের ছবিতে।
ছবির শুরুতেই হাড়হিম করা দৃশ্য। একটা বড় ব্যাগ, গাড়ি থেকে হিঁচড়ে নামায় সত্য-কাবেরী। দুজনের চোখে মুখেই ভয়, অস্বস্তি, কুণ্ঠার ছাপ। ঘটনার সূত্রপাত তিনদিন আগে। যেদিন রাতে গাঙ্গুলিবাড়িতে আসে সায়ন। যে নিজেকে সত্যর স্কুলের বন্ধু বলে দাবি করে। মিডিয়াতে কাজ করে সত্য। সততা দিয়ে সে যে ঘটনা মানুষের সামনে আনতে চায়, তাতে বাধ সাধে সম্পাদক। লোককে খাওয়াতে হবে, এমন খবর চাই। চাকরি হারায় সত্য। সুখে, দুখে, আনন্দে- বাঙালি আর যাই করুক না কেন একটু আধটু মদ্যপান তো করবেই। সত্যও আলাদা নয়। চাকরি খুইয়ে, ছেলের পড়াশোনার খরচ, সংসার এতকিছু সব চালাবে কী করে!
আরও পড়ুন: শেষ দৃশ্যে ভাঙা হোল্ডার, সত্যজিতের জয়জয়কার
এইসব নিয়ে সত্য যখন নাজেহাল, তখনই তার জীবনে আসে সায়ন। বন্ধুকে সে চিনতে না পারলেও, তার অনুরোধ সে ফেরাতে পারে না। সায়নকে নিয়ে চলে আসে বাড়িতে। ডিনার টেবিলে কাবেরী জানতে পারে সত্যর চাকরিটা আর নেই। খুব স্বাভাবিকভাবেই রাতের ঘুম উড়ে যায় তার। সায়নকে নিয়েও টেনশন। বরের চাকরি নেই, তার বন্ধু যদি একদিন বলে তিনদিন থেকে যায় তখন কি করে সামলাবে সে? এরই মধ্যে আচমকা এক বিকট আওয়াজ রাত্রিবেলা। কোনওরকমে রাতে ঘুম থেকে সত্যকে টেনে তোলে কাবেরী। চুপি-চুপি গিয়ে দেখতে পায় বাথরুমে পড়ে রয়েছে সায়নের নিথর দেহ। পাশে তার নেশা করার ব্যাগ। কী করবে ভেবে না পেয়ে অস্থির হয়ে ওঠে গাঙ্গুলি দম্পতি। লাশ টেনে নিয়ে এসে রাখে রান্নাঘরের সামনে। ঘরে গিয়ে সায়নের ব্যাগ খুলতেই চক্ষু চড়কগাছ। এক ব্যাগ টাকা।
এদিকে সেই ₹১০ কোটির সন্ধানে গাঙ্গুলিবাড়িতে তল্লাশি করতে এসে খুন হয় অন্য এক পুলিশ অফিসার। আরও জটিল হয়ে ওঠে বিষয়। সত্য-কাবেরী কি কোনও ড্রাগ ব্যবসায় জড়িয়ে যাবে? নাকি ওই হারিয়ে যাওয়া টাকার জন্য চরম দাম দিতে হবে তাদের? গোটা ছবি জুড়ে এই দুটো প্রশ্নই তাড়া করে বেড়ায়।
ড্রাগ মাফিয়া চরিত্রে লোকনাথ অনবদ্য। এক চোখে লেন্স, মাথায় ঝুঁটি, সঙ্গে লেডি বডিগার্ড। বাংলা ছবিতে এরকম ড্রাগ মাফিয়া দেখা যায় না সচরাচর। পুলিশ অফিসারের চরিত্রে দক্ষতা দেখিয়েছেন নীল। ঘনঘন সিগারেট খাওয়া বাদ দিলে বাকিটুকু বেশ। ক্যামিও চরিত্রে স্বস্তিকার লুক নিঃসন্দেহে নিখুঁত। কাবেরীর সঙ্গে চা খেতে-খেতে ঘুমিয়ে পড়া, সুগার ড্যাডির সঙ্গে বন্ধুত্ব এসবকিছু তিনি বেশ নিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। কোথাও না কোথাও, পরিচালকও সমাজের বাস্তবতাকে টেনে এনেছেন চিত্রনাট্যে। সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে কত দ্রুত বদলাচ্ছে মানুষ, মানসিকতা তা দেখাতে চেয়েছেন তিনি।
আরও পড়ুন: গার্হস্থ্য হিংসার শিকার, তবুও ঔজ্জ্বল্যে অম্লান
ওটিটির যুগে থ্রিলার চলছে রমরমিয়ে। ঢেলে থ্রিলার ছবি বা সিরিজ বানানো হচ্ছে। খুন, রগরগে যৌনতা, অশ্লীল ভাষা সেসব ছবিকে অন্য মাত্রা দিচ্ছে। তবে তার থেকে অনেক দূরে ‘ভাগ্যলক্ষ্মী!’ পরিবর্তে, রক্তস্রোত কিছুটা মৃদু করতে সাহায্য করে কৌতুক। আর সেটা নিখুঁত ভাবে করেছেন ঋত্বিক। লাশ কেটে টুকরো করার আগে ইন্টারনেট দেখা, কিংবা লাশ টুকরো করতে গিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলা, লাশ মাটিতে রেখে বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া এসব বোধহয় সত্য-কাবেরী জুটির জন্যই সম্ভব। এত লড়াই করেও কি ₹১০ কোটি হাতছাড়া হতে দেবে সত্যর ‘ভাগ্যলক্ষ্মী’?
ছবিতে আলো ও আবহ এক কথায় অসাধারণ। তবে যেহেতু এটি নিছক পারিবারিক গল্প, তাই বাড়ির বৈঠকখানা হোক বা বেডরুম আর একটু আলো হলে মন্দ হতো না। তবে সে পার্থক্য খুব কম জায়গাতেই চোখে পড়েছে। গানে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন অনুপম রায়। তবে এই ছবির সেরা প্রাপ্তি শিল্পীদের অভিনয় গুণ।
গড়পড়তা থ্রিলার ছবি তো অনেকই বেরোয় প্রায় প্রতি শুক্রবার। তার মধ্যে অনেকটাই অন্যরকম ‘ভাগ্যলক্ষ্মী’।