শীতের রাতে ঘরে বসে জমে যাবে অ্যাডভেঞ্চার
সিরিজ: ফেলুদা ফেরত (ছিন্নমস্তার অভিশাপ)
পরিচালনা: সৃজিত মুখোপাধ্যায়
অভিনয়ে: টোটা রায়চৌধুরী, অনির্বাণ চক্রবর্তী, কল্পন মিত্র, ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়, অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায়, ঋষি কৌশিক, সমদর্শী দত্ত, পৌলমী দাস, কৃষ্ণেন্দু দেওয়ানজী, অদৃজা দত্ত
দৈর্ঘ্য: ১৫০ মিনিট
RBN রেটিং: ৩.৫/৫
শীতের ছুটি আর ফেলুদা চিরকালই যেন একতারে বাঁধা। ফেলুদাদের গায়ে গরম জামা—তা সে গল্পেই হোক কিংবা পর্দায়—রহস্যটা যেন একটু বেশি করেই ঘনিয়ে দেয়। তবে একদিকে রায় পরিবারের বাইরে ফেলুদার কাহিনী দেখা আবার প্রথম কোনও বাংলা ওয়েব সিরিজ়ের প্রেক্ষাগৃহে প্রিমিয়র, এগুলোই বলে দেয় ফেলুদার আবির্ভাব চিরকালই স্পেশ্যাল। আর সত্তরের দশকের প্রেক্ষাপটে যদি ফেলুদার আগমন ঘটে তাহলে উত্তেজনার পারদকে আটকে রাখা একটু কঠিন হয়ে পড়ে।
নিছক বেড়াতে গিয়ে রহস্যে জড়িয়ে পড়া ফেলুদার গল্পে খুব স্বাভাবিক ঘটনা। বহু গল্পেই এমনটা ঘটেছে, ‘ছিন্নমস্তার অভিশাপ’ও ব্যতিক্রম নয়। হাজারীবাগে মক্কেল সর্বেশ্বর সহায়ের ফাঁকা বাংলোয় ছুটি কাটাতে গিয়ে চৌধুরী পরিবারের সঙ্গে ফেলু, তোপসে, জটায়ুর আলাপ হয়। বাড়ির কর্তা মহেশ চৌধুরীর আমন্ত্রণে রাজরাপ্পায় তাদের সঙ্গে পিকনিক করতে গিয়ে ঘটে দুর্ঘটনা। তারপর এক অদ্ভুত রহস্য সমাধানে ফেলুদাকে জড়িয়ে পড়তে হয়। কথার খেলার মারপ্যাঁচে অভ্যস্ত মহেশবাবুর ডায়েরিতে পাওয়া যায় অজস্র হেঁয়ালি, যার অর্থ বোঝা খুব কম লোকের পক্ষেই সম্ভব। সেই হেঁয়ালির প্রতি ছত্রে লুকিয়ে থাকে রহস্য উন্মোচনের সূত্র।
সত্যজিৎ রায়ের লেখা ফেলুদা সিরিজ়ের গল্প ‘ছিন্নমস্তার অভিশাপ’ প্রায় সবারই পড়া। এরকম ক্ষেত্রে পর্দায় অজানা কিছু দেখার আশা যেহেতু থাকে না, তাই পরিচালকের উপস্থাপনাই একমাত্র চমকের সৃষ্টি করতে পারে। সেই কাজটা আরও কঠিন হয়ে পড়ে যখন রহস্যের জট খোলাই প্রধান ক্লাইম্যাক্স হয়ে দাঁড়ায়। সেই দায়িত্ব নিঃসন্দেহে সুষ্ঠুভাবে পালন করেছেন সৃজিত। বইয়ের পাতায় একটা গল্প যেভাবে গড়ে ওঠে, ছবির পর্দায় তাকে আনতে গেলে কিছু বদল অবশ্যম্ভাবী। সেটাকে বদল না বলে বরং কাহিনীকে চলচ্চিত্রের উপযোগী করা হিসেবে দেখাই ভালো।
আরও পড়ুন: জটায়ুর সাহস
ফেলুদা সিরিজ়ের অন্যতম সেরিব্রাল বা মস্তিষ্কনির্ভর কাহিনী হলো ‘ছিন্নমস্তার অভিশাপ’। এই গল্পেই ফেলুদাকে তার মগজাস্ত্র খাটাতে হয়েছে সবচেয়ে বেশি, কারণ মহেশ চৌধুরীর ডায়েরিতে লেখা হেঁয়ালিই ছিল সমস্ত রহস্যের চাবিকাঠি। তার ওপর এই কাহিনীতে তেমন কোনও অ্যাকশন দৃশ্যও নেই।
তবে যে আছে, সে হলো সুলতান। সেই সুলতান নামক বাঘটিকে যেভাবে দেখানো হয়েছে, তাতে মূল কাহিনীর দৃশ্যগুলো প্রায় হুবহু পর্দায় দেখবেন দর্শক। তবে শুধুমাত্র সুলতান নয়, কলাকুশলীদের বাদ দিয়ে শুধু লোকেশন ও সেটের দিকে নজর দিলেও সহায়ের বাংলো থেকে শুরু করে মহেশ চৌধুরীর বাড়ি, কিংবা ভেড়া নদীর ধারে পিকনিক স্পট যেটা আদতে ডুয়ার্সে শুট করা, সবই যেন একেবারে বইয়ের পাতা থেকে উঠে এসেছে। বহুদিন পর জটায়ুর সবুজ অ্যাম্বাসাডর গাড়িও যেন চোখকে আরাম দেয়।
আরও পড়ুন: পাকদণ্ডীর পথে পথে দেওরিয়াতাল
তবে কিছু জিনিস সামান্য হলেও চোখে লাগে। সেগুলোর উল্লেখও প্রয়োজন। হাজারীবাগের রাস্তায় প্রীতিন্দ্রর সঙ্গে দেখা হয়ে আলাপ হওয়া এবং তিনি লিফট চাওয়ার আগেই ফেলুদার তাঁকে গাড়িতে উঠে পড়তে বলা একটু অস্বাভাবিক। এছাড়া মহেশবাবুর বাড়ি ঘুরে দেখার সময় সকলের পায়ে জুতো দেখতেও অস্বস্তি হয়। বাংলার বাইরে হলেও গল্পটা বাঙালি প্রেক্ষাপটেই। তাই বাংলার সংস্কৃতি অনুযায়ী জুতোটা দরজার বাইরে খোলাই দস্তুর। এরকম ছোটখাটো কিছু ত্রুটি চোখে না পড়ার মতোই, যেগুলোকে উপেক্ষা করাই যায়।
মূল গল্পে মহেশবাবুর অতীতের সব ঘটনাই এসেছে ফেলুদার জবানিতে। অর্থাৎ ফেলুদা যখন যেভাবে হেঁয়ালির অর্থ বার করেছে, পাঠকও সেভাবেই জেনেছে অতীতের ঘটনা। সিরিজ়ে সেই একই ঘটনা দুটো আলাদা সময়কালে এসেছে গল্পের ফাঁকে-ফাঁকে। এমনকি গল্পের শেষে সকলের উপিস্থিতিতে ফেলুদার রহস্য বিশ্লেষণের চেনা ছবিও সৃজিতীয় স্টাইলে কিছুটা ফ্ল্যাশব্যাকে এসেছে, যেটা ছবিকে আরও প্রাঞ্জল হতে সাহায্য করেছে। ফেলু কাহিনীর এই অচেনা উপস্থাপনা নিঃসন্দেহে একটা নতুনত্বের স্বাদ এনে দেয়। তোপসে ও লালমোহনের উপস্থিতিতে ফেলুদার ভাবনার প্রতিটা ধাপের ভিজ়ুয়ালাইজেশন পর্দায় দেখতে দিব্যি লাগে। ভালো লেগেছে ফেলুদার নিজস্ব স্টাইলে ছিন্নমস্তার স্বরূপ বর্ণনা। এই উপরি পাওনাগুলোর জন্য পরিচালকের প্রশংসা প্রাপ্য।
বাঘের উপস্থিতি এই গল্পকে এক অন্য মাত্রা দেয় বলাই বাহুল্য। ২০২০ সালে দাঁড়িয়ে আসল বাঘ নিয়ে শুটিং করা অসম্ভব এ কথা জানা থাকলেও দৃশ্যগুলো আসলের চেয়ে কোনও অংশে কম লাগেনি। পর্দার বাঘ প্রতিবারেই হৃদস্পন্দন বাড়িয়ে দিয়েছে।
আরও পড়ুন: সব কান্নার শব্দ হয় না, বেজে উঠল পটদীপ
সিরিজ়ের সংলাপ মূলত কাহিনীকেন্দ্রিক হলেও চিত্রনাট্যের প্রয়োজনে কিছু নতুন সংলাপ রাখতেই হয়। বলা বাহুল্য সম্পূর্ণ সিরিজ়েই তা যথেষ্ট ‘ফেলুদাচিত’ লেগেছে। এই গল্পকে পর্দায় আনার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল ১৯৭০-এর আশেপাশের সময়কালটাকে ধরা। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পরিচালক তা অত্যন্ত মুন্সিয়ানার সঙ্গে করেছেন।
এবার আসা যাক অভিনয়ে। ফেলুদার ভূমিকায় টোটাকে সুন্দর মানিয়েছে। সিগারেট টানা থেকে শুরু করে রহস্য নিয়ে মাথা খাটানো, সব জায়গাতেই তিনি সফল ফেলুদা হয়ে উঠেছেন বলাই যায়। গোয়েন্দা প্রদোষ মিত্রর ভূমিকায় উচ্চতার সামান্য ঘাটতি তিনি শরীরী ভাষা ও স্মার্টনেসে পুষিয়ে দিয়েছেন। তোপসের ভূমিকায় প্রতিটি দৃশ্যে অসম্ভব ভালো পরিমিতিবোধের পরিচয় দিলেন কল্পন। ঠিক যতটুকু হলে তোপসে হয়ে ওঠা যায়, তার চেয়ে একটুও বাড়তি করেননি তিনি।
এরপর অবধারিতভাবে আসে জটায়ুর কথা। এই চরিত্রটিকে ঘিরে বাঙালি পাঠকের বড় দুর্বলতা। অনির্বাণ ভালোই উৎরে গেছেন সেই ভূমিকায়। তবে আগামীদিনে তাঁর থেকে আরও নিখুঁত লালমোহনের প্রত্যাশা থাকবে। মহেশবাবুর চরিত্রে ধৃতিমান মানানসই। অরুণরূপে অরিন্দম চরিত্রের প্রয়োজন পূরণ করেছেন। প্রীতিন্দ্র ও নীলিমার ভূমিকায় সমদর্শী ও পৌলমী যথাযথ।
বীরেন্দ্র চৌধুরী বা কারান্ডিকার ফেলুদা কাহিনীর একটি অন্যতম আইকনিক চরিত্র। চেষ্টা করলে এই ভূমিকায় ঋষি কৌশিক আরও একটু ধার হয়তো আনতে পারতেন। তবু শুরুর দিকে সুলতানের প্রসঙ্গে লালমোহনবাবুকে তাঁর সন্তান আছে কিনা জিজ্ঞাসা করার মুহূর্তে কারান্ডিকার দর্শকের হৃদয়কে ছুঁয়ে যাবেন, হয়তো সংলাপের গুণেই। শংকরলালের ভূমিকায় কৃষ্ণেন্দুকে ভালো লেগেছে।
কিছু ছোটখাটো ত্রুটি থাকলেও সব মিলিয়ে ছিমছাম পরিচালনা ও চিত্রগ্রহণের যুগলবন্দী এবং কাহিনী উপস্থাপনে নতুনত্ব শীতের রাতে ঘরে বসে ফেলুদার অভিযান জমিয়ে দেবে এমনটা আশা করাই যায়।