অজানা ক্লাইম্যাক্সই ভরসা
ছবি: ব্যোমকেশ হত্যামঞ্চ
পরিচালনা: অরিন্দম শীল
অভিনয়ে: আবীর চট্টোপাধ্যায়, সোহিনী সরকার, পাওলি দাম, সুহোত্র মুখোপাধ্যায়, লোকনাথ দে, কিঞ্জল নন্দ, অর্ণ মুখোপাধ্যায়, পদ্মনাভ দাশগুপ্ত, অনুষা বিশ্বনাথন
দৈর্ঘ্য: ২ ঘন্টা ৯ মিনিট
RBN রেটিং: ৩/৫
মহাভারতের বিরাটপর্ব কমবেশি সকলেরই জানা। বিরাটরাজার সেনাপতি কীচক, দ্রৌপদী লাভের কামনায় মত্ত হয়ে ওঠে। ওদিকে দ্রৌপদী তার স্বামী ভীমের কাছে এই অপমানের জবাব চায়। পরে দুজনের পাতা ফাঁদে কীচক নিজেই ধরা দেয়। দ্রৌপদী তাকে একটি গোপন জায়গায় একাকী সাক্ষাতের জন্য অনুরোধ করেন। কীচক কথামতো সেই স্থানে পৌঁছলে জানতে পারে যে সেখানে দ্রৌপদীর ছদ্মবেশে রয়েছে ভীম। ঘটনাস্থলে ভীমের হাতে কীচকবধ সাঙ্গ হয়। কিন্তু নাটকের এখানেই শেষ নয়। বিরাটপর্বের সেই কাহিনীকেই সময়োপযোগী করে রহস্য ঘনীভূত হয়েছে। তাঁর ছবিতে সেই ভীমই হয়ে গেছে থিয়েটার মালিক বিশ্বনাথ পাল।
সত্তরের দশকে উত্তর কলকাতায় বাংলা বাণিজ্যিক থিয়েটারের রমরমার পটভূমিতে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছিলেন ‘বিশুপাল বধ’। তবে স্রষ্টার মৃত্যুর কারণে ব্যোমকেশ সেই রহস্যের কিনারা করে যেতে পারেনি। যেহেতু গল্পটি অসমাপ্ত, তাই অরিন্দম ও চিত্রনাট্যকার পদ্মনাভর হাতে কীভাবে বিশুপাল খুনের কিনারা হয়, সেটিই ‘ব্যোমকেশ হত্যামঞ্চ’-এর মূল আকর্ষণ, সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জও বটে।
শিকার এক, শিকারী অনেক। শরদিন্দুর পথ অনুসরণ করেই অরিন্দম ও পদ্মনাভ এই ছবির রহস্য উন্মোচন করেছেন। তবে রহস্য তেমনভাবে জমাট বাঁধতে পারেনি। অসামাজিক কর্মকান্ড চালিয়ে যাওয়া, কালীচরণের শ্যালিকা মালতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা, ব্রজদুলালের কাছ থেকে সুলোচনাকে সরে আসতে প্ররোচনা দেওয়া, সুলোচনা ও সোমরিয়ার অন্তর্দ্বন্দ্ব, বিশ্বাসঘাতকতা, এইসব ঘটনার মূলে একজনই। রাজনীতির পালাবদলে সেই সময়ের কলকাতার সমাজে ও সাংস্কৃতিতে যে অবক্ষয়ের বীজ রোপণ করা হয়েছিল, সেই শিকড় এই প্রজন্মের প্রতিটি স্তরে সাধারণ মানুষকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে। ছবির মাধ্যমে তা স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়েছেন পরিচালক।
আরও পড়ুন: নেপথ্যে গাইলেন জলি, স্টেজে দাঁড়িয়ে ঠোঁট মেলালেন রাহুল দেব বর্মণ
এমনিতেই উত্তর কলকাতার বনেদিয়ানা এবং দক্ষিণের আধুনিকতা নিয়ে দুপক্ষের মাঝে একটি অদৃশ্য লক্ষণরেখা টানা আছে। সেটিই আরও গাঢ় হলো প্রতুলবাবু এবং ব্যোমকেশের চায়ের রঙে।
সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পরিহিত বাঙালির প্রিয় গোয়েন্দার চরিত্রে আবীর নিজের জায়গা পাকা করেই রেখেছিলেন। এই গল্পে সেই পুনরাবৃত্তি ঘটল। সত্যবতীও (সোহিনী) তাই। তবে সত্যান্বেষীর সহচরী হিসেবে সোহিনীকে তেমন দৃপ্ত লাগেনি। সুলোচনার চরিত্রে পাওলি অনবদ্য। তবে দ্রৌপদী হিসেবে সুলোচনাকে মানায়নি। ইদানিং অজিতের ভাবগতিক দেখে ব্যোমকেশ তার উপর বিশেষ ভরসা করতে না পারলেও, সেই চরিত্রে সুহোত্র যে দর্শকের ভরসাযোগ্য হয়ে উঠছেন সে কথা বলাই বাহুল্য।
আরও পড়ুন: শেষের সেদিন, উপস্থিত ছিলেন শুধু মহেশ ও ড্যানি
ওদিকে ভীম ওরফে বিশুপালের চরিত্রে কিঞ্জল এক কথায় অসাধারণ। একদিকে ভীমের বাচনভঙ্গি, অন্যদিকে সুলোচনার প্রতি বিশুপালের শরীরী আবেদন, এই দুইয়ের মিশ্রণে কিঞ্জল দুর্দান্ত। তবে ব্রজের দুলাল অর্থাৎ কৃষ্ণের মতো স্থিতধী হতে অর্ণকে আরও অনেকটা পথ পেরোতে হবে । এই গল্পে ব্যোমকেশের রহস্য উন্মোচন নিঃসন্দেহে কৌতূহলের একটি বিষয়। তা ছাড়াও সোমরিয়া অর্থাৎ অনুষার ক্যাবারে নাচ দর্শকের জন্য উপরি পাওনা।
ব্যোমকেশ, অজিত, সত্যবতী, সুলোচনা, বিশুপাল, ব্রজদুলাল ছাড়া ছবির এক নেপথ্য নায়ক হলেন কালীচরণ ওরফে কালীকিঙ্করের চরিত্রে লোকনাথ। ‘মন্দার’-এ তাঁর জাত চিনিয়েছিলেন লোকনাথ। সাধারণ মানুষ থেকে নায়ক হয়ে ওঠার পথে কালীচরণের মতো চরিত্রেরা পাশে থাকলে, তবেই নায়কের পথ সুগম হয়।
কালীকিঙ্করের জবানবন্দি দিয়েই অসমাপ্ত থেকে গিয়েছিল ‘বিশুপাল বধ’। সেখান থেকেই হাল ধরল ব্যোমকেশ। যে মঞ্চে বিশুপালের মৃত্যু হয়েছিল, সেখানেই নাটকের চরিত্রদের নিয়ে ব্যোমকেশ ফিরে এল। অনেকটা এখনকার গোয়েন্দাদের মতোই।
কিছু অসঙ্গতি চোখে পড়ল। পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে অত দর্শকের মাঝে ক্ষীণ কাচের চুড়ির আওয়াজ কী করে শুনতে পেলেন প্রতুলবাবু? রহস্য যখন ক্রমে উন্মোচন হচ্ছে ঠিক তার আগে ব্যোমকেশ হঠাৎ নূপুরের আর কাচের চুরির আওয়াজের মিল খুঁজে পেল। আবার দুপুরে সুলোচনার সাজগোজের টেবিলের দু’ধারে মোমবাতি জ্বলছিল কেন তা বোঝা গেল না। মনীশের স্ত্রী কেনই বা আলাদা করে ব্যোমকেশের সঙ্গে দেখা করল, সত্যবতীর কাছে ঘটনা খোলসা করা হলো না কেন, সে নিয়েও প্রশ্নচিহ্ন থেকে যায়।
ছবির আবহে দুটি গানের ব্যবহার করেছেন সঙ্গীত পরিচালক বিক্রম ঘোষ। না করলেও চলতো। অর্ণব চট্টোপাধ্যায়ের চিত্রগ্রহণ ভালো।
আরও পড়ুন: বেহিসেবী জীবনযাপন, আজ স্মৃতির অতলে সৌমিত্র
কোনও লেখকের অসমাপ্ত গল্প শেষ করার মতো গুরুদায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে যথেষ্ট সাহসের প্রয়োজন। সেই অনুযায়ী চিত্রনাট্য ঠিকঠাক এগোলেও শেষের দিকে কোথাও যেন রাশ আলগা হয়ে যায়। আর পাঁচটা গোয়েন্দা কাহিনীর সঙ্গে শরদিন্দুর গল্পকে গুলিয়ে ফেলা চলে না। গোয়েন্দা কাহিনীতে কোন উপাদান কতটুকু পরিমাণে মেশালে শরদিন্দুর ব্যোমকেশ তার আভিজাত্য বজায় রাখতে পারবে, সেটা বোঝা অত্যন্ত জরুরি।
তবে অন্যান্য ব্যোমকেশ কাহিনীর ক্লাইম্যাক্স জানা থাকলেও, ‘বিশুপাল বধ’-এর ক্ষেত্রে তা অজানা। তাই ‘ব্যোমকেশ হত্যামঞ্চ’ দেখার জন্য দর্শকের আলাদা আগ্রহ থাকবেই। তাই হুডানইটেই ভরসা রেখেছন অরিন্দম।