লগনচাঁদা নয়, এ ব্যোমকেশ অ্যাকশন হিরো

ছবি: ব্যোমকেশ ও দুর্গরহস্য

পরিচালনা: বিরসা দাশগুপ্ত

অভিনয়: দেব, অম্বরীশ ভট্টাচার্য, রুক্মিণী মৈত্র, শান্তিলাল মুখোপাধ্যায়, রজতাভ দত্ত, সত্যম ভট্টাচার্য, দেবেশ চট্টোপাধ্যায়

দৈর্ঘ্য: ২ ঘণ্টা

RBN রেটিং ★★★★★★☆☆☆☆

বাঙালির নিজস্বতা বলতে যেমন রবি ঠাকুর, উত্তমকুমার, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, যেমন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কিংবা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, অনেকটা তেমনই শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। বা বলা ভালো শরদিন্দু সৃষ্ট ব্যোমকেশ বক্সী। তার তুখোড় বুদ্ধিমত্তা, অসাধারণ সেন্স অফ হিউমার, প্রখর অনুমান ক্ষমতা এবং অপ্রতিরোধ্য বাঙালিয়ানা, এই সবকিছু নিয়েই ব্যোমকেশ সত্যান্বেষী। বাঙালির সেই চিরচেনা ব্যোমকেশ যখন ছবির পর্দায় ফিরে-ফিরে আসে তখন দর্শকের কৌতূহল থাকাই স্বাভাবিক। ছিলও তাই। প্রত্যাশা পূরণ হলো কি? 



এক প্রাচীন বাঙালি রাজবংশ—যার ইতিহাস ততটাও গৌরবান্বিত নয়—বাস করে পাহাড়ের মাথার ওপর এক বাড়িতে। এর পাশের পাহাড়ের চূড়ায় রয়েছে একটি দুর্গ, যা ওই পরিবারেরই মালিকানাধীন। রামকিশোর সিংহ (রজতাভ) তার চার ছেলেমেয়েকে নিয়ে সেই বাড়িতে বসবাস করেন। তার বড়ছেলের স্ত্রী ও বড়মেয়ে কিছুকাল আগে দুর্ঘটনায় মারা গেছে। এছাড়াও থাকে জামাই মনিলাল (সত্যম), নায়েব চাঁদমোহন ও মাস্টার রমাপতি। আর এসেছিলেন অধ্যাপক ঈশানচন্দ্র (দেবেশ)। কিন্তু দুর্গে বসবাস করতে গিয়ে আচমকাই সর্পাঘাতে মৃত্যু হয় তাঁর। সেই সূত্রেই ডিএসপি পুরন্দর পাণ্ডের (শান্তিলাল) আমন্ত্রণে দুর্গে ব্যোমকেশের (দেব) আগমন ঘটে।

এ পর্যন্ত গল্প সকলেরই জানা। তবে সাহিত্য ও সিনেমা দুটি আলাদা মাধ্যম। তাই স্বাভাবিক কারণেই ছবিতে অনেককিছু যোগ এবং বিয়োগ করা হয়েছে। শরদিন্দুর কাহিনি অনুযায়ী ছবি হলো কিনা তা অবশ্যই বিচার্য নয়। আসল কথা ছিল এ গল্পের প্রেক্ষাপট। ১৭৫৭-তে জানকিরামের সম্পত্তি পাওয়া এবং ১৮৫৭-তে রাজারাম ও জয়রামের জীবনে ঘনিয়ে আসা সেই দুঃসময় থেকে রামকিশোরের আমল পর্যন্ত ছবিতে যা দেখানো হয়েছে তা গল্পে বলা ইতিহাসের মতোই। দুর্গ এবং সেই সংলগ্ন সবকিছুই যেভাবে খুঁজে বার করে সিংহ পরিবারের ইতিহাস অনুযায়ী রূপ দেওয়া হয়েছে তা সত্যিই প্রশংসার যোগ্য। 

আরও পড়ুন: রহমতের বেশে মিঠুন, প্রকাশ্যে লুক

তবু ব্যোমকেশকে কিঞ্চিৎ বাণিজ্যিক রূপদান করতেই তাকে প্রথম দৃশ্যে অমন চমকদার একটি ছদ্মবেশ দিতে হলো, যার কোনও প্রয়োজন ছিল না। আমদানি করতে হলো একটি গানের যার সঙ্গে মহাদেবের ‘ব্যোম’ শব্দটির মিল রয়েছে। ব্যোমকেশের কাহিনিতে এই বাহ্যিক আড়ম্বরের প্রয়োজনীয়তা কোনওদিনই ছিল না। হয়তো ব্যোমকেশকে সর্বগ্রাহ্য এবং সব শ্রেণীর বিনোদনের জন্য তুলে ধরতেই এমনটা করা হলো। তাতে করে যে ব্যোমকেশের গাম্ভীর্যে কিছুটা টান পড়বে এ জানা কথা। এছাড়াও অকারণ সাপের দৃশ্য, কিছু অযাচিত অ্যাকশন ও নায়কোচিত মুহূর্ত যোগ করে ব্যোমকেশকে আলাদা করে উজ্জ্বল করে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে। কিছু দৃশ্যে তাকে অ্যাকশন হিরো মনে হতে পারে। চরিত্র হিসেবে ব্যোমকেশকে আলোকিত করতে এসব অলঙ্কারের প্রয়োজন পড়ে না। ‘অর্থমনর্থম’-এ শরদিন্দু লিখেছেন, তাঁর ব্যোমকেশ ‘লগনচাঁদা ছেলে—ভট্টাচায্যিমশাই কুষ্ঠী তৈয়ার করেই বলেছিলেন, এ ছেলে ঘোর উন্মাদ হবে।’ ব্যোমকেশের হাবভাব কেমন তা বোঝার জন্য এই একটি লাইনই যথেষ্ট।   

অ্যাকশন হিরো

শেষ দৃশ্যে আলাদা করে উত্তেজনা যোগ করার ব্যাপারটা দেখতে ভালো লাগে। তবে তার আগের দূরবীন দৃশ্য কেন বাদ দেওয়া হলো বোঝা গেল না। ব্যোমকেশ অন্তর্যামী নয়, তাই কলম চুরির ঘটনা আগে থেকে না দেখে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব ছিল না। আর যেহেতু ঘটনাটা ক্লাইম্যাক্স দৃশ্যে ব্যোমকেশকে যুক্তি সাজাতে সাহায্য করে, তাই সেটা বাদ দিলে বেশ কিছু জায়গা অস্পষ্ট থেকে যায়।

আরও পড়ুন: “আর ভালো লাগছে না”

বোঝা গেল না অজিত চরিত্রের এমন জটায়ুচিত ব্যবহারের কারণও। অজিতের গলায় গান এবং তার আগাগোড়া উঁচুপর্দায় বাঁধা ব্যক্তিত্ব এক অন্য অজিতের জন্ম দিল, যাকে লেখক সৃষ্টি করেননি। ব্যোমকেশের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অজিতও জিজ্ঞাসাবাদ এবং অনুমান করে নিচ্ছে। এমনটা অজিতকে অচেনা করে দেয়। একবারও শোনা গেল না ধননর্জয়ধ্বম ধ্বনি, যা এ গল্পের এক উল্লেখযোগ্য শব্দ। যে শব্দ এ কাহিনিকে স্মৃতিতে উজ্জ্বল করে রাখে। 

শরদিন্দুর ‘উন্মাদ’ বা এক্সেন্ট্রিক ব্যোমকেশকে পাওয়া গেল না কোথাও। সেরকম ব্যোমকেশের খোঁজ করলে এই ছবি তৃপ্তি দেবে না। তবু একটু অন্য মেজাজের ব্যোমকেশকে পাওয়া গেল। দেব আগাগোড়া চেষ্টা করেছেন এবং তিনি অনেকাংশে সফল। তাঁর উচ্চারণের জড়তা আগের থেকে অনেকটাই কেটেছে, ফলে ব্যোমকেশরূপে তাঁকে খুব বেমানান লাগেনি। আর একটু ব্যক্তিত্বের ছোঁয়া চরিত্রের আরও উত্তরণ ঘটাতে পারত। তবে সেটা প্রথম ছবিতেই নিয়ে আসা কঠিন। 



সত্যবতী রূপে রুক্মিণী মানানসই। তাঁকে দেখতে যেমন সুন্দর লেগেছে তেমন অভিনয়ের মাধ্যমে ব্যোমকেশের অর্ধাঙ্গিনী হয়ে ওঠার তিনি সবরকম চেষ্টাই করেছেন। অম্বরীশ ভালো অভিনেতা, নিঃসন্দেহে তিনি তাঁর সেরাটাই দিয়েছেন। তবে পরিচালক অজিত চরিত্রটিকে এভাবে না আনলেই পারতেন। নিজেদের চরিত্রে রজতাভ ও শান্তিলাল দুজনেই অনবদ্য। ছোট চরিত্রে ভালো লেগেছে দেবেশকে। তাঁর দ্বিতীয় ছবিতে সত্যম যথেষ্ট সংযত এবং একইসঙ্গে উজ্জ্বলও। দেবের পাশাপাশি নিজের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেছেন আগাগোড়া। ভবিষ্যতে আবারও তাঁকে বড় চরিত্রে দেখার অপেক্ষা থাকবে। অন্যান্যরা সকলেই যথাযথ। চিত্রগ্রহণ এবং সম্পাদনা প্রশংসার যোগ্য। দীপ্তার্ক বসুর আবহসঙ্গীত বেশ ভালো। 

গত এক দশকের বেশি সময় ধরে ছবির পর্দায় অজস্র ব্যোমকেশ এসেছে ও গেছে। বলতে গেলে দর্শকের ওপর ওভারডোজ়ই হয়েছে এই একটি চরিত্র নিয়ে। সেই অসংখ্য সত্যান্বেষীর ভিড়ে বাণিজ্যিক মেজাজে নতুন ব্যোমকেশও নিশ্চিতভাবেই জায়গা করে নেবে এবং ছাপ রেখে যাবে এ কথা বলাই যায়।




Like
Like Love Haha Wow Sad Angry
1

Swati

Editor of a popular Bengali web-magazine. Writer, travel freak, nature addict, music lover, foody, crazy about hill stations and a dancer by passion. Burns the midnight oil to pen her prose. Also a poetry enthusiast.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *