সমারোহে যীশু, বাকিটা ইতিহাস

ছবি: এক যে ছিল রাজা

নির্দেশনা: সৃজিত মুখোপাধ্যায়

অভিনয়ে: যীশু সেনগুপ্ত, জয়া আহসান, অঞ্জন দত্ত, অপর্ণা সেন, অনির্বাণ ভট্টাচার্য, রাজনন্দিনী পাল, রুদ্রনীল ঘোষ, শ্রীনন্দা শংকর

দৈর্ঘ্য: ২ ঘন্টা ২৭ মিনিট

RBN রেটিং: ৩/৫

ঢাকা বিক্রমপুর এস্টেটের মেজকুমার মহেন্দ্রকুমার চৌধুরীর জীবন আর পাঁচটা জমিদারের মতোই লাগামহীন। তিনি প্রজাবৎসল, অসাধারণ শিকারী, যত্নশীল দাদা। কিন্তু সংসারী নন, শিক্ষিতও নন। তাঁর দিন কাটে জমিদারী করে, রাত কাটে বাঈজীর সঙ্গে নাচঘরে, কিংবা বেশ্যালয়ে। মা-ঠাম্মারা বিয়ে দিয়েও বদলাতে পারেন না মেজকুমারের স্বভাব। আর তাই গরিব ঘরের শিক্ষিতা মেয়ে চন্দ্রাবতী বিয়ে হয়ে চৌধুরী বাড়িতে পা রাখলেও মহেন্দ্রর স্ত্রীর মর্যাদা পান না।




এদিকে ক্রমাগত উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপনের ফলে মহেন্দ্রর শরীরে বাসা বাঁধে ভয়ানক যৌনরোগ সিফিলিস।

এই পর্যন্ত দেখে একজন সাধারণ জমিদারের থেকে মহেন্দ্রকে কোথাও আলাদা করা যায় না। তাঁর জীবন আয়াসহীন, বেহিসেবি ও রঙিন। কিন্তু সেই আগাগোড়া রঙিন জীবনই অবশেষে পর্যবসিত হয় সাদাকালো কোর্টরুমের নাটকীয়তায়। এখানেই বোধহয় মহেন্দ্রকুমারের জীবনের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি, আর হয়ত বাংলাদেশের স্বাধীন জমিদারদের ইতিহাসেরও। যে কোর্টরুম শুধুমাত্র সাদা বা কালোর গল্প বলে, সেখানে মহেন্দ্রকুমারের সমস্ত কাহিনীটাই এক মধ্যমতারে বাঁধা ধূসর চিত্রনাট্য। একটা ঝড়ের রাত একটা মানুষকে আমূল পাল্টে দেয়। সেদিন ঝড় না উঠলে জীবিত মহেন্দ্রকে দাহ করা হতো। কিন্তু ভাগ্যের ফেরে সে বেঁচে যায়, জীবন বইতে থাকে অন্য খাতে। এক সম্পূর্ণ অন্য মানুষ হয়ে সে বিক্রমপুরে ফিরে আসে অনেক বছর পর।

যে মৃত্যু আজও রহস্য

ভাওয়াল রাজার গল্প নতুন করে কিছু বলার নেই। দর্শক মাত্রেই কাহিনী জেনে হলে যাবেন। বরং অন্য বিষয়ে আসা যাক।

পিরিয়ড পিস কিভাবে বানাতে হয় সৃজিত তা প্রমাণ করেছেন জাতিস্মর আর রাজকাহিনী-তে। কিন্তু এই দুটি ছবিকেও ছাপিয়ে যায় এক যে ছিল রাজা। গোটা ছবিতে স্বাধীনতার আগের কলকাতা ও বাংলাদেশের ছবি দুর্দান্তভাবে দৃশ্যমান। বাঘ শিকারের দৃশ্যটি সত্যিই প্রশংসনীয়। ইদানিংকালে আর কোনও বাংলা ছবিতে এভাবে বাঘের দৃশ্য পাওয়া যায়নি। তবে নাগা সন্ন্যাসীদের ভারত পরিক্রমা দেখাতে গিয়ে বেনারস ও হিমালয় অবধি ঠিক ছিল, এমন কি পশ্চিমের মরুভুমিও যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত। কিন্তু সেখানে সোনার কেল্লায় মুকুলের বাড়িতে শ্যুটিং করা হল কি শুধুমাত্র বাঙালি নস্টালজিয়াকে উস্কে দেওয়ার জন্য?

এছাড়াও কোর্টরুমের ভেতরের দৃশ্যগুলি নিয়ে আশা অনেক বেশি ছিল। কারণ দুপক্ষের উকিল—অঞ্জন ও অপর্ণা—দুজনেই দুঁদে অভিনেতা। কিন্তু সেখানে তর্কের নাটকীয়তা যতটা দেখানো হল যুক্তির ধার ততটা শানালো না। দুই উকিলের নিজেদের সম্পর্কের টানাপোড়েনটা একটু অপ্রাসঙ্গিকই মনে হল। যেখানে ছবির বেশিরভাগ অংশই কোর্টের ভিতরে সেখানে আর একটু বৈচিত্র্য কাম্য ছিল।

রক্তবরণ মুগ্ধকরণ

তবে এ ছবির শুরু থেকে শেষ যীশু। এই একজন অভিনেতা আচ্ছন্ন করে রাখেন গোটা ছবি। ঐতিহাসিক কাহিনী বলে গল্প নিয়ে পরিচালকের বিশেষ কিছু করার ছিল না। মশলাপাতির সেই অভাব পূরণ করেছেন যীশু। এত সহজ সাবলীল অভিনয়, কোনওরকম ম্যানারিজ়ম না রেখে যীশু দেখিয়ে দিলেন নায়ক না হয়েও কিভাবে একটা ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে ওঠা যায়।

এবং জয়া আহসান। অসম্ভব সংযত অভিনয়ে সঙ্গত করে গেলেন তিনি। নিজের নায়িকা ইমেজ থেকে বেরিয়ে এসে এক গ্রাম্য জমিদারকন্যা যে শুধু তাঁর দাদাকে ফিরে পেতে চায়। তাঁর জীবনের নানান বয়সের অভিব্যক্তি যথাযথভাবে ফুটিয়ে তুললেন বাংলাদেশে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত এই অভিনেত্রী।

শব্দ যখন ছবি আঁকে

এবং বাকিরাও। সারা শরীর দিয়ে অভিনয় না করে, শুধুমাত্র চোখের ব্যবহারে চরিত্রের মন বুঝিয়ে দেবার ক্ষমতা রাখেন অনির্বাণ, আবারও তিনি তা প্রমাণ করলেন। রুদ্রনীল বরাবরের মতই সহজ, স্বাভাবিক। যে কোনও ভূমিকায় তিনি অপ্রতিরোধ্য। অঞ্জনও বরাবরের মতই ছবির চরিত্র হয়ে উঠেছেন। অপর্ণার অভিনয় নিয়ে কিছু বলার না থাকলেও, তাঁর মেকআপ কোনও কোনও জায়গায় একটু অস্বস্তির কারণ হয়েছে। মহেন্দ্রর স্ত্রীর চরিত্রে রাজনন্দিনীর বিশেষ কিছু করার ছিল না।

কিন্তু প্রচুর সুযোগ পেয়েও জ্বলে উঠতে পারলেন না শ্রীনন্দা শংকর। কোর্টরুমের ছোট্ট অভিনয়ে তিনি যথাযথ, কিন্তু নর্তকীর ভূমিকায় আর একটু লাস্যময়ী হয়ে উঠলে চরিত্রটি স্মরণীয় হয়ে থাকত। ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্তর সঙ্গীত আকর্ষণীয় ও মনে রাখার মত। তবে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ব্যবহারে আর একটু সংযমী হলে ভালো লাগত। “মহারাজ একি সাজে” গানটিকে যে অর্থে ছবিতে ব্যবহার করা হয়েছে তা অতি সরলীকরণ হয়ে গেছে।

তাশি গাঁওয়ে একদিন

এ ছবিতে একটা বড় ভূমিকা যীশুর মেকআপ, এবং সেখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য সোমনাথ কুণ্ডুর নাম। বাংলা ছবিতে মেকআপের এত ভালো ব্যবহার সত্যিই খুব আশার কথা। তিনরকম বয়সের তিনটি ভিন্ন রূপে যীশুর মেকআপ দারুণ বিশ্বাসযোগ্য। 

সৃজিতের বিগ স্ক্রিন এফেক্ট এই ছবিতেও অব্যাহত। পরিচালকের কাজ গল্প বলা। সেই কাজটা তিনি দক্ষতার সঙ্গেই করে থাকেন। এত বড় স্কেলে বাংলা ছবিকে পরিবেশন করা মুখের কথা নয়। ভাওয়াল রাজার গল্পের এর থেকে ভালো মাউন্টিং বোধহয় সম্ভব ছিল না। এখানেই বরাবর টেক্কা দিয়ে যান সৃজিত। এবারও হয়ত তার ব্যতিক্রম হবে না।

Amazon Obhijaan



Like
Like Love Haha Wow Sad Angry
1

Swati

Editor of a popular Bengali web-magazine. Writer, travel freak, nature addict, music lover, foody, crazy about hill stations and a dancer by passion. Burns the midnight oil to pen her prose. Also a poetry enthusiast.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *