অনবদ্য ভিক্টর, স্ক্রিনজুড়ে যেন সত্যিই গুরুদেব
পরিচালনা: পাবলো সিজ়ার
অভিনয়ে: ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়, রাইমা সেন, ইলিওনোরা ওয়েক্সলার, হেক্টর বারদোনি, নিলদা রাগ্গি
দৈর্ঘ্য: ১ ঘন্টা ৪৭ মিনিট
RBN রেটিং: ৩/৫
১৯২৪ সাল। আন্ডেস নামক জাহাজে চড়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চলেছেন পেরুর পথে, সে দেশের স্বাধীনতার শতবার্ষিকী উদযাপনে যোগ দিতে। দীর্ঘ যাত্রাপথের ধকল, বয়সের ভার ও ইনফ্লুয়েঞ্জা ছাপ ফেলেছে তাঁর মনেও। ৬ নভেম্বর আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস আইরেসে পৌঁছলে, চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুযায়ী বেশ কিছুদিন কবিকে সেখানেই থাকতে হয়।
রবীন্দ্রনাথের আর্জেন্টিনা সফর পর্বে উল্লেখযোগ্য চরিত্র তিনটি। তিনি স্বয়ং, সফরসঙ্গী এলমহার্স্ট এবং অন্যতম চরিত্র ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো। আর্জেন্টিনার এক সম্ভ্রান্ত, বনেদি, গোঁড়া, ক্যাথলিক পরিবারের মেয়ে ভিক্টোরিয়া। বয়সের দিক থেকে রবীন্দ্রনাথ ও ভিক্টোরিয়ার মধ্যে প্রায় তিন দশকের ফারাক হলেও, কবির লেখা তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছিল। আঁদ্রে গিড্ডের ‘গীতাঞ্জলি’র ফরাসি অনুবাদ ভিক্টোরিয়ার ব্যক্তিগত জীবনেও প্রভাব ফেলে। ১৯২৪ সালে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ভিক্টোরিয়ার প্রথম সাক্ষাৎ।
আরও পড়ুন: শেষের সেদিন, উপস্থিত ছিলেন শুধু মহেশ ও ড্যানি
কাট টু ২০২২। প্রায় এক শতাব্দী পর স্ক্রিনজুড়ে চোখের সামনে এ যেন সত্যিই গুরুদেব!
পাবলো সিজ়ার বাস্তব জীবনের গল্পের ওপর ভিত্তি করে রবীন্দ্রনাথ ও ভিক্টোরিয়ার সম্পর্কের রসায়ন পুনর্নির্মাণ করেছেন, যা এই ছবির মূল বিষয়।
‘থিঙ্কিং অফ হিম’-এ ভিক্টর যেন রক্তমাংসের রবি ঠাকুর। তাঁর অনাড়ম্বর, সাবলীল ও মার্জিত অভিনয় এবং শরীরী ভাষা যেন ফেলে আসা ১০০ বছরের ইতিহাসকে চোখের সামনে বর্তমান করে তোলে। দর্শককে টাইম মেশিনে চড়িয়ে নিয়ে যায় সুদূর আর্জেন্টিনা আবার ফিরিয়ে আনে শান্তিনিকেতনের আশ্রমে। ভিক্টরের গভীর এবং প্রশান্ত দৃষ্টি যেন তাঁর নিজের নয়, রবীন্দ্রনাথের। ভিক্টোরিয়ার চরিত্রে ইলিওনোরা যেন সত্যিই গুরুদেবের ‘বিজয়া’।
কামালির চরিত্রে রাইমা এবং ওকাম্পোর লেখা বই পড়ে অনুপ্রাণিত আর্জেন্টিনার ভূগোল শিক্ষক ফেলিক্সের চরিত্রে হেক্টর ভালো। কিন্তু চিত্রনাট্যে খামতি থাকায় তাঁরা বিশেষ ছাপ ফেলতে পারেননি।
পিরিয়ড পিস নিয়ে কাজ করার প্রধান শর্তই হলো পোশাকে, পরিবেশে, আসবাবপত্রে, কথাবার্তায়, চালচলনে সেই সময়ের দলিলকে তুলে ধরা। সেদিক থেকে পাবলোর পরিকল্পনা সফল।
আরও পড়ুন: বেহিসেবী জীবনযাপন, আজ স্মৃতির অতলে সৌমিত্র
তবে রবি ঠাকুরের জীবনদর্শন বজায় রেখে, বর্তমান প্রজন্মে দৃশ্যে প্রোথিত করা বেশ পরীক্ষামূলক কাজ। তাঁকে জানতে গেলে, বুঝতে গেলে, তাঁর সঙ্গে যাপন করতে হবে। শুধুমাত্র রবীন্দ্রনাথের গান, কোপাই নদী বা শান্তিনিকেতন আশ্রমের গণ্ডি দিয়ে রবীন্দ্রনাথকে মাপা যায় না। আজ পর্যন্ত তা সম্ভব হয়নি। কথায় বলে, রবীন্দ্রনাথ যা সৃষ্টি করে গেছেন, তার সবটুকু এক জীবনে শেষ করা যায় না। পরিচালকের দৃষ্টভঙ্গি দিয়ে নয়, রবীন্দ্রনাথের চোখ দিয়ে শান্তিনিকেতনকে তুলে ধরতে গেলে, বইয়ের বাইরে তাঁকে আরও বেশি করে জানা প্রয়োজন। আশ্রমিক জীবন, খোয়াই, হাট, ছাতিমতলা, প্রার্থনাগৃহ, সেখানকার মানুষদের জীবনযাপন, পরিবেশ, বাউল গান সবকিছুর মধ্যে জড়িয়ে রয়েছেন রবীন্দ্রনাথ।
আরও পড়ুন: শেষ যাত্রায় ব্রাত্য, পথ হেঁটেছিলেন মাত্র কয়েকজন
‘প্রেম’ শব্দটি অতল, কোনও সংজ্ঞা দিয়ে তার গভীরতা মাপা যায় না। তেমনই সম্পর্কের পরিণতি দিয়ে তার মুক্ত ডালপালা ছেঁটেও দেওয়া যায় না। গুরুদেব সম্পর্কে ভিক্টোরিয়ার অনুভূতি ঠিক যেমন ছিল, এই ছবি সেই অলিখিত ইতিহাসকেই তুলে এনেছে। প্রকৃতি পূজারী রবি ঠাকুর এবং ওকাম্পোর আধ্যাত্বিক উন্মেষ দু’দেশের দুটি মানুষকে এক অদৃশ্য, বন্ধনহীন সম্পর্কে বেঁধে ফেলে।
মন ছুঁয়ে যায় রবীন্দ্রনাথের জাহাজে চড়ে দেশে ফেরার দৃশ্যটি। গুরুদেব চলেছেন, সঙ্গে রয়েছে ওকাম্পোর দেওয়া বিশেষ একটি আরামকেদারা। একে অপরের প্রতি ঋণী হয়ে থাকার স্মারক। রবীন্দ্রনাথ একটি চিঠিতে তাঁকে উৎসর্গ করলেন ‘অতিথি’ কবিতার অনুবাদ।
ওকাম্পোর প্রতি এলমহার্স্টের বয়ঃসন্ধিজনিত দুর্বলতা যেমন সত্য, তেমনই গুরুদেবের প্রতি ওকাম্পোর নিবেদিত প্রাণ, তাঁর সান্নিধ্য কামনা, তাঁকে ছুঁতে চাওয়া, তাঁকে উপলব্ধি করা, এও সত্য। কিন্তু এই প্রেম প্রেরণা এবং মাধুর্যের।
প্রেমের পরিণতি যে বিয়েই হতে হবে তার কোনও মানে নেই। বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ না হয়েও দুটি মানুষের ভালোবাসা চিরন্তন হতে পারে। একটা বয়সের পর সেই সম্পর্কে পারস্পরিক শ্রদ্ধাই মূল উপাদান হয়ে ওঠে। সেরকমই ছিল রবীন্দ্রনাথ-ভিক্টোরিয়ার সম্পর্ক। সেটাই দেখালেন পাবলো।