কটাক্ষের মোড়কে সমাজ ও সত্য
ছবি: একটু সরে বসুন
পরিচালনা: কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়
অভিনয়ে: ঋত্বিক চক্রবর্তী, ইশা সাহা, পাওলি দাম, রজতাভ দত্ত, পায়েল সরকার, মানসী সিংহ, খরাজ মুখোপাধ্যায়, পরান বন্দোপাধ্যায়, লোকনাথ দে, মৌমিতা পণ্ডিত, দেবপ্রতিম দাশগুপ্ত, দেবপ্রসাদ হালদার
দৈর্ঘ্য: ২ ঘণ্টা ২৫ মিনিট
RBN রেটিং: ★★★★★★★☆☆☆
‘চাকরির বাজার’ কথাটা এ দেশে এবং বিশেষ করে এ রাজ্যে চিরকালই একটি নেতিবাচক বাক্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। একে একটি বিশেষ অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা বলা যেতে পারে যা কস্মিনকালেও খুব আশাপ্রদ ছিল না। আজকেও নেই। নাহলে সেই বিংশ শতাব্দীর গল্পে বনফুল যা লিখে গিয়েছিলেন তাকে আজকের দিনে দাঁড়িয়ে কমলেশ্বর প্রাসঙ্গিক করে তুলতে পারতেন না।
ছবির গল্প বেগুনবাগিচা গ্রামের গুরুপদ দাশগুপ্ত ওরফে গুড্ডুকে (ঋত্বিক) কেন্দ্র করে। সংস্কৃত নিয়ে পাশ করা গুড্ডুর চাকরির দরকার। সেই আশায় নানা কাণ্ড করে গ্রাম ছেড়ে সে কলকাতায় আসে। সেখানে ফটকেদা (রজতাভ) ও উর্মি বউদির (পায়েল) সংসারে সে ফাইফরমাশ খাটার জন্য রয়ে যায়। এদিকে ভাইপো-ভাইঝিদের দুষ্টুমি সামলাতে গিয়ে অপ্রত্যাশিতভাবেই রাস্তায় একদিন সে পুলিশকে সাহায্য করে বিরাট নাম করে ফেলে। টেলিভিশন চ্যানেল গুড্ডুর নাম দেয় নতুনভাই। গুড্ডুকে খুঁজতে শহরে এসে পৌঁছয় তার মা (মানসী), মাষ্টারমশাই (খরাজ) আর বান্ধবী পিউ (ইশা)। এদিকে প্লেসমেন্ট এজেন্সির তরফে গুড্ডুকে চাকরি পাইয়ে দেওয়ার সবরকম চেষ্টা করে রোকেয়া (পাওলি) ও প্রজ্ঞা (মৌমিতা)। এত কিছু করেও কি গুড্ডু চাকরি পাবে?
আরও পড়ুন: টেলিভিশন ধারাবাহিকে ফিরছেন শ্বেতা
মূল গল্পটি খুবই ছোট। তাই তার থেকে অনেকটা সরে এসে পরিচালক প্রায় নতুন গল্পের স্বাদ এনে দিয়েছেন ছবিতে। রয়ে গেছে মূল গল্পের নির্যাসটুকু। তবে এই পরিবর্তনে যেটা ঘটেছে সেটা হলো কিঞ্চিৎ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এবং কিঞ্চিৎ প্রিয়দর্শন গোত্রের একটি নিটোল মজা এবং স্যাটায়রের মিলমিশ। হাসতে কোনও বাধা নেই। দর্শক হাসবেন মন খুলে। কারণ প্রতি সংলাপেই রয়েছে সাম্প্রতিক সমাজ ও রাজনৈতিক চিত্রের প্রতি কটাক্ষ। সেখানে ডান-বাম কাউকেই বিশেষ রেয়াত করা হয়নি। তবু মূলধারার ছবিতে সেটুকু করতেও আজকের দিনে কলজের জোর লগে বৈকি।
সংলাপের ক্ষেত্রে যেমন কমেডির অভাব নেই, তেমনই দৃশ্যপট তৈরির ক্ষেত্রেও রয়েছে রসবোধের ছোঁয়া। যোগেন মাস্টারের ঘরে লেখা আপ্তবাক্য ‘মাসের প্রথমে দরিদ্র শিক্ষককে বেতন দিতে ভুলবেন না’ যেমন গৃহশিক্ষকদের দুর্দশাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, তেমনই মজাদার লাগে ক্লাসে লেখা সাবধানবাণী ‘জুতো, দুর্গন্ধযুক্ত মোজা, ওপর চালাকি, মোবাইল ফোন বাইরে রেখে আসবেন’। বর্তমান সমাজের রূপরেখা স্পষ্ট হয়ে যায় ‘দাদা যখন কাকু হয়ে ইন্টারভিউ দিতে আসে, ভালো থাকতে পারে?’ ‘লোভে পাপ, পাপে পঞ্চায়েত প্রধান’, ‘চাকরি পেতে-পেতে মনে হচ্ছে রিটায়রমেন্টের বয়স হয়ে যাবে’, এ ধরনের সংলাপে। কোনও চরিত্রই সেই অর্থে মজাদার না হয়েও আগাগোড়া দর্শককে হাসাবে।
আরও পড়ুন: থাকবেন সোনাক্ষী সিংহও
অজস্র দক্ষ অভিনেতার সমন্বয়ে এ ছবির অভিনয় বিভাগ সমৃদ্ধ। প্রত্যেকেই নিজের জায়গায় যথাযথ হয়ে উঠেছেন। রজতাভর কমিক টাইমিং, মানসীর এক দমে বলে যাওয়া সরল সাধাসিধে কমেডি কিংবা খরাজের উঁচু তারে বাঁধা নাটকীয় অভিনয়, কেউ কারও থেকে একচুল পিছিয়ে নয়। ঋত্বিককে গুড্ডুর চরিত্র থেকে আলাদা করা যায় না। যেমন আলাদা করা যায় না রোকেয়া থেকে পাওলিকেও। ইশা নিজের মতোই সরল সাবলীল এবং মিষ্টি। লোকনাথকে এত ছোট চরিত্রে দেখে মন ভরে না। তিনি লম্বা রেসের ঘোড়া। মজার চরিত্রে পায়েল বেশ মানানসই। স্বল্প পরিসরে মৌমিতা চরিত্রের চাহিদা পূরণ করেছেন। দেবপ্রতিম ও দেবপ্রসাদ দুজনেই শক্তিশালী অভিনেতা। দুজনকেই মজাদার লেগেছে। একেবারে অন্যরকম একটি চরিত্রে পাওয়া গেল পরানকে, চেনা ছকের বাইরে। কয়েক মুহূর্তের ভালো লাগা দিয়ে যায় তাঁর আপনভোলা চরিত্র।
ছবির দৈর্ঘ্য দ্বিতীয়ার্ধে ধৈর্যচ্যুতি ঘটাতে পারে। সময় একটু কমিয়ে আনলে গল্পকে আরও আঁটোসাঁটো করা যেত। তবে ক্লাইম্যাক্স দৃশ্যে রজতাভ এবং ঋত্বিকের রসায়ন মনে রাখার মতো। এত মজার মাঝেও হালকা করে ধাক্কা দিয়ে যায় কঠোর বাস্তব। এইখানেই ‘একটু সরে বসুন’-এর সার্থকতা।
সৌরভ বন্দোপাধ্যায়ের চিত্রগ্রহণ প্রশংসনীয়। কমলেশ্বরের চিত্রনাট্য দুর্দান্ত বললেও কম বলা হয়। রণজয় ভট্টাচার্যের সুরে ছবির গান শ্রুতিমধুর। অরিজিৎ সিংহ ও অন্বেষার কণ্ঠে ‘নিষ্পলক’ এবং সুনিধি চৌহানের গলায় ‘নেশা নেশা’ রেশ রেখে যায়। দেবজ্যোতি মিশ্রের আবহ ছবির সঙ্গে মানানসই।
দেশব্যাপী দুর্নীতি ও সাধারণ মানুষের অসহায় অবস্থা থেকেই বর্তমান সমাজে জন্ম নিয়েছে ট্রোল ও মিম সংস্কৃতি। এরই আদিরূপ হলো ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ সমৃদ্ধ নাটক অর্থাৎ স্যাটায়র। সমস্যা সেদিনও কম ছিল না, আজও নয়। সেই ছবিকেই কটাক্ষের মোড়কে তুলে ধরেছেন পরিচালক যা বর্তমান সমাজের নির্লজ্জ সত্যকে সামনে এনে দেয়।