সম্ভাবনার তত্ত্বে চমকে দেবে অভিজিতের আশ্চর্য ছবি

ছবি: ধ্রুবর আশ্চর্য জীবন

পরিচালনা: অভিজিৎ চৌধুরী

অভিনয়ে: ঋষভ বসু, ঋত্বিকা পাল, আনন্দরূপা চক্রবর্তী, সেঁজুতি মুখোপাধ্যায়, দেবেশ চট্টোপাধ্যায়, যুধাজিৎ সরকার, উদয়শঙ্কর পাল, কোরক সামন্ত, অরুণাভ খাসনবিশ, প্রেরণা দাস, দীপক হালদার, শান্তনু নাথ, বাদশা মৈত্র, সুদীপ মুখোপাধ্যায়

দৈর্ঘ্য: ২ঘণ্টা ১৯ মিনিট

RBN রেটিং ★★★★★★★☆☆☆

সম্ভাব্যতা এমন এক অবস্থার কথা বলে যেখানে একই ঘটনার ফলাফল ভিন্ন হতে পারে এবং তা মোটেও অযৌক্তিক নয়। খুব সহজভাবে বলতে গেলে আমরা আমাদের সাধারণ মধ্যবিত্ত জীবনে মাঝেমধ্যেই এমন কথা ভেবে থাকি, যদি এই চাকরিটা না করে ওই ব্যবসাটা শুরু করতাম তাহলে হয়তো আজ জীবনটা অন্যরকম হতো। বা সায়েন্স না নিয়ে সেদিন যদি কমার্স নিতাম আজ অনেকগুলো রাস্তা খোলা থাকত। আমাদের প্রত্যেকের জীবন এমন অনেক ‘যদি’ আর ‘তাহলে হয়তো’ দিয়ে আবর্তিত হয় প্রতিদিন। তবে সবটাই অনুমান। আমরা জানি না বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের আর কোনও পৃথিবীতে হুবহু আমার মতো একজন মানুষ অন্য একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে আজ অন্য কিছু করছে কিনা। বা হয়তো তার জীবনটা আদৌ আমার মতোই নয়।



এরকম একটা সম্ভাবনার সূত্রের ওপর তৈরি হয়েছে ‘ধ্রুবর আশ্চর্য জীবন’ (Dhrubor Aschorjo Jibon)। ছবিটি চারটি পর্বে বিভক্ত। প্রত্যেক পর্বে একজন চিত্রশিল্পীকে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন অভিজিৎ। প্রথম দুই পর্বে যামিনী রায় ও গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং শেষের দুই পর্বে বিকাশ ভট্টাচার্য ও বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়কে ট্রিবিউট দিয়েছেন তিনি। 

আরও পড়ুন: ব্যবসায়িক সাফল্য না সৃষ্টির উপযুক্ত মূল্য? উত্তরের খোঁজে তনুশ্রী, সুদীপ্ত

ছবির গল্প সম্পর্কে কিছুটা ধারণা দেওয়া যাক। ধ্রুব এবং রিমি, একই অনাথ আশ্রমে পাশাপাশি বড় হয়ে ওঠা দুই বন্ধু। একসময় দত্তকের কারণে প্রাথমিক বিচ্ছেদ হলেও সম্পর্ক থেকে যায়। প্রথম গল্পে ধ্রুব (ঋষভ) তার কাছের মানুষ রিমির (ঋত্বিকা) বিপদে সাহায্য করবে বলে ঝুঁকি নিয়ে তার স্যারের বাড়ি থেকে একটি দামী ছবি চুরি করে বেচতে যায়। সেই ঘটনায় ধ্রুবর অভিজ্ঞতা এবং শেষের টুইস্ট, এই নিয়েই গল্প। দ্বিতীয় গল্পে ধ্রুবর বন্ধু নন্দী (কোরক) তাকে এক রাজনৈতিক দলের কাজে জড়িয়ে একটি ফটোশুট করতে বলে, যার আড়ালে রয়েছে ওই দলের স্বার্থসিদ্ধি। কাজটা করতে পারলে অনেক টাকা পাওয়া যাবে। ফলে রিমির সমস্যা এবং তার ধারদেনা সবই মিটে যাবে। ফটোশুট করতে গিয়ে কীভাবে ধ্রুব সেখানে জড়িয়ে পড়ে এবং তার ফল কী মারাত্মক হয় সেই নিয়ে গল্প। তৃতীয় গল্পে ধ্রুব নিজের অস্তিত্বের খোঁজে এক অচেনা অজানা সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বিভ্রান্ত হয়ে যায়। চতুর্থ গল্পে রিমির সঙ্গে আবার দেখা হয় ধ্রুবর, তবে এবার এক আশ্চর্য প্রেক্ষাপটে, সহজ ভাষায় যার কোনও ব্যাখ্যা হয় না। 

Dhrubor Aschorjo Jibon

বাংলা ছবির জগতে এক অন্য দিগন্ত খুলে দিতে পারে এই ছবির বিষয় ভাবনা। এমন একটা অভিনব বিষয় নিয়ে ছবি করার জন্য অবশ্যই সাধুবাদ প্রাপ্য অভিজিতের। ছবির কাহিনি বা অন্যান্য অংশের আলোচনায় যাওয়ার আগে সর্বাগ্রে স্বীকার করা দরকার একঘেয়ে চর্বিতচর্বনের গোলকধাঁধা থেকে বেরিয়ে নতুন কিছু ভেবেছেন অভিজিৎ, যা এই প্রজন্মকে বাংলা ছবির প্রতি আগ্রহী করে তুলতে পারে। সিরিয়াস ছবির দর্শককে ভাবতে বাধ্য করতে পারে। 

আরও পড়ুন: তাঁকে ছাড়া কাস্টিং অসম্পূর্ণ, বললেন তব্বু

ধ্রুবর কাহিনিকে চারবার চারভাবে দেখানো হয়েছে। প্রতিটি সম্ভাবনায় তার জীবন পাল্টে যায়। ছবির কাহিনিকে আগাগোড়া অনেকটা থ্রিলারের আঙ্গিকে সাজানো হলেও গল্পের পরতে-পরতে রয়েছে ভালোবাসার জন্য টান। প্রথম কাহিনিতে কিছুটা বুদ্ধিদীপ্ত টুইস্ট পাওয়া যায়, যদিও শেষরক্ষা হয় না। দ্বিতীয়টিতে এক ধরনের ফাঁদ তৈরি করে নাটক করতে হয় ধ্রুবকে, কারণ তার টাকার প্রয়োজন। এই গল্পের শেষটা যন্ত্রণাদায়ক হলেও তাকে শৈল্পিক দৃষ্টিতে দেখিয়েছেন পরিচালক। তৃতীয় ও চতুর্থ গল্পের সেই অর্থে কোনও শেষ হয়নি, বা কোথায় সমাপ্তি হবে বলা যায় না। একই মানুষের জীবনের চাররকম সম্ভাবনা দেখিয়েছেন পরিচালক।

Dhrubor Aschorjo Jibon

এই চারপ্রকার ছাড়াও আরও অজস্র সম্ভাবনা থাকতে পারত। হতে পারত ধ্রুব নিজেই একজন বিখ্যাত শিল্পী, কিংবা একজন হত্যাকারী। ডাক্তার বা সঙ্গীতশিল্পীও হতে পারত। আবার এই সব কোনওকিছুই না হয়ে সে একজন শিক্ষক হতে পারত। এরকম অজস্র সম্ভাবনা পৃথিবীর প্রতিটা মানুষের ক্ষেত্রে রয়েছে। আলাদা পরিস্থিতিতে বড় হলে, জীবনে ভিন্ন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হলে আমরা কে কী হতে পারতাম জানা নেই। অন্য কোনও মহাবিশ্বে ঠিক আমার মতো আর কেউ অন্য কিছু করছে কিনা তাও আমরা জানতে পারি না। তবে এর ওপরেই দাঁড়িয়ে থাকে সম্ভাবনার তত্ত্ব। সেই সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়েই প্রত্যেক গল্পে পাল্টে গেছে ধ্রুবর জীবনের ডাইমেনশন। 

আরও পড়ুন: সৌরভের বায়োপিকে তৃতীয়বার অভিনেতা বদল

তবে কিছু ক্ষেত্রে যুক্তি ও যত্নের আর একটু প্রয়োজন ছিল বলে মনে হয়। যেমন প্রথম গল্পে কাজটা সাফল্যের সঙ্গে করলেও কেন শেষরক্ষা হয় না তা স্পষ্ট করা হয়নি। যেখানে প্রাপ্য টাকার খানিকটা অন্তত পাওয়া যেতে পারে এবং পরে হয়তো বাকিটাও পাওয়া যাবে, সেখানে খুনি প্রায় অকারণে কেন খুন করে বোঝা যায় না। ধ্রুবর জীবনের এই পর্বের কথা দর্শক জানতে পারে না ফলে কিঞ্চিৎ দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে ছবির এই পর্যায়। তাছাড়া কোনও আর্ট ডিলার সাধারণত এতটা অসাবধানি হয় না। তবু এই গল্পের টুইস্ট দেখতে মন্দ লাগে না।

Dhrubor Aschorjo Jibon

দ্বিতীয় কাহিনিতে কিছুটা আন্দাজ করা যায় কী হতে চলেছে। তবে প্রথম দুই কাহিনিতে যে শিল্পীকে শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে, তিনি এসেছেন সরাসরি। সেটা দর্শকের সামনে উপস্থাপন করা হয়েছে অনেকটা সহজভাবেই। তৃতীয় কাহিনিতে সেই অবসর নেই। বিকাশ ভট্টাচার্যের পুতুল সিরিজ় এবং তার ভয়াবহতা সাধারণ দর্শকের জানার কথা নয়। সেই সূত্রে কোনও ছবিকে তুলে ধরতে হলে বিষয়কে আরও প্রাঞ্জল করতে হতো। তবে কাহিনির বিশেষ এক মোড়ে নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে ধ্রুব যে দোলাচলে গিয়ে দাঁড়ায় এবং তার আশ্রয়দাতাদের উদ্দেশ্য নিয়ে যে মৌলিক প্রশ্ন তোলে তার অভিব্যক্তিতে স্নেহে অন্ধ হয়ে যাওয়া মা এবং পুতুলের পরিণতির প্রতীক এককথায় অসাধারণ। খুব সামান্য গল্প নিয়েও এই কাহিনি শিউরে ওঠার মতো এক সমাপ্তি উপহার দেয়।

আরও পড়ুন: চিত্রনাট্য তৈরি, এবার কি বাঙালি পরিচালক?

চতুর্থ কাহিনি নিঃসন্দেহে অবাক করবে। এই পর্বে এমন কিছু পরিস্থিতি তৈরি হয় যা সম্ভাবনার তত্ত্বকে অনেক বেশি স্পষ্ট করে সামনে নিয়ে আসে। রিমি আর ধ্রুবর দেখা হওয়া কাহিনির গণ্ডি পেরিয়ে প্রায় কবিতায় উন্নীত হয়েছে এখানে। 

সমস্ত ছবি জুড়ে রয়েছে অসীম সম্ভাবনার কথা, সেই কারণেই মনে হওয়া স্বাভাবিক শ্রোডিঙ্গারের বিড়াল তত্ত্ব যেভাবে এই ছবির বিভিন্ন স্তরে উঠে এসেছে তাকে আর একটু স্পষ্ট করলে দর্শকের কাছে হয়তো সহজ হতে পারত এই ছবিকে গ্রহণ করা। তবে অভিজিৎ সম্ভবত এক বিশেষ গোত্রের দর্শককেই ছবিটি দেখতে চেয়েছেন। সেদিক দিয়ে তিনি সফল। কারণ বাংলা ছবিতে এমন ছকভাঙা ভাবনা এর আগে সেই অর্থে উঠে আসেনি। 

Dhrubor Aschorjo Jibon

অভিনয়ের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় ঋত্বিকার কথা। শুধুমাত্র চোখ ব্যবহার করে তাক লাগিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা আছে তাঁর। এছাড়াও কোরক, সেঁজুতি  ও দীপকের অভিনয় মনে দাগ কাটে। ঋষভ এই ছবির ধ্রুবক, যাকে ছাড়া কোনও গল্পই সম্ভব হতো না। ধ্রুব চরিত্রে জন্য ঋষভ যথাসম্ভব ভেঙেছেন নিজেকে। ভবিষ্যতে নিজেকে নিয়ে আরও পরীক্ষামূলক কাজ তিনি করবেন, আশা করা যায়। এছাড়া অন্য অভিনেতারা প্রত্যেকেই যথাযথ। অনেকদিন পর পর্দায় এক অন্যরকম চরিত্রে বাদশাকে দেখে ভালো লাগে। 

আরও পড়ুন: বহুদিন হিট নেই, এবার মহাভারত নিয়ে ভাবছেন আমির

চিত্রগ্রহণ, সম্পাদনা, সঙ্গীত সবদিক থেকেই এই ছবি আলাদাভাবে উল্লেখের দাবি রাখে। ছবির টাইটেল কার্ডের ভাবনা একইসঙ্গে শৈল্পিক এবং মজাদার। এই সময়ে দাঁড়িয়ে বিশ্ব সিনেমায় যে বিষয় নিয়ে সবচেয়ে বেশি চর্চা হচ্ছে সেই ধারণাকে চার শিল্পীর চাররকমের আঙ্গিকে তুলে ধরা সহজ কাজ ছিল না। পরিচালক সেই সাহস দেখিয়েছেন। সেই চিন্তাভাবনাকে বাংলার দর্শক কতটা গ্রহণ করতে পারবে সে কথা সময় বলবে। তবে ভবিষ্যতের ছবি ভাবনার নিরিখে অভিজিৎ বেশ কিছুটা এগিয়ে রইলেন এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।




Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Swati

Editor of a popular Bengali web-magazine. Writer, travel freak, nature addict, music lover, foody, crazy about hill stations and a dancer by passion. Burns the midnight oil to pen her prose. Also a poetry enthusiast.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *