গর্বের ইতিহাসে কাঁটা হয়ে রইল চিত্রনাট্যের মেদ
ছবি: বাঘা যতীন
পরিচালনা: অরুণ রায়
অভিনয়ে: দেব, সৃজা দত্ত, সুদীপ্তা চক্রবর্তী, সমিউল আলম, কোলাজ সেনগুপ্ত, কার্ল অ্যানড্রু হার্ট, আলেকজ়ান্দ্রা টেলর
দৈর্ঘ্য: ২ ঘণ্টা ১৮ মিনিট
RBN রেটিং ★★★★★★★☆☆☆
ইংরেজদের পদানত হয়ে থাকার সময়ে স্বাধীনতা অর্জন করার বহুল প্রচেষ্টা হয়েছে। সেই প্রচেষ্টার মধ্যে অন্যতম ছিল ভারতের সশস্ত্র সংগ্রাম। সারা ভারতের বিভিন্ন অংশ গর্জে উঠেছিল প্রতিবাদে। সশস্ত্র সংগ্রামীদের মধ্যে বঙ্গদেশ থেকে উঠে এসেছিল একদল নির্ভীক উৎসর্গীকৃত প্রাণ। যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, ওরফে বাঘা যতীন ছিলেন তাঁদেরই একজন।
এই ছবির নামভূমিকায় অভিনয় করেছেন দেব। বাঘা যতীনের দিদি বিনোদবালা দাসীর ভূমিকায় অভিনয় করেছেন সুদীপ্তা এবং যতীনের স্ত্রী ইন্দুবালার চরিত্রে রয়েছেন সৃজা। এছাড়া ক্ষুদিরাম বসুর ভূমিকায় রয়েছেন সমিউল ও চার্লস টেগার্টের চরিত্রে আভিনয় করেছেন কার্ল অ্যানড্রু হার্ট।
ছবির শুরু হয় ব্রিটিশদের ভারত দখলের প্রাথমিক কাহিনি দিয়ে। সেই কাহিনি শেষ হতে দেখা যায়, বাঘা যতীন একটি সামান্য কারণে ব্রিটিশ সৈনিকদের সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েন। ছবির শুরুই হয় অ্যাকশন দৃশ্য দিয়ে। সৈনিকেরা যতীনের নামে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ জানায়, আদালতেও মামলা করে। কিন্তু সরকারের অর্থনৈতিক বিভাগে কর্মরত যতীন তার ঊর্ধ্বতন মিঃ হোয়েলারের বিশেষ স্নেহভাজন হওয়ায় সেসব ধোপে টেকে না। সরকারি কর্মচারী হয়েও যতীন বিপ্লব ঘটাতে চায়। তবে তা হাত গোনা কয়েকজন সাহেবকে হত্যা করে নয়, গণঅভ্যুত্থান ঘটিয়ে। তার বুদ্ধির খেলায় ব্রিটিশ নাজেহাল হলে তারা টেগার্টকে নিয়োগ করে। ঘটনাচক্রে দেখা যায়, ভারতপ্রেমিক কেনেডি ও তাঁর পরিবারের সঙ্গে তার অত্যন্ত সুসম্পর্ক।
আরও পড়ুন: অনির্বাণের বিদায় ব্যোমকেশ
যতীনের বুদ্ধি অনুযায়ী বিভিন্ন গুপ্ত সংগঠন গড়ে উঠতে থাকে শহর এবং শহরতলীর আনাচে-কানাচে। এদিকে অত্যাচারী ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে বোমার আঘাতে হত্যা করার জাল বোনেন বিপ্লবী বারীন ঘোষ। বেছে নেওয়া হয় ক্ষুদিরামকে। বিপ্লবী ক্ষুদিরামের ফাঁসি এবং অরবিন্দ ঘোষসহ অনেকের গ্রেফতারির পর যতীনের নেতৃত্বে বিশ্বাসঘাতক ভারতীয়রা মারা পড়ে। যতীনের লক্ষ্য তখনও গণঅভ্যুত্থান।
ছবির দ্বিতীয়ার্ধে সেইমতো সে পরিকল্পনা শুরু করে। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের বিপ্লবী নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে সারা ভারতে বিপ্লবের বীজ ছড়িয়ে দেওয়া এবং বিদেশি শক্তির সাহায্য নেওয়ার পরিকল্পনা করে যতীন। এদিকে অভ্যুত্থানের জন্য দরকার আধুনিক অস্ত্র। রডা কোম্পানির বন্দুক লুঠ করে তা পাওয়াও যায়। বিদেশি শক্তির সাহায্য নিয়ে আসা জাহাজের অপেক্ষায় যতীন সদলবলে যায় বালেশ্বরে। ওদিকে টেগার্টও বসে নেই। সেও নিজের মতো করে জাল বিস্তার করে। খবর আসে, বিদেশি জাহাজ ম্যাভেরিক মার্কিন গোয়েন্দাদের হাতে ধরা পড়েছে। এবার যতীন সিদ্ধান্ত নেয়, আর পালাবে না। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে লড়বে। বাকি কাহিনি সকলেরই জানা।
আরও পড়ুন: ₹৫০ কোটি হাঁকলেন সানি
এ ছবির অন্যতম সম্পদ হলো চরিত্র নির্বাচন ও আবহ। মূল চরিত্রের পাশাপাশি পার্শ্বচরিত্রে অরবিন্দ ঘোষরূপী সজল মন্ডল, বিপ্লবী বীরেন্দ্রনাথ দত্তের চরিত্রে অভিরূপ চৌধুরী, চারুচন্দ্র বসুর ভূমিকায় উজ্জ্বল ঘোষ, রাসবিহারী বসুর ভূমিকায় কোলাজ সেনগুপ্ত, কানাইলাল দত্ত হিসেবে সৌরভ ঘোষের আসল ছবি দেখে থাকলে চরিত্র নির্বাচনের দক্ষতা সম্পর্কে বোঝা যাবে। ‘বাঘা যতীন’কে মশলা-ছবি বানানোর জন্য যথাযথ আবহ দিয়েছেন নীলায়ন চট্টোপাধ্যায়।
প্রাপ্তির ঝুলিতে এইটুকু থাকলেও, অপ্রাপ্তির খাতায় জমা পড়ল অনেককিছু। অরুণ ও সৌনাভ বসুর লেখা চিত্রনাট্যের মেদ ক্লান্তির উদ্রেক করে। যতীনের জন্য সৌনাভর লেখা কিছু রক্ত গরম করা সংলাপ থাকলেও সেগুলি হাস্যকর বলে মনে হয়। ছবির প্রথমার্ধে যেভাবে তৎকালীন কিছু স্মর্তব্য, অথচ বিস্মৃতপ্রায় বিপ্লবীদের ইতিহাসকে যথাসাধ্য পরপর সাজিয়ে পেশ করার চেষ্টা করা হলো, ছবির দ্বিতীয়ার্ধ তার তুলনায় অনেকটাই ঢিলেঢালা। অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে সংক্ষেপে দেখিয়ে তাড়াহুড়ো করে বুড়িবালামের যুদ্ধে চলে যাওয়ার চেষ্টা করা হলো। এর আগে ‘এগারো’, ‘হীরালাল’ বা ‘৮/১২’ ছবিতে অরুণ যে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন, এই ছবিতে তা যেন কিছুটা কম বলে মনে হলো।
আরও পড়ুন: এত ‘অরণ্য’ কেন?
অভিনয়ের দিক থেকে যতীন্দ্রনাথের ভূমিকায় দেব যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। তবু, বেশ কিছু অংশে তাঁর সংলাপ শুনে মনে হতে পারে, এই বীর বিপ্লবী বাংলার চেয়ে হিন্দি বা ইংরেজি ভাষাতে বেশি দক্ষ ছিলেন। ইন্দুবালা হিসেবে সৃজা খুব পরিসর না পেলেও নিজের কাজটুকু যথাযথভাবে করেছেন। বিনোদবালা ও ক্ষুদিরামের ভূমিকায় সুদীপ্তা ও সমিউল নিজেদের সেরাটুকু দিয়েছেন। টেগার্টের ভূমিকায় কার্ল বিশেষ উল্লেখের দাবী রাখেন।
গোপী ভগতের চিত্রগ্রহণ যথাযথ। কয়েকটি দৃশ্য পর্দায় দেখতে ভালো লাগে। মহম্মদ কালামের সম্পাদনা আরও যথাযথ হয়ে ছবির দৈর্ঘ্য অন্ততপক্ষে দশ-পনেরো মিনিট কমে গেলেও কিছু যেত-আসত না। অরিজিৎ সিংহের কণ্ঠের গানটিও বাদ দেওয়া যেত। ছবির পোস্ট-প্রোডাকশনে তাড়াহুড়োর ছাপ স্পষ্ট। কালার কারেকশন এবং কয়কটি অংশের ডাবিং দেখলেই তা বোঝা যায়।
আরও পড়ুন: বড়পর্দায় ফিরছেন দেবশ্রী, সঙ্গী মিঠুন
ছবির ভিএফএক্সও তেমন উন্নত নয়। মাঝেমাঝে তা উত্তেজনার বদলে হাসির উদ্রেক হয়। ছবিটিকে সর্বভারতীয় করতে গিয়ে বুড়িবালামের যুদ্ধ ছাড়াও কয়েকটি দৃশ্যে দক্ষিণী ছবির ছাপ স্পষ্ট। এছাড়া ছবির প্রচারকালে যতীনরূপী দেবের যে ছদ্মবেশগুলির দেখ গিয়েছিল, তার খুব বেশি ব্যবহার এ ছবিতে দেখা গেল না।
তবু এ সকল অপ্রাপ্তিকে উপেক্ষা করেও দেখা যায় ‘বাঘা যতীন’। তার একমাত্র এবং অন্যতম কারণ হলো ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক নির্দিষ্ট পর্বের বহু শ্রুত-অশ্রুত কাহিনিকে এক সূত্রে বেঁধে বর্তমান যুগের দর্শকদের সামনে পেশ করার এমন নজির অমিল। পুজোয় দেবী দুর্গা দর্শনের পাশাপাশি একবার ‘দেব’দর্শনও করে আসাই যায়।