সত্যজিতের বিনির্মাণ, প্রতি পর্বেই নতুন মোচড়

সিরিজ: রে
পরিচালনা: সৃজিত মুখোপাধ্যায়, অভিষেক চৌবে, ভাসান বালা
অভিনয়ে: আলি ফজ়ল, শ্বেতা বসু প্রসাদ, শ্রুতি মেনন, অনিন্দিতা বসু, কে কে মেনন, রাজেশ শর্মা, বিদিতা বাগ, খরাজ মুখোপাধ্যায়, দিব্যেন্দু ভট্টাচার্য, অলকানন্দা রায়, মনোজ বাজপেয়ি, গজরাজ রাও, রঘুবীর যাদব, মনোজ পাহওয়া, হর্ষবর্ধন কাপুর, রাধিকা মদন, চন্দন রায় সান্যাল, আকাঙ্খা রঞ্জন কাপুর, লাভলিন মিশ্র
সময়: ৪ ঘন্টা (চার পর্বে)
RBN রেটিং: ৩.৫/৫

সত্যজিৎ রায়ের জন্মশতবর্ষে তাঁকে নিয়ে ভক্তদের মধ্যে উন্মাদনার শেষ নেই। জন্মশতবর্ষ উদযাপনে এবার শুধু বাঙালিরাই নন, গা ভাসিয়েছেন চেনা বৃত্তের বাইরের মানুষও। তাঁর লেখা চারটি কাহিনী নিয়ে সর্বভারতীয় স্তরের দর্শকের জন্য তৈরি হয়েছে নতুন ‘রে’। এর মধ্যে দুটি পর্বের পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন সৃজিত। বাকি দুটির এক একটি পরিচালনা করেছেন অভিষেক ও বালা।




ফরগেট মি নট (বিপিন চৌধুরীর স্মৃতিভ্রম)

মূল কাহিনীকে বর্তমান সময়ে নিয়ে আসার জন্য কাহিনীর চরিত্র থেকে শুরু করে ঘটনাপ্রবাহ, সবেতেই পরিবর্তন করেছেন সৃজিত। তা সত্ত্বেও সিরাজ আহমেদের চিত্রনাট্যে সত্যজিতের মূল কাহিনীর আবেশের ছোঁয়া ছিল স্পষ্ট। সত্যজিতের বিপিন এখানে কর্পোরেট জগতের নামকরা মুখ ইপ্সিত নায়ার। ঘটনাপ্রবাহ বদলের পাশাপাশি চরিত্রের মধ্যে বেশ কিছুটা ডার্ক থিম সঞ্চারিত হয়েছে। যার জন্য হয়তো নায়ক হয়েও পর্বের শেষে গিয়ে ইপ্সিতের জন্য দর্শকের মনে থেকে যায় ঘৃণামিশ্রিত করুণা।

ইপ্সিতের ভূমিকায় আলি ফজ়লের অভিনয় আগাগোড়া চোখে পড়ার মতো। শুধু তিনিই নন, ম্যাগির চরিত্রে শ্বেতা, অমলা নায়ারের ভূমিকায় শ্রুতি এবং রিয়া সারন রূপী অনিন্দিতার অভিনয় নজর কাড়ে।

সত্যজিৎ সৃষ্ট অন্যান্য চরিত্রদেরও সৃজিত হাজির করেছেন এই পর্বে। স্বপ্নিল সোনাওয়ানের ক্যামেরা বিশেষ প্রশংসার দাবি রাখে। নীতিন বেদের সম্পাদনা টানটান।

বেহরূপিয়া (বহুরূপী)

নামকরণে কোনও বদল আনেননি সৃজিত। গল্পের প্রেক্ষাপটেও কোনও বদল নেই। কাহিনীর পটভূমি কলকাতা ও সময়কাল বর্তমান। চরিত্র চিত্রণে বেশ কিছু স্তরের উপস্থিতি স্পষ্ট। এখানেও তাঁর ডার্ক থিম থেকে বেরিয়ে আসেননি সৃজিত। মূল কাহিনীর সাসপেন্স যেরকম হালকা, মুচমুচে আনন্দের সঙ্গে উপভোগ করা যায়, ‘বেহরূপিয়া’তে তা অনেকাংশেই আলাদা। বর্তমান সমাজের কিছু জ্বলন্ত সমস্যাকে মূল চরিত্রের সঙ্গে জড়িয়ে দর্শককে শুধু টানটান উত্তেজনাতেই রাখলেন না পরিচালক, পর্বের শেষে পাঠককে শিউরে উঠতে বাধ্য করলেন। তবে পর্বের কিছু অংশে সৃজিতের ‘ভিঞ্চিদা’র সঙ্গে মিল পাওয়া আশ্চর্যের কিছু নয়।

আরও পড়ুন: গার্হস্থ্য হিংসার শিকার, তবুও ঔজ্জ্বল্যে অম্লান

‘বেহরূপিয়া’-র নায়ক ইন্দ্রাশিস সাহার ভূমিকায় কেকে মেননের অভিনয় নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। ইন্দ্রাশিসের ঠাকুমার ভূমিকায় অলকানন্দা, দেবশ্রীর চরিত্রে বিদিতা, সুরেশ শর্মা ও নন্দ ঘোষের চরিত্রায়ণে রাজেশ ও খরাজের অভিনয় প্রশংসনীয়। পীরবাবার ভূমিকায় দিব্যেন্দু স্বল্প সংলাপেও অনবদ্য।

এই পর্বের ক্ষেত্রে আবারও আবহ এক জরুরি ভূমিকা পালন করেছে। সে জন্য সাগর কাপুরের সাধুবাদ প্রাপ্য। একাধিক লো লাইট ফ্রেমের জন্য অর্কদেব মুখোপাধ্যায়ের চিত্রগ্রহ প্রশংসনীয়। এছাড়া, বর্তমান কলকাতাকে চিত্রনাট্যের মাধ্যমে দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন সিরাজ।

হাঙ্গামা হ্যায় কিঁউ বরপা (বারীন ভৌমিকের ব্যারাম)

অভিষেক পরিচালিত এই পর্বটি পরপর দুটি ডার্ক কাহিনীর পর যেন  এক ঝলক তাজা বাতাস। মূল কাহিনীতে বিশেষ কোনও পরিবর্তন আনেননি পরিচালক। শুধু সত্যজিতের কাহিনীকে সর্বভারতীয় স্তরে গ্রহণযোগ্য করতে চরিত্রের নাম এবং তাদের অতীতকাহিনীতে সামান্য বদল আনা হয়েছে। তবে নীরেন ভট্টের চিত্রনাট্যে নির্মিত এই পর্বটি দেখার আগে যদি মূল কাহিনী কারোর পড়া থাকে, তাহলে তিনি অনায়াসেই বুঝতে পারবেন ঘটনাপ্রবাহে কোনও বদল নেই। এছাড়া পর্বের শেষ দিকে একটি বিশেষ ট্রিবিউট দেখে দর্শক চমৎকৃত হবেন বলেই আশা করা যায়।

আরও পড়ুন: বেহিসেবী জীবনযাপন, আজ স্মৃতির অতলে সৌমিত্র

অভিনয়ের দিক থেকে রাজু শেহওয়ানি ওরফে মুসাফির আলির চরিত্রে মনোজ ও আসলাম বেগের চরিত্রে গজরাজ কেউ কাউকে এক ইঞ্চি জমিও ছাড়েননি। এঁদের কমিক টাইমিংও চমৎকার। দুটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে রঘুবীর ও মনোজের অভিনয়ও দর্শকের মন কেড়ে নেয়।

অভিষেক এই পর্বটিকে মূলত পিরিয়ড পিস হিসেবেই রাখার চেষ্টা করেছেন। তাই অনুজ রাকেশ ধাওয়ানের চিত্রগ্রহণ ও মানস মিত্তলের সম্পাদনা প্রশংসনীয়। এই পর্বের মুসাফির আলি গজ়ল গায়। তাই আবহে সেই আবেশ প্রয়োজনীয় ছিল। দর্শকের মনে সেই আবেশ সঞ্চারে সম্পূর্ণ সফল নরেন চন্দভারকর ও বেনেডিক্ট টেলর।




স্পটলাইট (স্পটলাইট)

কাহিনীর মূল নির্যাস ছাড়া এই পর্বে আর কিছুই এক রাখেননি পরিচালক বালা। যে চরিত্রের কথা শুধুমাত্র মূল কাহিনীতে শোনা যায়, তারই দৃষ্টিকোণ থেকে এই পর্বটি নির্মিত হয়েছে। বাকি তিনটি পর্বের তুলনায় এই পর্বটি কিছুটা দুর্বল মনে হলেও এর পরতে-পরতে রয়েছে সত্যজিতের প্রতি নানা ট্রিবিউট। যেমন সুপারস্টার বিক্রম অরোরা ওরফে ভিকের ভূমিকায় হর্ষবর্ধনকে পরতে দেখা যায় গুপী গাইন বাঘা বাইনের পোস্টারের জামা। এ ছাড়া বিভিন্ন চরিত্রের মুখ দিয়ে নানা সংলাপ ও প্রপসের মাধ্যমে সত্যজিৎকে স্মরণ করেছেন পরিচালক।

শুধু তাই নয়, পর্ব চলাকালীন কিছু নামে একটু খটকা লাগার পরে টাইটেল কার্ডে গিয়ে আশ্চর্য হতে হয়। এই পর্বে একটি ছবির শুটিংয়ের কথা বলা হয়েছে। সেই ছবির নাম ‘চিড়িয়াঘর’, পরিচালক রমেন মল্লিক (বালা নিজে) ও চিত্রগ্রাহক ব্যোমকেশ বক্সী!

আরও পড়ুন: তিনবার অভিনেতা পাল্টে ‘গুপী’ হলেন তপেন

হর্ষবর্ধনের পাশাপাশি রাধিকা, আকাঙ্খা ও লভলিনও অনবদ্য। তবে এঁদের মধ্যে রবি ঘোষের চরিত্রে চন্দনের অভিনয় সবথেকে আকর্ষণীয়।

গান ও আবহকে সুকৌশলে ব্যবহার করেছেন রাহুল কাম্বলে। মূল থিমটি এক রেখে কাহিনীকে সম্পূর্ণ বর্তমান সময়ে নিয়ে আসা ও প্রতিটি চরিত্রকে নতুন করে তৈরির কৃতিত্বের দাবীদার চিত্রনাট্যকার নীরেন।

দ্বিতীয় সিজ়নের অপেক্ষা নিয়ে শেষ হয় না ‘রে’। আর তাই দর্শকের, বিশেষ করে বাঙালিদের মনে প্রশ্ন থেকেই যায়। আর এমন গল্প কি শোনাবেন না কেউ? চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ ভারতে যতটা পরিচিত, গল্পকার সত্যজিৎ ততটা নন। বাংলার বাইরে তাঁর গল্পকে জনপ্রিয় করার জন্যই এই প্রয়াস। সিরিজ়ে বর্তমান সময়ের ট্রিটমেন্টও সেই কারণেই। চার পরিচালকই বিনির্মাণ করেছেন সত্যজিৎকে এবং সেই কাজে তাঁরা সফল।



Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Diptajit

An avid reader and a passionate writer of crime fiction. Poems and verses are his second calling. Diptajit is the editor of a Bengali magazine. Nothing makes him weaker than books, films and food

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *