এ গোয়েন্দার সারল্যই হাতিয়ার
ছবি: ডিটেকটিভ
পরিচালনা: জয়দীপ মুখোপাধ্যায়
অভিনয়ে: অনির্বাণ ভট্টাচার্য, সাহেব ভট্টাচার্য, ইশা সাহা, অম্বরিশ ভট্টাচার্য, তৃণা সাহা, শ্রীতমা ভট্টাচার্য, কৌশিক চট্টোপাধ্যায়
দৈর্ঘ্য: ১ঘন্টা ৫৫ মিনিট
RBN রেটিং: ৩/৫
বাঙালি ও গোয়েন্দা গল্প, এ এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধন। প্রেম, বিরহ, ভূত, অ্যাডভেঞ্চার, কল্পবিজ্ঞান, রূপকথা সব ব্যাপারেই বাঙালির ব্যুৎপত্তি থাকলেও, গোয়েন্দা গল্পে তার যে অসীম আগ্রহ ও উৎসাহ তা সেই পাঁচকড়ি দে’র আমল থেকেই প্রমাণিত। অর্থাৎ বাঙালি আর কিছু পারুক না পারুক, রহস্য অনুসন্ধানের ব্যাপারে তার ধারেকাছে কেউ আসতে পারবে না। জ্ঞানবুদ্ধি হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে বাঙালি বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে বেশিরভাগ ছেলেমেয়েই মনে-মনে গোয়েন্দাগিরি চালিয়ে যায়। বাংলা সাহিত্য ও সিনেমায় গোয়েন্দার মার নেই। ব্যোমকেশ, কিরিটি, ফেলুদা, মিতিন, শবর, গোগোলরা তার প্রমাণ।
তেমনই এক চরিত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ডিটেকটিভ’ (১৮৯৮) গল্পের নায়ক মহিমচন্দ্র। চরিত্রটিকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ কোনও সিরিজ় করেননি, এবং তা সঙ্গত কারণেই। মহিমচন্দ্র আগাগোড়াই এই গোয়েন্দামনস্ক ছাপোষা বাঙালির প্রতিমূর্তি। সে পেশায় পুলিশের গোয়েন্দা হলেও অপরাধী তুখোড় না হলে তার মন ভরে না। ছোটখাটো অপরাধকে সে ধর্তব্যের মধ্যেই আনে না। তবে সে নিজেও অসাধারণ গোয়েন্দা হয়ে উঠতে পারেনি তা তার পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা দেখলেই বোঝা যায়। সে যাদের সন্দেহ করে তারা হয় কেরানী নয়তো স্কুলের সেকেন্ড টিচার বেরোয়। অপরাধ জগতের সঙ্গে দূরতম কল্পনাতেও তাদের কোনও যোগাযোগ নেই। তবু মহিমের সন্দেহ করার রোগ যায় না, মেটে না অতৃপ্তি।
ছবির সময়কালকে সামন্য এগিয়ে ১৯০৫-এ এনেছেন পরিচালক। যোগ হয়েছে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় সাধারণ বাঙালির প্রতিক্রিয়া, রাখিবন্ধন ও অরন্ধন নিয়ে দেওয়াল লিখন এবং তৎকালীন বিপ্লবীদের কার্যকলাপ। কিন্তু এসবের থেকে মহিম (অনির্বাণ) নিজেকে সরিয়ে রাখে। সে একনিষ্ঠ গোয়েন্দা। তার সমস্ত নিষ্ঠা, মনোযোগ ও আগ্রহ শুধুমাত্র গোয়েন্দাগিরিতেই। চারপাশে ঘটে যাওয়া বিপ্লবী কার্যকলাপে তার বিন্দুমাত্র উৎসাহ নেই। ইংরেজ পুলিশের মাইনে করা গোয়েন্দা হয়েও সে ধুরন্ধর খুনি ও চতুর অপরাধীদের খুঁজে বেড়ায়। বাড়িতে স্ত্রী সুধামুখী (ইশা) ও বোন (তৃণা) থাকা সত্বেও তাদের সঙ্গে মহিমের খুব একটা মানসিক যোগাযোগ নেই। মহিম তার প্রকৃত পেশা এদের কাছেও গোপন রাখে। বাস্তবে যদিও তেমনটা হয় না, তবু গল্পের খাতিরে তা মেনে নেওয়াই যায়।
আরও পড়ুন: বাইপোলার ডিসঅর্ডার থেকে চরম অবসাদ, হোমসে ‘ডুবে’ গিয়েছিলেন জেরেমি
ছবির শুরুতে মহিমের স্বপ্নদৃশ্য বহুদিন বাদে নির্ভেজাল কমেডির স্বাদ দেয়। অনির্বাণের কমিক টাইমিং বরাবরই দর্শকদের তৃপ্ত করে। এখানেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। প্রথম দৃশ্যেই লন্ডনের রাস্তার প্রেক্ষাপটে বাঙালির ছিদ্রান্বেষণের খোঁচা থেকে শুরু করে কুমড়োর ছেঁচকি অবধি, সংলাপ দিয়েই মহিম চরিত্রটি সাহিত্যপ্রেমী বাঙালির মন জয় করতে সক্ষম হয়।
মহিমের একনিষ্ঠ সেবক হুতাশন (অম্বরিশ)। যদিও মহিম তাকে ‘ওয়াটশন’ বলে ডাকতেই অভ্যস্ত। মহিমের বাঙালি উচ্চারণে ইংরেজি বলা ও ‘স’কে ‘শ’ বলা চরিত্রটিকে অন্য মাত্রা দেয়। মহিমের সঙ্গে যোগ্য সঙ্গত করে যায় হুতাশন। যদিও মহিমের তুলনায় তার বাস্তববুদ্ধি অনেকটাই বেশি, তবু সে মহিমের অনুচর হয়ে থাকতেই পছন্দ করে। গোয়েন্দার তুলনায় তার অনুচর বেশি বুদ্ধি রাখে এমনটা বাংলা গোয়েন্দা কাহিনীতে বিশেষ দেখা যায় না। আর সেখানেই এই কমেডির জিৎ। চেনা ছকের বাইরে বেরিয়ে এক অতি সতর্ক বোকাসোকা গোয়েন্দার ভূমিকায় মহিমচন্দ্র দর্শকের মন জয় করে নেয়।
আরও পড়ুন: পঁচিশে ‘উনিশে এপ্রিল’
ছোটখাটো অপরাধী ধরে বিরক্ত মহিম অবশেষে একদিন মন্মথকে (সাহেব) খুঁজে পায় তারই বাড়ির সামনে। মন্মথকে দেখে তার মনে হয় এতদিনে কোনও যোগ্য অপরাধী পাওয়া গেছে। মূল গল্পে মন্মথর চরিত্রটি বিপ্লবী ছিল না। সে ছিল সুধামুখীর প্রেমিক। তবু সৌগত বসুর চিত্রনাট্যে যে বিপ্লবী প্রেক্ষাপট আনা হয়েছে তা গল্পের সঙ্গে যথেষ্ট মানানসই। বরং মূল গল্পেই মন্মথর চরিত্র কিছুটা উদ্দেশ্যহীন লাগে। বঙ্গভঙ্গের প্রেক্ষিতে গোপনে বিপ্লবী কার্যকলাপ চালিয়ে যাওয়া মাস্টারমশাই ও তার ছাত্রদের ডেরায় কুস্তি থেকে কালীমূর্তি, সবই গল্পের সঙ্গে মানিয়ে যায়।
রবীন্দ্রনাথের কাহিনীর মূল সুর ধরে রেখে গল্পের ক্লাইম্যাক্স পাল্টে দিয়েছেন জয়দীপ। এবং এখানেই ধাক্কা লাগে। মূল কাহিনীর স্বাদ বজায় রেখে নতুন প্রেক্ষাপটে গল্প শেষ করা যেত। নায়ক, নায়িকা, খলনায়কের সঙ্গে দেশভক্তি ও সততাকে মিশিয়ে দিয়ে একটা পোয়েটিক জাস্টিস করা গেলেও মহিমের সিধেসাধা সারল্য যেন কিছুটা হলেও হারিয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথের লেখার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই মহিমকে আরো মহিমান্বিত করা যেত। সেই বীজ পরিচালক মুনশিয়ানার সঙ্গে নিজেই বুনেছিলেন। তবু তা যেন হতে হতেও হলো না।
আরও পড়ুন: সিনেমার মতোই ছিল যে জীবন
এছাড়া সবই হলো। মন্মথর কপালে শিকে ছিঁড়ল, মাষ্টারমশাইয়ের কার্যসিদ্ধি ঘটল, হরিমতির অর্থপ্রাপ্তি হলো, সুধামুখীর একঘেয়ে জীবনের ইতি হলো, হুতাশনের সন্দেহের অবসান হলো, গোপালও শিক্ষা পেল। তবু যেন কী একটা বাকি রয়ে গেল।
এই বাকি রয়ে যাওয়ার আফসোসটুকু বাদ দিলে এ ছবি দর্শককে আগাগোড়া আনন্দ দেওয়ার জন্যই তৈরি। এই অতিমারীর সময়ে বাড়িতে বসে এরকম একটি প্রাকস্বাধীনতা যুগের কমেডি আঙ্গিকের নতুন ছবি দেখা কম বড় প্রাপ্তি নয়। একের পর এক ডার্ক থ্রিলার আর জটিল রাজনৈতিক সিরিজ়ের ভিড়ে এ ছবি যেন এক ঝলক তাজা বাতাস। রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের চলচ্চিত্রায়ণ খুব একটা দেখা যায়নি। উপন্যাস এসেছে ঘুরেফিরে। কিন্তু তাঁর কমেডিধর্মী গল্পের ওপর ভিত্তি করে ছবি করার সাহস তেমন কেউ দেখাননি। সেখানেই ‘ডিটেকটিভ’ সফল। পিরিয়ড গল্প (স্মার্টফোনের জন্য হলেও) দেখার মজাকে আগাগোড়া ধরে রাখে।
আরও পড়ুন: সব কান্নার শব্দ হয় না, বেজে উঠল পটদীপ
বাঙালির গোয়েন্দাপ্রীতিকে কটাক্ষ করে ‘হুমকি চিঠি নেই, সাংকেতিক ছড়া নেই, ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেই’ থেকে ‘একদিন এইসব লেখা ছেপে বেরোবে আর লোকে সেসবই হাইহাই করে পড়বে’ সংলাপ দিয়ে বাঙালির বর্তমান থ্রিলারপ্রেমকে বেশ একটু ঠেস দিলেন জয়দীপ। তবে তাতে ছবির মেজাজ এতটুকুও ক্ষুণ্ণ হয়নি। প্রতি কেসে মহিমের ‘গোয়েন্দা কে’, ‘তাহলে জেরা করবে কে’ ধাঁচের প্রশ্ন ও হুতাশনের উত্তর নির্ভেজাল হাসির উদ্রেক করে। তবে নিশিপদ্ম পোদ্দারের আধবুড়ো চরিত্রটিকে আরেকটু কমবয়সী করলে ভালো মানাতো।
এ ছবি অনির্বাণের একারই। কিছুটা হয়তো অম্বরিশেরও। হুতাশনকে ছাড়া মহিম সত্যিই অচল। বাকি চরিত্রগুলো এদের আলোয় ঢাকা পড়ে যায়। সাহেবের শরীরী ভাষায় প্রাকস্বাধীনতা যুগের ছাপ আরও একটু থাকলে ভাল লাগতো। তবে তাঁর মন্মথ বিশ্বাসযোগ্য। ইশা তাঁর চরিত্রে যথাসাধ্য করেছেন। আলাদাভাবে নজর কাড়ে তৃণার অভিনয়। স্বল্প পরিসরেও তাঁকে খুব সপ্রতিভ লাগে । শ্রীতমার নাটুকে সংলাপ বলা হরিমতিকে ফুটিয়ে তুলতে সাহায্য করে। মাষ্টারমশাইয়ের ভূমিকায় কৌশিক বেশ দুর্বল।
জয় সরকারের আবহ ছবির সঙ্গে মানানসই। মধুরা ভট্টাচার্যের গলায় ‘খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি’ শুনতে ভালো লাগে।
‘ডিটেকটিভ’-এর প্লট ও ক্লাইম্যাক্সে কিছুটা দুর্বলতা থাকলেও, প্রেক্ষাপট ও মহিমের জন্যই ছবিটা দেখতে ভালো লাগে। গড়পড়তা থ্রিলারের ভিড়ে মহিমের সারল্য ও জটিলতাবিহীন গল্পের গতি এ ছবির সবথেকে বড় প্রাপ্তি।