ক্ষয়িষ্ণু রাজরক্ত ও একটি সন্ধ্যার গল্প
ছবি: বসু পরিবার
পরিচালনা: সুমন ঘোষ
অভিনয়ে: সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, অপর্ণা সেন, ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, কৌশিক সেন, পরাণ বন্দোপাধ্যায়, সুদীপ্তা চক্রবর্তী, যীশু সেনগুপ্ত, লিলি চক্রবর্তী, অরুণ মুখোপাধ্যায়, শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়, শ্রীনন্দা শংকর, শুভাশিস মুখোপাধ্যায়
দৈর্ঘ্য: ১ ঘন্টা ৫১ মিনিট
RBN রেটিং: ৩/৫
মূল গল্পের নাম ‘দ্য ডেথ’, লেখক জেমস জয়েস। তা সে গল্প পড়া থাক বা না থাক, প্রায় দুই দশক পর আবার একসাথে তাঁরা। তারকাখচিত ‘বসু পরিবার’-এর মূল আকর্ষণ যে প্রণব-মঞ্জরী (সৌমিত্র-অপর্ণা) জুটি, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ছবির শুরুতেই ‘সমাপ্তি’র রেশ। রাজবাড়ি, মানে বসু বাড়ির কড়িকাঠ, বৈঠকখানা, পুকুরপাড় আর দেওয়ালে টাঙানো পূর্বপুরুষদের ছবির মাঝে সৌমিক হালদারের ক্যামেরা থমকায় মানিকবাবুর ফ্রেমে।
প্রণব আর মঞ্জরীর পঞ্চাশ বছরের বিবাহবার্ষিকী উপলক্ষে কাছের মানুষের পরিবারে ফেরা নিয়ে গল্প শুরু। ছেলে রাজা (যীশু) তার স্ত্রী রশ্মিকে (শ্রীনন্দা) নিয়ে সুদূর আমেরিকা থেকে কলকাতায় আসে। সঙ্গে আসে বিবাহিতা দিদি মামনি (ঋতুপর্ণা)। নিমন্ত্রণ পায় প্রণবের বিধবা বড় বৌদি (লিলি) আর তার ছেলে, মঞ্জরীর আদরের টুবলু (শাশ্বত)। যদিও বসু পরিবারের সর্বময় কর্তার প্রতি টুবলুর তীব্র বিদ্বেষ কোনও এক অজানা কারণে। মধ্যবিত্ত তনু (কৌশিক) আর ছাপোষা পম্পি (সুদীপ্তা) মামা-মামীর শুভ অনুষ্ঠানে আসে পরিপাটি বেশে।
এ গল্প একটা গোটা দিনের, এক ঝলমলে সন্ধ্যার যে কি না বড়াই করে রাজরক্ত আর ঐতিহ্যের। অথচ রাত যত গভীর হয়, বসু পরিবারের অন্তঃসারশূন্য মলিন আভিজাত্য চোখে আঙুল দিয়ে বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। জানা যায় তনুর আসল সত্য। এক সন্তানের বাবা হওয়া সত্ত্বেও, সমলিঙ্গের প্রতি তার চিরকালের আকর্ষণের কথা। বসু পরিবারের নববধূর কাছে বংশধর দেওয়ার আবদার এলে জানা যায় যে আসলে রাজরক্তই অপারগ। বাড়ির মেয়ে মামনির সফল কেরিয়ার আর অসফল সংসার, এই সবকিছু যেন বসু পরিবারের ফেলে আসা অতীতকে বার বার উসকে দেয়। আর সব শেষে এক চরম সত্যর মুখোমুখি দাঁড় করায়, যেখানে পঞ্চাশ বছরের বিবাহিত জীবনে মঞ্জরীর মনে প্রশ্ন জাগে, সে কি আদৌ ভালো আছে?
যে জন থাকে মাঝখানে
কিছুদিন আগে অপর্ণা জানিয়েছিলেন যে মূল গল্প তাঁর পড়া। পরিচালক সুমনও বলেছেন, রিনা ম্যাডাম রাজি না হলে এ ছবি তিনি করতেন না। অপরিহার্য না হলেও এ ছবি অবশ্যই অপর্ণার, তাঁর অনুভুতি আর ম্যানারিজ়মের। স্মৃতিচারণায় চোখের জল আনা থেকে সহানুভূতি ও সমবেদনার মৃদু হাসি, তাঁর অভিনয় নিয়ে কোনও প্রশ্ন ওঠার অবকাশ নেই। সৌমিত্রও বরাবরের মতই চেনা ছন্দে। রবীন্দ্রনাথের কবিতা যেন তাঁর কন্ঠে আলাদা রূপ ধারণ করে। তবে জুটির প্রত্যাবর্তন হিসেবে ঝকঝকে ফ্রেম ছাড়া দর্শকের আর খুব একটা কিছু পাওয়ার নেই।
অভিনয় বিভাগে যীশুর মত অভিনেতার এই ছবিতে কিছু করার ছিল না। ‘এক যে ছিল রাজা’ আর ‘মহালয়া’র পর এখানে বড়ই অসহায় লেগেছে তাঁকে। ‘মহালয়া’র বীরেন্দ্রকৃষ্ণ এই ছবিতে বসু পরিবারের অনুগত ভৃত্য ফটিক (শুভাশীষ)। ঋতুপর্ণা যথাযথ। বিবাহ বার্ষিকীর ঝলমলে সন্ধ্যায় তার এবং যীশুর বাগানের দৃশ্য ভালো লাগে। সিঁড়ির কোণের আদর বা ছবির ক্লাইম্যাক্সে দরজার পাশে চোখাচোখি, অপর্ণা-ঋতুপর্ণা রসায়নকে মনে করায়। খানিকটা মেয়েলী ভঙ্গিমায় কৌশিকের অভিনয় বেশ ব্যতিক্রমী। প্রণবের দীর্ঘদিনের বন্ধু হিসেবে পরাণের কৌতুক উপস্থিতিও বেশ ভালো। সুদীপ্তাও পম্পির জন্য উপযুক্ত।
শব্দ যখন ছবি আঁকে
তবে অরুণ মুখোপাধ্যায়ের হাবভাব গল্পে নতুন মোড় আনে। আর বলতেই হয় শাশ্বতর পরিমিত অভিনয় আর অভিব্যক্তির কথা। বিক্রম ঘোষের আবহ এই ছবিতে একটা ধ্রুপদী মাত্রা যোগ করে। ছবির দৃশ্যপট চমৎকার, সম্পাদনা পরিমার্জিত। কিন্তু তা সত্বেও কোথায় যেন একটা খামতি থেকে যায়। এত তাবড় অভিনেতাদের ভিড়ে মাঝেমাঝেই হারিয়ে যায় গল্পের মূল সুর। বিরতির পর বেশ ঝিমিয়ে পড়ে ছবির গতি। তবুও এই ছবির আকর্ষণ বজায় থাকে অপর্ণা, অরুণ আর সৌমিত্রর অভিনয় মুন্সিয়ানায়।
পঞ্চাশ বছরের বিবাহিত জীবন পেরিয়ে প্রণব যদিও বলেন, ‘মঞ্জরীকে পেয়ে আজ আমি তৃপ্ত,’ কিন্ত নস্ট্যালজিয়া প্রিয় বাঙালির অন্যতম হিট জুটিকে এত বছর পর এক ফ্রেমে পেয়েও কিছুটা অতৃপ্ত হয়েই প্রেক্ষাগৃহ থেকে বেরোতে হয়।