চিত্রনাট্যের দুর্বলতায় আক্রান্ত

ছবি: শ্লীলতাহানির পরে

পরিচালনা: রেশমি মিত্র

অভিনয়ে: দেবলীনা কুমার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, শ্রীলা মজুমদার, শুভম, অভিষেক চট্টোপাধ্যায়, রাহুল বন্দ্যোপাধ্যায়, মৌবনী সরকার, ঈশান মজুমদার, রায়তি ভট্টাচার্য

দৈর্ঘ্য: ১ ঘন্টা ৪০ মিনিট

RBN রেটিং: ২.৫/৫

বর্তমান সমাজে দাঁড়িয়ে ‘শ্লীলতাহানি’ বা ‘ধর্ষণ’ শব্দগুলো অচেনা তো নয়ই বরং বাকি বাংলা শব্দের চেয়ে একটু যেন বেশিই চেনা। খবরের কাগজ খুললে প্রায়দিনই দেশের কোথাও না কোথাও ধর্ষণের খবর পাওয়া যায়। সহনশীলতার চরম পর্যায়ে পৌঁছে গিয়ে মানুষও যেন বাস্তবকে মেনে নিতে শুরু করেছে। শাস্তি হোক বা না হোক, অপরাধীকে মানুষ ভুলে যায়, বরং বার-বার নানাভাবে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয় আক্রান্ত মেয়েটিকে। পুলিশ থেকে আদালত সর্বত্র হাজারো সন্দিগ্ধ চোখের সামনে তাকে প্রমাণ দিতে হয় সে ধর্ষিতা। প্রতিদিন অজস্র কৌতূহলী চোখ বারংবার তার নারীত্বকে কাটাছেঁড়া করে। বিচার পেতে-পেতে কেটে যায় দিন, মাস, বছর। ফিরতে কি পারে সে মেয়েটি তার আগের জীবনে? ফেরা হয় কি? 




এই বিষয়ের উপর ভিত্তি করে মল্লিকা সেনগুপ্ত লিখেছিলেন ‘শ্লীলতাহানির পরে’ উপন্যাসটি। সেই গল্প অবলম্বনে একই নামের ছবিতে যদিও মূল সমস্যা যেন অনেকটাই অধরা রয়ে গেল। চিত্রনাট্যের দুর্বলতা ও কিছু চরিত্রে সঠিক চরিত্রায়নের অভাব একটি সৎ প্রয়াসকে বিষয়ের গভীরতায় পৌঁছতে দিল না। 

সংলাপ (রাহুল), রিকি (দেবলীনা), ব্রতীন (ঈশান) ও মীনাক্ষী (রায়তি) কলেজ জীবনের বন্ধু। পেশাদার জীবনে ব্যস্ত হয়ে পড়েও তারা তাদের বাংলা গানের ব্যান্ডকে এখনও টিকিয়ে রেখেছে, যার মূল গায়ক সংলাপ। সে পেশাদার গায়কও বটে। এর মধ্যে ব্রতীন ও মীনাক্ষী আট বছর আগে বিয়ে করেছে। সংলাপের স্ত্রী শুভেচ্ছা (মৌবনী) তাকে কাছে পেতে চাইলেও সে বিশেষ ধরা দেয় না। যদিও সংলাপ-শুভেচ্ছার বিয়েটা ভালবাসার। রিকির বস বিজনের (অভিষেক) উদ্যোগে সকলে দিঘা বেড়াতে যায়। এদিকে বিজনের স্ত্রী মন্দিরা (শ্রীলা) রাজনৈতিক দলের সক্রিয় কর্মী। বর্ষীয়ান নেতা অমূল্য সান্যালের (সৌমিত্র) কথায় মন্দিরা পুরুলিয়া যায় মালতী মুদির শ্লীলতাহানির ব্যাপারে তার পাশে দাঁড়াতে। ওদিকে দিঘা বেড়াতে গিয়ে রিকির ওপর চড়াও হয় বিজন। অনেকদিন ধরেই তার রিকির ওপর লোভ ছিল। আচমকা শ্লীলতাহানির পর রিকির বন্ধুদের অবস্থান, সাংবাদিক রাজকুমারের (শুভম) সহমর্মিতা এবং মন্দিরা ও তার দলের বক্তব্য ক্রমশ পরিষ্কার করে দেয় এই সমাজে একটা মেয়ের অসম্মানকে ঠিক কোন দৃষ্টিতে দেখা হয়। 

আরও পড়ুন: বেহিসেবী জীবনযাপন, আজ স্মৃতির অতলে সৌমিত্র

উপন্যাসের বিষয়বস্তু নিঃসন্দেহে নাড়িয়ে দেওয়ার মতো। কিন্তু ছবিতে গল্পের মূল ঘটনা যথেষ্ট দুর্বল লেগেছে। বসের শারীরিক আক্রমণের মুখে পড়ে রিকির আত্মরক্ষার চেষ্টা খুব একটা বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে না। বেড়াতে গিয়ে বন্ধুদের মধ্যে কথোপকথনও বাস্তবসম্মত লাগে না। বিজনের মতো দুবৃত্তকে হাস্যকর করে দেখানোর কী মানে তা স্পষ্ট হলো না। বিজন ও মীনাক্ষীর ঘনিষ্ট দৃশ্যগুলিকে ছবিতে কমিক রিলিফ হিসেবে রাখা হলেও দর্শকাসনে বসে ওই মুহূর্তে বিরক্ত লাগাই স্বাভাবিক। বসের হাতে রিকির হেনস্থার পর শুভেচ্ছা কেন জ্যোতিষীর কাছে যায় তাও স্পষ্ট নয়। ছবিকে অনর্থক পণ্যের বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্র করে তোলার কারণই বা কী বোঝা যায় না। সাংবাদিকের চরিত্রটি অভিনয়ের দুর্বলতার কারণে গুরুত্ব হারিয়েছে। এই চরিত্রের পোশাকও বেশ চোখে লাগে। তবে খুব ছোট পরিসরে শ্লীলতাহানির অভিযোগ গ্রহণকারী পুলিশের চরিত্রাভিনেতার অভিনয় যথাযথ। 

আরও পড়ুন: শেষের সেদিন, উপস্থিত ছিলেন শুধু মহেশ ও ড্যানি

এই ছবিতে বয়োজ্যেষ্ঠ অভিনেতারা প্রত্যেকেই নিজের ভূমিকার প্রতি সুবিচার করেছেন। সৌমিত্রর চরিত্রটি ছোট হলেও গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর অঙ্গুলিহেলনে স্থির হয় মন্দিরার মতো নেত্রীর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ। কখনও তিনি অভিভাবক তো কখনও আবার ভোটের রাজনীতি করা সুযোগসন্ধানী নেতার প্রতীক। প্রত্যাশা মতোই চরিত্রের প্রয়োজন পূরণ করেছেন প্রয়াত অভিনেতা।

শ্রীলাকে নিঃসন্দেহে এ ছবির সবচেয়ে শক্তিশালী অভিনেতার তকমা দেওয়া যায়। অভিজ্ঞ অভিনেতার মতোই শুরু থেকে শেষ অবধি হুবহু মন্দিরা হয়ে উঠেছেন তিনি। তাঁর পোশাকও আলাদাভাবে নজর কাড়ে। রুচিশীল ও মার্জিত সাজে শ্রীলাকে সুন্দর লেগেছে। অনেকদিন পর বড় পর্দায় এলেন অভিষেক। বড়লোক, লম্পট ও হালকা বুদ্ধির বিজনরূপে মানিয়ে গেছেন তিনি। তবে চিত্রনাট্যের হাতে পড়ে ১০০ শতাংশ খলনায়ক হয়ে ওঠা হলো না তাঁর। 




সংলাপের ভূমিকায় রাহুল তাঁর নিজের মতোই, দীর্ঘদিন ধরে তাঁর অভিনয়ে নতুনত্বের কোনও ছোঁয়া পাওয়া যাচ্ছে না। নায়িকারূপে দেবলীনার সম্ভবত এটি প্রথম কাজ। আশা করা যায় সময়ের সঙ্গে তিনি আরো পরিণত হবেন। শুভেচ্ছারূপে মৌবনী তাঁর চরিত্রের প্রতি সুবিচার করেছেন, আগামী দিনে নানা চরিত্রে তাঁকে দেখার আশা রইল। ব্রতীনের চরিত্রটি আর একটু বড় হতে পারত, একজন আইনজীবীর ভূমিকায় সে রিকির পাশে দাঁড়ালেও তা ওই একটি দৃশ্যেই সীমাবদ্ধ। ব্রতীনের ভূমিকায় ঈশানের অভিনয় প্রশংসনীয়। তাঁর সংযমী অভিনয় ভবিষ্যতে তাঁকে আরো বড় চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ করে দেবে আশা করা যায়। ছবির জগতে নতুন হলেও তাঁর চরিত্রকে এক অনন্য মাত্রা দিয়েছেন রায়তি। 

মূল গল্পের শক্তিশালী প্রেক্ষাপট ছবির প্রতি আগ্রহ তৈরি করতে সক্ষম হলেও আলগা চিত্রনাট্যের জন্য কিছু জায়গায় ছবিটি মনোযোগ টেনে রাখতে ব্যর্থ। রাজা নারায়ণ দেবের সুরে ও গৌতম সুস্মিতের কথায় ছবির গানগুলি শুনতে ভালো লাগে। 

Amazon Obhijaan



Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Swati

Editor of a popular Bengali web-magazine. Writer, travel freak, nature addict, music lover, foody, crazy about hill stations and a dancer by passion. Burns the midnight oil to pen her prose. Also a poetry enthusiast.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *