সেলফির হিড়িক, বেলাগাম মদ্যপান, পরিবেশ ধ্বংসের সাক্ষী এবারের বসন্ত উৎসব
হুজুগে বাঙালির উৎসবের শেষ নেই। তা সে মহালয়ার দিন থেকে ঠাকুর দেখা শুরু করে দেওয়াই হোক কিংবা পঁচিশে বৈশাখে জোড়াসাঁকো গিয়ে সেলফি তোলাই হোক। ঝালে-ঝোলে-অম্বলের মত বাঙালি এখন গনেশ পুজোতেও আছে আবার ভ্যালেন্টাইন্স ডে’তেও আছে। আর বিগত কয়েক বছর ধরে, বাঙালির হুজুগের লিস্টে যোগ হয়েছে শান্তিনিকেতনের বসন্ত উৎসব।
দোলপূর্ণিমা উপলক্ষ্যে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয় বসন্ত উৎসব। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আদর্শে অনুপ্রাণিত এই উৎসব পালিত হয় তাঁরই সৃষ্টিকে সম্বল করে। কিন্তু বিপুল জনসমুদ্রে এই বছর সেই উৎসব পরিণত হল প্রহসনে। প্রশাসনের চরম ব্যর্থতা ও দর্শনার্থীদের কাণ্ডজ্ঞানহীন আচরণে নরক হয়ে উঠল বিশ্বভারতী তথা গোটা শান্তিনিকেতন ও সংলগ্ন অঞ্চল।
২১ মার্চ দোলপূর্ণিমার দিন বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে যা ঘটল, তার সূচনা হয় আগের দিন থেকেই। হাজার হাজার মানুষ ভোররাতেই বোলপুর স্টেশনে এসে পৌঁছন। গাড়ি, বাইকে চেপেও আসেন অনেকে। তাদের অনেকেরই উদ্দেশ্য বন্ধুরা মিলে শুধুমাত্র বেলাগাম হুল্লোড়ে অংশ নেওয়া। বেশিরভাগ মানুষই বিশ্বভারতী কি তা না জেনেই চলে এসেছেন। ফল যা হওয়ার তাই হল। এই বিরাট সংখ্যক জনতার আগমনে ভয়াবহ রূপ নিল বসন্ত উৎসব আর প্রাণান্তকর সময় কাটালেন স্থানীয় মানুষজন।
এবার নিজের গলায় গান গেয়ে চমকে দিলেন নূর
গোটা ঘটনায় ভয়ানক ক্ষুব্ধ শান্তিনিকেতনের সীমান্তপল্লীর বাসিন্দা সায়ন্তনী মহাপাত্র। তিনি জানালেন, “যারা এখানে থাকেন তাঁদের অবস্থা শোচনীয়। সমস্ত বাড়ির সামনে এমনভাবে বাঁশের ব্যারিকেড করা হয়েছে যে বাইরে বেরোনো যাচ্ছে না। অনেক বাড়িতেই বয়স্ক মানুষরা থাকেন। তাঁদের পক্ষে গাড়ি ছাড়া বেরোনো মুশকিল। কিন্তু অবস্থা এমনই যে পায়ে হেঁটে ছাড়া কোনওভাবেই বাড়িতে ঢোকা বা বেরোনো সম্ভব নয়। ভিড় ঠেকাতে গিয়ে প্রশাসন আমাদের কথা ভাবছে না।”
প্রতিবছর পৌষ মেলা আর বসন্ত উৎসব, এই দুটো অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে কলকাতা ও অন্যত্র থেকে আসা মানুষের চাপে প্রাণ অতিষ্ট হয়ে উঠছে শান্তিনিকেতনের বসবাসকারীদের। এই ক’টাদিন দৈনন্দিন জীবনযাত্রা যেভাবে ব্যাহত হয় তার জন্য তাঁরা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ।
এক উপরি পাওনা, তারপর নিকষ কালো অন্ধকার
সায়ন্তনীর কথাতেই তা পরিস্কার। “বিশ্বভারতীর কিছু নিজস্ব নিয়ম আছে। বাইরে থেকে আসা লোকজন সেসব জানেন না, জানার কোনও ইচ্ছেও নেই। বৈতালিকের অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার আগে আবির খেলার নিয়ম নেই। অথচ এরা ভোর থেকেই রঙ মেখে, মুখোশ পড়ে, মাথায় জোকারের মত নকল চুল লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। বেশিরভাগ মানুষই জানেন না রবীন্দ্রনাথ কে বা বিশ্বভারতী কি। শুধুমাত্র হুজুগে চলে এসেছে সবাই। সেজেগুজে ছবি তোলাটাই যেন একমাত্র উদ্দেশ্য। অনেকেই মূল মঞ্চ দেখে বলছেন, এরকম ম্যাড়ম্যাড়ে মঞ্চ কেন, আর একটু ঝকঝকে করেলই তো পারত।”
অর্থাৎ রবীন্দ্রভাবনার সঙ্গে আগতরা কেউই পরিচিত নন। শান্তিনিকেতনের ঐতিহ্য কি তা জানেন না। তবু মানুষের আসা চাই। বাচ্চা নিয়ে এসেছিলেন অনেকেই। বাচ্চারা ভিড়ের চাপে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ভুবনডাঙার ব্যবসায়ীরা বাচ্চাদের ভিড় থেকে তুলে ছাদে নিয়ে এসে সুস্থ করেন। না হলে সেদিন অনেক বড় দূর্ঘটনা ঘটে যেতে পারত। ভিড়ের মধ্যে আটকে পড়ে অ্যাম্বুলেন্সও। কোনও গাড়িই এগোচ্ছিল না। এমন কি কোনও বাড়িতে কেউ যদি অসুস্থ হয়ে পড়েন, তাহলে তাকে ডাক্তার দেখাবারও কোনও উপায় ছিল না সেদিন। আশ্রমিকদের জন্য আলাদা জায়গা থাকলেও কোনও কার্ডের ব্যবস্থা না থাকায় তারাও ঢুকতে পারেননি মূল উৎসব চত্বরে। এই নিয়ে প্রাক্তনীদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে ক্ষোভ।
ছবি তোলানোর হিড়িক
অবস্থা এমন জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে যে স্থানীয় মানুষ বিরক্ত হয়ে বসন্ত উৎসব ও পৌষ মেলা দেখতে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। পুলিশ-প্রশাসনও নির্বিকার। উৎসবের আগেরদিন ‘সুন্দর’ নাটকটা দেখতে গিয়েছিলেন সায়ন্তনী। জানালেন, “সেখানে গিয়ে দেখি, মুড়ি চিপস বিস্কুট সিগারেট সবই বিক্রি হচ্ছে। লোকে খাচ্ছেও দেদার। কারোর অনুষ্ঠান দেখার মানসিকতা নেই। দশ মিনিট দেখেই তারা উঠে যাচ্ছেন। সব মিলিয়ে আমার মনে হয় বসন্ত উৎসব নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে,” ক্ষোভ উগরে দিয়ে বললেন বিশ্বভারতীর এই প্রাক্তনী।
বিশিষ্ট শিল্পী সুধীরঞ্জন মখোপাধ্যায় নিজে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাঁর বক্তব্য, বসন্তোৎসবের সময় শান্তিনিকেতনবাসীদের বাইরে কোথাও চলে যাওয়া উচিত। তিনি ও তাঁর ছাত্রছাত্রীরা দশ দিন ধরে মঞ্চসজ্জা ও পোশাকের কাজ করলেও মূল অনুষ্ঠানে ঢোকার প্রবেশাধিকার পাননি। এমনকি মঞ্চসজ্জার শিল্পী হিসেবে সামান্য নামোল্লেখটুকুর মর্যাদাও জোটেনি তাঁর। ১৯৭৫ সাল থেকে দীর্ঘ ৪৪ বছর ধরে আশ্রমের সমস্ত নান্দনিক কাজে যুক্ত থেকে যদি প্রধান শিল্পীকে এভাবে অপমানিত হতে হয় তাহলে সাধারণ রবীন্দ্র অনুরাগী দর্শকদের কি অবস্থা হয়েছে তা সহজেই অনুমেয়।
তাশি গাঁওয়ে একদিন
ঘটনা হল, এখানে নাটক ও নৃত্যনাট্যের মূল মঞ্চসজ্জার দায়িত্বে থাকা সুধীরঞ্জনবাবুকে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ চেনে না। অনুষ্ঠানের দিন তাঁকে বাকি কাজ শেষ করার জন্যেও ঢুকতে দেওয়া হয়নি, এমনটাই অভিযোগ।
কলকাতার ডানলপ নিবাসী চৈতালি ভৌমিকের ছোটবেলা কেটেছে শান্তিনিকেতনে। এবারের বসন্ত উৎসব কেমন লাগল বলতে গিয়ে তার গলায় স্পষ্টতই উঠে এল হতাশা। “সোনাঝুরির রাস্তায় অজস্র মানুষ আর গাড়ির মেলা। কিন্তু একটা গাড়িও নড়ছে না। প্রায় দেড় কিলোমিটার হাঁটতে হল বাচ্চাদের নিয়েই। টোটোওয়ালারা তিনশো টাকা চাইছিল। অতটা হেঁটে গিয়ে একটা ভ্যানো পেলেও, সেও ১৬০ টাকা চাইল। অথচ সোনাঝুরির অনেক আগেই চেকপোস্টে আটকে দেওয়া হল সেটাকে। সেখান থেকে খোয়াই হেঁটে প্রায় দু কিলোমিটার। উপায় নেই তাই যেতে হল। অথচ গিয়ে কিছুই পেলাম না। এতদিন ধরে যাচ্ছি, নানান জায়গায় অনুষ্ঠান দেখেছি। এবার কিছুই নেই। শুধু মানুষের মাথা, আর মদ্যপদের ভিড়। রাস্তার ধারে কাগজ পেতে বসে লোকে মদ খাচ্ছে এমনও দেখলাম। কেউ কিছু বলার নেই। বিশ্বভারতী ক্যান্টিনেও অনেকেই দুপুরবেলাতেই নেশা করে বসেছিলেন। বাচ্চা নিয়ে গিয়ে কি বিশ্রী অভিজ্ঞতা হল ভাবা যায় না।”
রক্তবরণ মুগ্ধকরণ
প্রশাসন থেকে প্লাস্টিকের ব্যবহার বারণ করতে বললেও তাতে কর্ণপাত করেননি প্রায় কেউই। উৎসবের মূল প্রাঙ্গন তো বটেই, রাস্তাতেও যত্রতত্র পড়েছিল প্লাস্টিক। চৈতালির দাবী, “এত নোংরা বসন্ত উৎসব আমি কখনও দেখিনি। আগে শুধু আবির খেলা হত। এবার তো তার সঙ্গে রঙ খেলাও হচ্ছে দেখলাম। সেলফি তোলার উৎপাতও সাংঘাতিক। এত খারাপভাবে শাড়ি পরা যায় সেটা এই প্রথম দেখলাম। এরা শুধু ঘুরতে আর ছবি তুলতে গেছে। ফেসবুকে ছবি দেওয়া ছাড়া এদের আর কোনও উদ্দেশ্য নেই। রবীন্দ্রনাথের যে বাসভবন সেখানে লোকই নেই। গামছা বিক্রি হচ্ছে সেখানে। যত লোক শুধু ওই মাঠে আর পুরো শান্তিনিকেতন এলাকায়।”
পরিবেশ ধ্বংসের অভিযোগও উঠেছে আগত দর্শকদের বিরুদ্ধে। গাছের ডাল ভাঙা হয়েছে নির্বিচারে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে পলাশের মুকুট পড়া। নষ্ট করা হয়েছে প্রচুর পলাশ গাছ।
উৎসব প্রাঙ্গনের আবর্জনা
“গান্ধীমূর্তির পাশে আমাকে একটি মেয়ে বলল, ‘একটু সাইড দিন না, ছবি তুলব।’ অর্থাৎ ওই মূর্তির সঙ্গে সেলফি তোলা হবে। যে শান্তিনিকেতনের প্রভাতফেরীতে একসময় আমি নিজে অংশ নিয়েছি, সেই জায়গাটা এভাবে নষ্ট হয়ে গেছে দেখে খুব খারাপ লাগছে। আর কখনও দোলের সময় শান্তিনিকেতন যাব না,” হতাশা না ঢেকেই বললেন চৈতালি।
চূড়ান্ত অব্যবস্থা ছিল এবার বসন্ত উৎসবকে ঘিরে। যে ভিড় মূলত বিশ্বভারতী সংলগ্ন মাঠে হওয়ার কথা, তা এক সময় বাড়তে বাড়তে ভুবনডাঙা, রাইপুরেও পৌঁছে যায়। এক পুলিশ আধিকারিকের কথায়, গত পাঁচ বছরের হিসেব অনুযায়ী এবারে আন্দাজ ছিল দেড় লাখ মানুষ আসবেন। সেভাবেই তৈরি করা হয়েছিল পরিকাঠামো। কিন্তু সেই সংখ্যাটা যে আড়াই লাখে গিয়ে পৌঁছবে সেটা ভাবা যায়নি। এক জায়গায় এত লোক সমাগমের কারণে স্বাভাবিক ভাবেই ভেঙে পড়ে মোবাইল ফোন পরিষেবা।
শব্দ যখন ছবি আঁকে
এছাড়াও যেখানে ২,০০০ গাড়ির রাখার ব্যবস্থা ছিল সেখানে ৫,০০০ গাড়ি এসে উপস্থিত হয়। ফল যা হওয়ার তাই হয়েছে। সকাল সাড়ে ন’টা থেকে প্রায় তিন ঘণ্টা যানবাহন স্তব্ধ হয়ে যায়। মনে করা হচ্ছে অনেকগুলো ছুটির দিন পরপর থাকাটাই হয়ত এই ভিড়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। “অন্য কোনও দিন ঠিক করে বসন্ত উৎসব পালন করার ব্যাপারে আলোচনা হয়ে থাকলেও কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি,” এমনটাই জানালেন পাঠভবনের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সুপ্রিয় ঠাকুর।
শান্তিনিকেতনের বাসিন্দা ও যারা প্রতিবছর অনুষ্ঠানের টানে বোলপুর যান, তাঁদের মতে এত বিশৃঙ্খলা কোনওবার দেখা যায়নি। ভিড় সামলাতে প্রশাসন ও বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ সম্পূর্ণ ব্যর্থ, এমনটাই অভিযোগ তাঁদের। রবীন্দ্রনাথের ভাবাদর্শ সম্পর্কে কিছুমাত্র না জেনে শুধু মদ খেয়ে ফুর্তি করতে আসা মেনে নিতে পারছেন না কেউ। চটুল হিন্দি ছবির গান গেয়ে তারা রঙ খেলেছেন ও সেলফি তুলেছেন। এদের কিভাবে আটকানো সম্ভব সেটা বোধহয় এবার ভেবে দেখার সময় এসেছে। বছরের পর বছর এলাকায় পাল্লা দিয়ে বেড়েছে বাংলো, রিসর্ট, ফ্ল্যাটবাড়ির সংখ্যা। আশ্রমের বাসিন্দা, ছাত্রছাত্রী ও প্রাক্তনীদের একাংশের মতে বহিরাগতদের ঢোকা বন্ধ করতে পারলে এই অসভ্যতা অনেকাংশে বন্ধ করা সম্ভব। শুধুমাত্র প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীরা আসুন। কিন্তু যারা রবীন্দ্রনাথকে জানেন না তারা এসে শান্তিনিকেতনের পরিবেশ নষ্ট করবে এটা মেনে নেওয়া যায় না। কলকাতা বা যাদবপুর কিংবা অন্য কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে যেখানে বহিরাগতরা ইচ্ছামত ঢুকতে পারেন না সেখানে বিশ্বভারতীতেই বা কেন তাদের ঢুকতে দেওয়া হবে, প্রশ্ন তাঁদের।