ভূত চতুর্দশীর রাত
ছোটবেলায় আমরা শুনতাম ১৪ পিদিমের রাত। এই দিন বাড়ির নানান জায়গায় ১৪টা প্রদীপ জ্বালাতেই হবে। না হলেই বিপদ।
কিন্ত কিসের বিপদ?
কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী তিথিকে বলা হয় ভূত চতুর্দশী। প্রতিবছর কালিপুজোর আগের দিন এই বিশেষ রাত আসে। এই দিন সন্ধ্যার পর নাকি তেনারা মর্ত্যের মাটিতে নেমে আসেন। অর্থাৎ যাঁদের খালি চোখে দেখা যায় না। শুধু অনুভব করা যায়।
এমন সব কথা আমাদের ছোটবেলায় বলা হতো। এইসব বলে দুপুরবেলায় ১৪ রকমের শাকের একটা মিশ্রণ খেতে বাধ্য করা হতো। নাহলেই নাকি সন্ধ্যেবেলা ভূতে ধরবে। আমরাও ভয়ে ভয়ে সেসব খেয়ে নিতাম। ভূত চতুর্দশীর নিয়ম অনুযায়ী বাঙালি পরিবারে ১৪ রকম শাক ভাজা খাওয়ার রেওয়াজ রয়েছে। সন্ধ্যে হবার আগেই নিয়ম মেনে বাড়ির আনাচে কানাচে ১৪টা প্রদীপ জ্বালাতে হতো। কোনও কোনও বাড়িতে আবার কপালে ঘি, কাজল আর তুলসীপাতা দেওয়ারও নিয়ম ছিল। এই টিপ দিতে হতো ছেলেদের কপালের ডানদিকে আর মেয়েদের কপালের বাঁদিকে।
আরও পড়ুন: যে আগুন নেভে না
কিন্তু ১৪ প্রদীপ দেওয়া হয় কেন?
বলা হয় এই ১৪ প্রদীপের আলো দেখে পূর্বপুরুষরা এক রাতের জন্য ফিরে আসবেন নিজ নিজ গৃহে। কেউ কেউ আবার ১৪ প্রদীপকে চতুর্দশী তিথি তথা রামের ১৪ বছর বনবাসের সঙ্গে একই সূত্রে যোগ করেন। ভূত চতুর্দশীকে কেউ কেউ আবার যম চতুর্দশী রূপেও পালন করে থাকেন। তাদের মতে ১৪ প্রদীপ আসলে যমের উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত হয় এইদিনে। এই আলোর মাধ্যমে যম বুঝতে পারেন মর্ত্যের মানুষ তাদের পূর্বপুরুষকে বিস্মৃত হয়নি। তাই একদিনের জন্য তিনি প্রত্যেক বংশের মৃত পূর্বপুরুষকে তার পরিবারের কাছে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেন। এই গল্প থেকে আবার কার্তিক মাসে আকাশপ্রদীপ দেবার প্রথারও ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।
এছাড়াও আছে নরকাসুরের কাহিনী। পুরাকালে নরক নামে এক অসুর ছিলেন। তিনি ছিলেন প্রাগজ্যোতিষপুরের রাজা। তার পরাক্রমে দেবতারা অতিষ্ট হয়ে উঠেছিলেন। একসময় তিনি স্বর্গে পৌঁছে যান ও পারিজাত বৃক্ষকে হরণ করেন। এমন কি দেবরাজ ইন্দ্রের মাতা অদিতির কর্ণকুন্ডলও নিয়ে যান তিনি। অসহায় ইন্দ্র তখন দ্বারকায় এসে কৃষ্ণের সাহায্য প্রার্থনা করেন। অগত্যা কৃষ্ণ স্বয়ং নরকবধের উদ্দেশ্যে পত্নী সত্যভামাকে নিয়ে যাত্রা করেন।
আরও পড়ুন: ফাগুন লেগেছে বনে বনে
যুদ্ধ শুরু হয়। কিন্তু প্রবল পরাক্রমী মহারথী কৃষ্ণের পক্ষেও নরককে বধ করা দুরূহ হয়ে পড়ে। এমন কি নরকের অস্ত্রে সাময়িক অজ্ঞানও হয়ে পড়েন কৃষ্ণ। সেই সময় দক্ষতার সঙ্গে যুদ্ধ পরিচালনা করেন সত্যভামা। পরে জ্ঞান ফিরে পেয়ে কৃষ্ণ নরককে বধ করেন। কৃষ্ণের আহত হওয়ার সংবাদ ও পরে জয়ের খবর এসে পৌঁছয় দ্বারকায়। নগরবাসীরা সারারাত প্রদীপ জ্বালিয়ে কৃষ্ণের মঙ্গল কামনায় প্রার্থনা করেন ও বিজয় উদযাপন করেন। সেই থেকে কার্তিক চতুর্দশীকে নরক চতুর্দশীও বলা হয়ে থাকে ও এইদিন প্রদীপ জ্বালিয়ে চারদিক আলোকিত করে রাখার প্রথা চলে আসছে। বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা হিসেবে বলা যায় এইসময় কীটপতঙ্গের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার উদ্দেশ্যে জ্বালানো হয় প্রদীপ। আগুনের মাধ্যমে পোকামাকড়ের হাত থেকে রেহাই মেলে।
কার্তিক মাসের চতুর্দশী তিথি, অর্থাৎ হেমন্ত কাল। শীত আসন্ন। এইসময় বাতাসে হালকা শিরশিরানি ভাব থাকে। হিম পড়ে ভোররাতে। নানারকম রোগের প্রাদুর্ভাবও দেখা যায় স্বাভাবিকভাবেই। তাই ঋতু পরিবর্তনের কারণে শারীরিক সমস্যা এড়াতে আমাদের পূর্বপুরুষরা এই ১৪ শাক খাবার নিয়ম তৈরি করেন বলে মনে করা হয়। চোদ্দ সংখ্যাটি এখানে নেহাতই চতুর্দশীর সঙ্গে সাযুজ্য রাখার জন্যই মনে করা হয়। আসল কারণ হলো শরীরকে সুস্থ রাখা। তাই ভেষজ গুণসম্পন্ন নানান শাকপাতার মাধ্যমে শরীরকে আরও সবল করে তোলাই এই রীতির উদ্দেশ্য। এই ১৪ রকম শাক হলো, ওল, কেঁউ, বেতো, সর্ষে, কালকাসুন্দে, নিম, জয়ন্তী, শাঞ্চে, হিলঞ্চ, পলতা, শৌলফ, গুলঞ্চ, ভাঁটপাতা ও শুষণীশাক। কবিরাজী ও আয়ুর্বেদিক মতে এই সমস্ত শাকের রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা অপরিসীম। তাই চতুর্দশীর ধারণার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হলো ১৪ রকমের শাকভাজা খাবার নিয়ম।
আরও পড়ুন: মন আজ ঈষৎ ভারাক্রান্ত
বর্তমানে ১৪ প্রদীপের ধারণা অনেকের মধ্যে থেকে থাকলেও ১৪টি শাক খাবার যে রীতি তা অনেকেই জানেন না, বা জানলেও কাজের সূত্রে বাংলার বাইরে থাকার কারনে খাওয়া হয়ে ওঠে না। তবে কালীপুজো, লক্ষ্মীর আরাধনা, দীপাবলী উৎসব ও তার সঙ্গে ভূত চতুর্দশীও পালিত হয় বাংলার ঘরে ঘরে, এমনকি বিদেশেও। বাঙালি আজও এই সমস্ত উৎসব ও রীতিনীতির সঙ্গে নাড়ির টান অনুভব করে। তাই আজকের দিনে প্রতি বাড়িতে কোথাও না কোথাও এক চিলতে প্রদীপের আলো দেখা যাবেই। আলোর প্রকাশই তো অন্ধকারকে বিনাশ করে। অমাবস্যা কাটিয়ে আসে ভোর, অশুভ শক্তির পরাজয় ঘটিয়ে জয়ী হয় শুভবুদ্ধি।
Khub chittakorshok lekha. 14 shaak chotobelate kheyechi, kintu naamgulo ei lekha pore prathom janlam
খুব ভাল লাগল।
ভাল লাগলো।
খুব সুন্দর হয়েছে তার কারণ বিষয়বস্তুর গভীরতা। অনেকেরই হয়তো মনে এগুলো নিয়ে প্রশ্ন ছিল যা আজ দূর হল।
Very nice
খুব সুন্দর হয়েছে লেখাটা । আর ও নতুন নতুন লেখা চাই. অনেক অজানা তথ্য জানতে পারবে লোকে।