সম্ভাবনা দেখিয়েও মনে রাখার মতো হলো না

ছবি: বহমান

পরিচালনা: অনুমিতা দাশগুপ্ত

অভিনয়ে: সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, অপর্ণা সেন, ব্রাত্য বসু, অর্পিতা চট্টোপাধ্যায়, সোহাগ সেন

দৈর্ঘ্য: ২ ঘন্টা ২২ মিনিট

RBN রেটিং: ২.৫/৫

ধরুন আপনি গাড়িতে উঠলেন। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে গিয়ার পাল্টে গতি নিতে কিছুটা সময় লাগবেই। কিন্তু সেসব না করে গাড়িতে উঠে বসা মাত্রই যদি সেটা ১০০ কিলোমিটার বেগে দৌড়তে থাকে তাহলে? অনেকটা সেরকমই মনে হলো ‘বহমান’ দেখতে বসে। ছবি শুরু হওয়ার পর প্রথম দু-তিন মিনিট সেলিম (সৌমিত্র) ও মাধুরীকে (অপর্ণা) নিয়ে একটা ভালোলাগা তৈরী হতে না হতেই দৃশ্য পাল্টে দুম করে সুব্রতর (ব্রাত্য) কম্পিউটার স্ক্রিনে এনে ফেলে। দর্শক খেই হারিয়ে ভাবতে থাকেন, সুব্রত কেন মায়ের পিছনে গোয়েন্দাগিরি করছে বা এসব ছবি তাকে কে পাঠাচ্ছে? প্রায় আড়াই ঘন্টা পরেও এর কোনও যুৎসই উত্তর পাওয়া গেল না। 




গুছিয়ে বাজার করে সমস্ত উপকরণ ও মশলাপাতি কিনে এনে রান্না করেও অনেক সময় তা সুস্বাদু হয় না। ঠিক তেমনই হলো এখানেও। তাবড় সব শিল্পী, সংবেদনশীল গল্প, ঝাঁ চকচকে দৃশ্য, চোখকে আরাম দেওয়া কস্টিউম, আর কী চাই একটা সিনেমাকে দর্শনীয় করে তুলতে? প্রয়োজন সঠিক মিশেলের। একটা সুন্দর চিত্রনাট্য আর সঠিক সম্পাদনা এই ছবিকেই অসাধারণ করে তুলতে পারতো। কিন্তু সেসব কিছুই হলো না। ক্লান্তিকর অভিজ্ঞতা ছাড়া তেমন কিছু জুটলো না প্রাপ্তির ঘরে। 

আরও পড়ুন: পাকদণ্ডীর পথে পথে দেওরিয়াতাল

ডাক্তার সুব্রত মুখোপাধ্যায় তার মা মাধুরী ও স্ত্রী জয়ীতার (অর্পিতা) সঙ্গে দক্ষিণ কলকাতায় বসবাস করেন। সুব্রত অত্যন্ত খামখেয়ালি ও মেজাজি। যখন তখন রেগে ওঠে এবং তা বিনা কারণেই। যদিও সুব্রতর বংশপরিচয়ে এরকম উৎকট রাগের উৎস পাওয়া গেল না। মাধুরীর পঞ্চাশ বছরের পুরোনো বন্ধু ও প্রেমিক সেলিম তার জীবনে আবার ফিরে আসায় ক্ষুব্ধ হয় সুব্রত। অথচ সে তখনও জানে না সেলিমের আসল পরিচয়। একজন শিক্ষিতা, আধুনিকা মা তার কোনও পুরুষ বন্ধুর সঙ্গে সময় কাটালে, তার উচ্চশিক্ষিত ছেলে মায়ের পেছনে গোয়েন্দা লাগিয়ে খবর রাখবে, গল্পের খাতিরেও এই ঘটনা অত্যন্ত অযৌক্তিক লেগেছে। উপরন্তু যেখানে দেখানো হলো মাধুরীদের পারিবারিক পরিবেশ খুবই খোলামেলা ও উদারমনস্ক। সেখানে মা, ছেলে ও পুত্রবধূ একই সঙ্গে বসে সিগারেট ও মদ্যপান করেন। করতেই পারেন, সেটাই সুস্থ চিন্তার লক্ষণ, তবে সেক্ষেত্রে সুব্রতর এই মধ্যযুগীয় মানসিকতা ধোপে টেকে না। আর শহুরে আধুনিকতা দেখাতে গিয়ে প্রায় প্রতি দৃশ্যেই ব্ল্যাক কফি ও সিগারেটের প্রাবল্য বেশ বিরক্তিকর লাগে। এছাড়া একজন ডাক্তার হয়ে সুব্রত যদি লোক লাগিয়ে মায়ের ওপর গোয়েন্দাগিরি করতে পারে তাহলে সে সেলিম খানের মতো মানুষকে নিজেই আচমকা গাড়ি চাপা দিয়ে মারতে যাবে কেন? অথচ সামনাসামনি হাসপাতালের দৃশ্য ছাড়া কোথাও সে সেলিমের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেনি। যেখানে পারিবারিক সমস্যা জটিল থেকে জটিলতর হয়ে ওঠে সেখানে কেন একবারও সকলে মুখোমুখি বসে আলোচনা করে না? অথচ মাধুরীদের মতো শিক্ষিত পরিবারে এটাই কাম্য। সকলেই যে যার পরিধিতে ভীষণ চিন্তিত হলেও কেউই সুব্রতকে পরিষ্কারভাবে জিজ্ঞাসা করে না সে এমন অদ্ভুত আচরণ করছে কেন?

আরও পড়ুন: পঁচিশে ‘উনিশে এপ্রিল’

আরও আছে। মাধুরী যখন ফোন করে সেলিমকে ডেকে পাঠায় তার বাড়িতে অশান্তি হচ্ছে বলে, দর্শক মুখিয়ে থাকে পরের দৃশ্যের জন্য। হতাশ করলেন পরিচালক আবারও এক কফি শপের দৃশ্যে মাধুরী আর সেলিমকে দেখিয়ে। কি হতো একবার মাধুরীর বাড়ির উত্তপ্ত পরিবেশে সেলিমকে এনে হাজির করলে? খুব কি বিসদৃশ দেখাতো? বাস্তবে তো এমনটাই হয়ে থাকে। 

জীবনের শেষবেলায় এসে সত্তরোর্ধ মা যখন তার প্রাক্তন প্রেমিকের সঙ্গে সময় কাটাতে চান তখন অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে সুব্রত। যদিও মাধুরী ও সেলিমের সিদ্ধান্তের পাশে থাকে জয়ীতা ও তার মা (সোহাগ)। ছবিতে রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতার প্রসঙ্গ বেশ কয়েকবার উঠে এলো, হয়তো তা ছবির মূল বক্তব্যকে বোঝাতেই। কিন্তু চিত্রনাট্যের দুর্বলতায় সে কথা স্পষ্ট হয় না। সম্পূর্ণ ছবিতেই যথেচ্ছ কাঁচি চালানোর ফলে কোনও দৃশ্যই যেন রেশ রেখে যায় না। মনে হয় যেন টেলিভিশনে প্রাপ্তবয়স্কদের ছবি দেখছি। ছবির ক্লাইম্যাক্সে কোনও নাটকীয়তা না থাকার ফলে গল্পের মোড় পরিবর্তন অনেকেই বুঝবেন না। শেষাংশও এতটাই অস্পষ্ট যে সুব্রতর মনোভাব ও তার পরের পরিণতি সবটাই আন্দাজ করে নিতে হয়।

আরও পড়ুন: যে মৃত্যু আজও রহস্য

অভিনয়ে প্রত্যেকেই নিজের সুনাম রক্ষা করেছেন, যদিও তাদের পরিসর যথেষ্ট কম ছিল। অর্পিতাকে পর্দায় বেশ সুন্দর ও আত্মবিশ্বাসী লেগেছে। ছবির রুচিশীল কস্টিউম মনে রাখার মতো। বলাই বাহুল্য অপর্ণার সাজ ও ব্যক্তিত্ব শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তাঁর ওপর থেকে চোখ সরাতে দেয় না। তাঁর ও অর্পিতার অভিনয় রসায়ন প্রতিটি দৃশ্যেই বেশ পরিণত লাগে। ব্রাত্যর চরিত্রটি একটু অবাস্তব হলেও অভিনয়ে তিনি সেই ভাবকেও ফুটিয়ে তুলেছেন সফলভাবে। তবে গৌতম হালদারের মতো অভিজ্ঞ অভিনেতাকে ওরকম একটা চরিত্রে নেওয়ার কারণ বোঝা গেল না। চরিত্রটি না থাকলেও কিছু এসে যেত না।

সবশেষে তাঁর কথা বলতেই হয়, যাঁর অভিনয় নিয়ে কোনও প্রশংসাই যথেষ্ট নয়। প্রেমিকরূপে সৌমিত্র এখনও ষাটের দশকের মতোই অপ্রতিরোধ্য, যাঁর চোখের দিকে তাকালে প্রেয়সী লজ্জা পেতে বাধ্য। 

পরিশেষে বলা যায় ছবির সম্পাদনা ও চিত্রনাট্য সঠিক হলে তারকাখচিত ‘বহমান’ মনে রাখার মতো একটা ছবি হতে পারতো।

Amazon Obhijaan



Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Swati

Editor of a popular Bengali web-magazine. Writer, travel freak, nature addict, music lover, foody, crazy about hill stations and a dancer by passion. Burns the midnight oil to pen her prose. Also a poetry enthusiast.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *