কবিতা আঁকলেন ইন্দ্রদীপ
ছবি: বিসমিল্লাহ
পরিচালনা: ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্ত
অভিনয়ে: কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়, ঋদ্ধি সেন, শুভশ্রী গঙ্গোপাধ্যায়, সুরাঙ্গনা বন্দ্যোপাধ্যায়, গৌরব চক্রবর্তী, বিদিপ্তা চক্রবর্তী, অপরাজিতা আঢ্য, স্নেহা চট্টোপাধ্যায়, সার্থক দাস, অগ্নিজিৎ সেন
দৈর্ঘ্য: ২ ঘণ্টা ৩৭ মিনিট
RBN রেটিং: ৪/৫
আদিগন্ত বিস্তৃত বনভূমি. যতদূরে চোখ যায় আকাশ ছুঁয়েছে মাটি, নদী বয়ে গেছে দৃষ্টিপথের এপার থেকে ওপারে। নৌকায় পারাপার করতে গেলে নদীতে পড়ে পাহাড়ের কালো ছায়া। স্বপ্নের মতো চোখজুড়ানো প্রান্তরের কোনও এক কোণে রশিদ আলির (কৌশিক) বাস। পেশায় সানাইবাদক, মেহতাব আলির ঘরানাকে সগর্বে বহন করে চলেন রশিদ। দুই পক্ষের স্ত্রী শাকিলা (বিদিপ্তা) ও সাফিনা (স্নেহা) ছাড়াও তিন ছেলে ফুয়াদ (অগ্নি), বিসমিল্লাহ (ঋদ্ধি) ও একরামকে (সার্থক) নিয়ে তার সংসার। বড় ছেলে হামিদ কলকাতায় চাকরি করতে গিয়ে সেখানেই থেকে গেছে।
রশিদের জীবনে তার প্রিয়তম সানাই আর বহু কষ্টে বাঁচিয়ে রাখা মূল্যবোধ, এই দুটিই সম্বল। হাজার অসুস্থতা ও অভাব সত্বেও এই দুই সম্পত্তিকে সে সন্তানের মতো আগলে রাখে। বড় ছেলের ফেরার আশা নেই, পারিবারিক ঐতিহ্যকে সে মনে রাখেনি। মেজ ফুয়াদ বিশেষভাবে সক্ষম। দ্বিতীয় পক্ষের ছোট ছেলেকে বাদ দিলে একমাত্র বিসমিল্লাহ (ঋদ্ধি) সংসারের দায়িত্ব নেওয়ার উপযুক্ত। কিন্তু সে বিভোর হয়ে থাকে তার বাঁশির সুরে। কখনও গ্রামের রাস উৎসবে গান শুনে, কখনও বা বৈরাগী বন্ধুর সঙ্গে মাঠেঘাটে ঘুরে বেড়িয়ে আনমনা বিশু কী যেন খুঁজে বেড়ায়। কাকে খোঁজে সে? অভাবের তাড়নায় একসময় বাবার কাছে নাড়া বেঁধে সানাইয়ের তালিম নিতে বাধ্য হয় বিশু। আত্মসম্মান বোধ যে তারও কিছু কম নয়। তবু দুই বাদ্যযন্ত্রের ভেতরের সুরের টানাপোড়েনে বিশু হারিয়ে ফেলে লীলাকে।
আরও পড়ুন: শেষের সেদিন, উপস্থিত ছিলেন শুধু মহেশ ও ড্যানি
এক মৃতপ্রায় শিল্পকে জল হাওয়া দিয়ে বাঁচিয়ে তোলার অদম্য ইচ্ছেতে রশিদ ছেলেকে বলে, ‘এমন সানাই বাজ়াও, সকলে অবাক হইয়া শুনব তোমার বাজ়না।’ রশিদের যোগ্য ছাত্র শিবু (গৌরব) সানাই ছেড়ে এখন ডিজে বক্সের ব্যবসা শুরু করে লাভের মুখ দেখেছে। বিশুকে টাকার লোভ দেখিয়ে দলে টানতে চায় সে। কিন্তু একটা সময় বাবার মন্ত্রকে পাথেয় করে বিসমিল্লাহ হয়ে ওঠে তার সময়ের যোগ্যতম সানাইশিল্পী। তবু কিসের যেন ডাক বিসমিল্লাহকে থেকে থেকেই বিবশ করে দেয়। কোন জন্মের ওপার থেকে যেন রাধার আহ্বান শুনতে পায় সে। সেই কি ফাতিমা? তার স্বপ্নে ফাতিমা আর লীলা একাকার হয়ে যায় কেন? কেন উমাকে দেখে চমকে ওঠে বিসমিল্লাহ?
এমন অজস্র প্রশ্নের পরিষ্কার কোনও উত্তর নেই ছবিতে। নেই বলেই ‘বিসমিল্লাহ’ শুধু ছবি নয়, এক চলমান কবিতা হয়ে গিয়েছে। সুরে, ছন্দে, ভাবে যে কবিতার কোনও শেষ পংক্তি নেই। সে বয়ে চলে নদীর জলের মতো, বাধা পেলে নিজের পথ বদলে নেয়। তবু চলা থামায় না। ইন্দ্রদীপ তাঁর দ্বিতীয় ছবিতে এমন এক অসামান্য ন্যারেটিভ সৃষ্টি করলেন যার থেকে চোখ ফেরানো যায় না। এত সহজ সরল গ্রাম্যজীবনের মন ছুঁয়ে যাওয়া গল্প বহুদিন উঠে আসেনি বাংলা ছবিতে। সুরের মূর্ছনায় ছবির শুরু থেকে শেষ দর্শককে আবিষ্ট করে রাখে ‘বিসমিল্লাহ’র গভীরতা।
আরও পড়ুন: বেহিসেবী জীবনযাপন, আজ স্মৃতির অতলে সৌমিত্র
প্রথমার্ধ জুড়ে শুধুই ঐতিহ্যের হারিয়ে যাওয়ার গল্প। পারিবারিক সংস্কার থেকে শুরু করে চিরাচরিত প্রথা, অভ্যাস, দিন, মানুষের রুচি সবই যেন যেতে বসেছে। আজকাল আর চিঠি আসে না। পোস্ট অফিসটাও উঠে যায় একদিন। চিরকালের অভ্যেসে একটা চিঠির আশায় পোস্ট অফিসে প্রায়ই ঘুরে আসা রশিদ বড় আঘাত পায়। সময় পাল্টে যাচ্ছে দ্রুত। তার এত যুগের কষ্টার্জিত শিক্ষা, সংস্কার সব যেন যুগের হাওয়ায় টালমাটাল।
‘বিসমিল্লাহ’ যেন এক স্বপ্নের রূপকথা। এই রূপকথার অনেকটাই যেন প্রত্যাশিত ছিল, তবু সবটাই বড় মায়া জড়ানো। বাস্তব শুধু বিসমিল্লাহর ভালোবাসা। কথায় বলে, প্রকৃত শিল্পী জাগতিক জীবনে সুখী হন না। সেই একই না পাওয়া থেকে যায় বিসমিল্লাহর জীবনেও। তাই সব পেয়েও সে যেন কী এক অমূল্য রতন হারিয়ে ফেলে।
আরও পড়ুন: সব কান্নার শব্দ হয় না, বেজে উঠল পটদীপ
কাহিনী, দৃশ্যকল্প, সঙ্গীত ও পরিচালনা, এই চারটি বিভাগের দায়িত্ব পালন করেছেন ইন্দ্রদীপ একাই। এ কথা জোর দিয়ে বলা যায় ‘বিসমিল্লাহ’র জন্য এর চেয়ে ভালো কিছু হতে পারতো না। ইন্দ্রদীপ ছবিটি উৎসর্গ করেছেন ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সঙ্গে জড়িত সমস্ত শিল্পীর উদ্দেশ্যে। তবে শুধু সঙ্গীত নয়, ছবির ভাষার দিক দিয়েও ‘বিসমিল্লাহ’ বাংলা সিনেমাকে এক নতুন দিশা দেখাতে পারে। চরিত্রের বুনন থেকে চিত্রগ্রহণ, কাহিনীবিন্যাস থেকে সম্পাদনা, সমস্ত বিভাগে মুগ্ধ করে এই ছবি।
সানাইয়ের মাধুর্য ও বাঁশির মিষ্টতাকে বাদ দিলেও এ ছবির প্রতিটি গান মনে রাখার মতো। অরিজিৎ সিংয়ের গাওয়া ‘আজকে রাতে চলে যেও না’ এবং শ্রেয়া ঘোষাল ও সৌম্যদীপ মুর্শিদাবাদির গাওয়া ‘কেন যে তোমাকে দেখি’ গান দুটি দীর্ঘক্ষণ রেশ রেখে যায়। ঘড়ির কাঁটা রাত দশটার ঘর পেরোলেও দর্শকের উঠে যাওয়ার তাড়া দেখা যায় না।
আরও পড়ুন: বাইপোলার ডিসঅর্ডার থেকে চরম অবসাদ, হোমসে ‘ডুবে’ গিয়েছিলেন জেরেমি
বহুদিন পর বাংলা ছবিতে অভিনয়ের প্রতিযোগিতা দেখা গেল। প্রতিটি চরিত্র যেন ছুঁয়ে দেখা যায়। ঋদ্ধির কথা আলাদাভাবে বলতেই হয়। ভালো অভিনেতা তিনি বরাবরই, কিন্তু তেমন চরিত্র না পেলে সৃষ্টিশীলতায় শান দেওয়ার সুযোগ বড় একটা পাওয়া যায় না। ‘নগরকীর্তন’-এর পর আবারও ঋদ্ধিকে জ্বলে উঠতে দেখা গেল। সানাইবাদক ও বংশীবাদক রূপে তো বটেই, এই ছবিতে সফল নৃত্যশিল্পী হিসেবেও নিজেকে প্রমাণ করলেন তিনি।
অনবদ্য কৌশিক। আন্ডারঅ্যাক্টিংয়ে চিরকালই তুখোড় তিনি। রশিদের চরিত্রটি সম্ভবত তাঁর কথা ভেবেই লেখা। স্নেহাকে সাফিনার চরিত্রে ভারী ভালো লাগে। বিদিপ্তা তাঁর মতোই সাবলীল। অপরাজিতাও অন্য ধরণের চরিত্রে অসম্ভব বিশ্বাসযোগ্য। ভালো লাগে অগ্নির অভিনয়। উমার চরিত্রে সুরাঙ্গনার দৃষ্টি মনে রাখার মতো। ফাতিমার চরিত্রে শুভশ্রীকে দেখতে যেমন সুন্দর লেগেছে, তেমনই পর্দায় আরও একবার নতুনভাবে নিজেকে চিনিয়েছেন তিনি। এই শুভশ্রীকে বাঙালি দর্শক আগে দেখেনি।
এবং গৌরব। শিবুর মতো আগাগোড়া ধূসর একটি চরিত্র যে ডিজে বক্সের তালে সিটি মারে, গলার চেন মুখে নিয়ে চিবোয়, শুধু দৃষ্টি দিয়ে কারও অন্তরের সমস্তটা দেখে নিতে পারে, এমন একটি ভূমিকায় অভিনয় করা মুখের কথা ছিল না। এর আগে তাঁকে নেগেটিভ চরিত্রে বিশেষ দেখা যায়নি। যেটুকু করেছেন তাও খুব স্বাভাবিক শহুরে চরিত্র। শিবুরূপী গৌরব চমকে দিলেন। ভালো চরিত্র ও উপযুক্ত পরিচালক পেলে দক্ষ অভিনেতা কী করতে পারেন, তা দেখিয়ে দিলেন তিনি।
আড়াই ঘণ্টা ধরে পর্দায় কবিতা আঁকলেন ইন্দ্রদীপ। তাঁকে যোগ্য সঙ্গত করলেন একদল ‘ক্ষুধার্ত’ অভিনেতা ও শুভঙ্কর ভড়ের ক্যামেরা। মনে রেখে দেওয়ার মতো ছবি ‘বিসমিল্লাহ’। না, ভুল। এ ছবি মনে রয়ে যাবে নিজগুণেই।