ভারতীয় সহনশীলতাকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় ‘পরিক্রমা’
ছবি: পরিক্রমা
পরিচালনা: গৌতম ঘোষ
অভিনয়ে: মার্কো লিওনার্দি, চিত্রাঙ্গদা সিং, আরিয়ান বড়কুল, ইমানুয়েল এসপোসিটো, গৌতম সরকার
দৈর্ঘ্য: ১ ঘণ্টা ৫৮ মিনিট
RBN রেটিং ★★★★★★★★☆☆
সর্দার সরোবর ড্যাম। নর্মদা নদীর ওপর কংক্রিটের দম্ভ স্বরূপ দাঁড়িয়ে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম নদী বাঁধ, প্রগতিশীল ভারতবর্ষের মুখ উজ্জ্বল করছে। তৃতীয় বিশ্ব হতে পারি, কিন্তু আমরা সদা উন্নয়নশীল। নদীমাতৃক দেশ আমাদের, নদীকে আমরা দেবী বলি। মা বলে ডাকি। গঙ্গা, যমুনা, নর্মদা, সরস্বতী, কাবেরী, গোদাবরী প্রত্যেকটি নদী হিন্দু ধর্মে এক একজন দেবীর রূপ। সেই মতো আদর আপ্যায়ন পুজো পরিক্রমা সবই হয়ে থাকে এ দেশে। প্রকৃতিকে ঈশ্বরের জায়গায় বসিয়ে মাথায় স্থান দেওয়ার রীতি সম্ভবত ভারতেই সবচেয়ে প্রথম শুরু হয়েছিল। কিন্তু আমরা যাকে ভক্তি করি তাকে সত্যি ভালোবাসি কি? তার স্বাস্থ্য বা শ্রীবৃদ্ধির চিন্তা করি কি? কিছুদিন আগে দিল্লিতে যমুনা নদীর দূষণ মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। সেই সময় লন্ডনের টেমস নদীর সঙ্গে যমুনার একটি ছবি ইন্টারনেটে ভাইরাল হয়। বক্তব্য ছিল বিদেশীরা নদীকে নদী বলেই জানে, তাই সেখানে নদীর রূপ স্বাভাবিক। আর ভারতীয়রা নদীকে দেবীরূপে পূজা করে, তাই সেখানে নদীর এই করুণ হাল।
গৌতম ঘোষের (Goutam Ghose) ‘পরিক্রমা’(Parikrama) প্রাথমিকভাবে নর্মদা পরিক্রমার কাহিনি মনে হলেও আদতে এর মূল কথা অনেক গভীরে। ছবির গল্প ইতালিয়ান সাহেব আলেসান্দ্রো (মার্কো), ভারতীয় লেখিকা রূপা (চিত্রাঙ্গদা) ও মধ্যপ্রদেশের এক ডুবে যাওয়া গ্রামের ছোট্ট ছেলে লালাকে (আরিয়ান) নিয়ে। সুদূর ইতালি থেকে আলেসান্দ্রো বা অ্যালেক্স ভারতে আসে নর্মদা নিয়ে তথ্যচিত্র তৈরির কাজে। প্রতি বছর অজস্র হিন্দু ভক্তের নর্মদা পরিক্রমা নিয়ে লেখা রূপার বই পড়ে তার মনে হয়েছে ভারতীয়দের এই পবিত্র জার্নিকে ক্যামেরাবন্দি করা প্রয়োজন। সদ্য মা হারা নিজের একমাত্র ছেলেকে দেশে তার ঠাকুমার জিম্মায় রেখে অ্যালেক্স চলে আসে বৃহত্তর উদ্দেশ্য নিয়ে। কিন্তু তথ্যচিত্র তৈরির লোকেশন খুঁজতে গিয়ে হঠাৎই আলাপ হয়ে যায় একটি স্থানীয় ছেলের সঙ্গে। এগারো-বারো বছরের একটি ছেলে যে মাঈ কি বাগিয়া এলাকায় স্থানীয় ভেষজ ইত্যাদি ফেরি করে বেড়ায়, নাম লালা। তার বাড়ি, গ্রাম সমস্ত কিছুই নর্মদার গ্রাসে ডুবে গেছে। লালাকে নিয়ে নতুনভাবে অন্য এক জার্নি শুরু করে অ্যালেক্স।
আরও পড়ুন: মশলা, অ্যাকশন, সংলাপে পারফেক্ট কমার্শিয়াল ককটেল
ভারতের প্রাচীনতম নদীগুলির মধ্যে অন্যতম নর্মদা, যাকে অগণিত ভক্ত নর্মদা মাঈ নামে জানে। নর্মদা পরিক্রমা নিয়ে বাংলায় সবচেয়ে প্রামাণ্য বই সম্ভবত শৈলেন্দ্র নারায়ন ঘোষাল শাস্ত্রীর লেখা ‘তপোভূমি নর্মদা ‘। সেই বইতেও নর্মদা মাতার মাহাত্ম্য বর্ণনার সঙ্গেই বিরোধিতা করা হয়েছে নর্মদার ওপর বাঁধ নির্মাণ করার। ছোটবড় প্রায় তিরিশটি বাঁধ দিয়ে নর্মদার জলকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়ে আসছে। মেধা পাটেকরের ‘নর্মদা বাঁচাও আন্দোলন’ সারা দেশে তো বটেই, বিদেশেও সাড়া ফেলেছিল। কিন্তু বাঁধ নির্মাণ আটকানো যায়নি। দ্বিতীয় কোনও কম ক্ষতিকর বিকল্পও গ্রহণ করা হয়নি। ফলে দীর্ঘ সময় জুড়ে গৃহহারা হয়েছে লালার মতো অজস্র ছোট-ছোট ছেলেমেয়েরা। পুনর্বাসন হয়তো তাদের নতুন ঘর দিয়েছে, কিন্তু কেড়ে নিয়েছে তাদের জমি, জীবিকা, হয়তো বা অস্তিত্বও।
যে নর্মদা মাতা একদিকে ঈশ্বর স্বরূপ, তার বাঁধের কারণেই আজ অস্তিত্বের সংকটে ভুগছে স্থানীয় কৃষক ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষ। জলপথে ওঙ্কারেশ্বর বাঁধের সামনে দাঁড়িয়ে অ্যালেক্সের রাগ নিশ্চয়ই পরিচালকেরও রাগের কারণ। ভারতীয়দের সহনশীলতাকে কটাক্ষ করে সে, তীরের মতো এসে গায়ে লাগে তার মন্তব্য। কিন্তু সত্যিই তো আমরা যুগ-যুগ ধরে এমন অনেককিছুই মেনে নিয়েছি। নর্মদার জলে ডুবুরি নামিয়ে ডুবে যাওয়া গ্রামের দৃশ্যের সঙ্গে অ্যালেক্সের আটলান্টিসের সঙ্গে তুলনা যেন সপাটে চাবুক মেরে যায়। নিজের গ্রাম নিজের ঘরের প্রতি লালার টান কোথাও যেন গিয়ে মিশে যায় অ্যালেক্সের ছেলে ফ্রান্সেসকোর প্রয়াতা মায়ের স্মৃতির সঙ্গেও। নিজের দেশ, নিজের সংস্কৃতির প্রতি তো অ্যালেক্স নিজেও দুর্বল। মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তিই তো তাই। তবু একদল ক্ষমতাবান মানুষের জন্য আর একদল অসহায় মানুষকে ঘরছাড়া হতে হয়। বিচিত্র এই আয়রনি! তবু সরকারি শক্তির কাছে, তথাকথিত ‘দেশের উন্নতি’র কাছে বারবার বলি হতে হয় দারিদ্রকে।
ঈশান ঘোষের চিত্রগ্রহণ বড় অনায়াসে এ ছবির চরিত্র হয়ে উঠেছে। নীলাদ্রি রায়ের সম্পাদনা, অনির্বাণ সেনগুপ্তর শব্দ সৃজন যথাযথ। গৌতমের আর এক বিখ্যাত ছবি ‘পদ্মানদীর মাঝি’তে নদী নিজেই এক চরিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সেখানেও নদীর ভাঙন ছিল ছবির মূল প্রতিপাদ্য। আবার ‘পরিক্রমা’তেও সেই নদীই চরিত্র। যদিও এখানে নদীর মূল শত্রু মানুষ।
আরও পড়ুন: রোহনের ছবিতে আবারও জুটিতে সুরাঙ্গনা-সত্যম
অভিনয়ে সকলেই একেবারে বাস্তব থেকে উঠে আসা চরিত্র। যেমন অ্যালেক্স চরিত্রে মার্কো, তেমনই রূপার চরিত্রে চিত্রাঙ্গদা। খুব সাধারণ সাজে বরাবরের মতোই অনন্যা হয়ে উঠেছেন তিনি। তবে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি মনে থেকে যাবে আরিয়ানের চোখের দৃষ্টি এবং তার অভিনয়। এছাড়াও গৌতম সরকার অভিনীত বিজয় চরিত্রটি সংযত এবং ভালো লাগার মতোই। লালার বাবা মায়ের চরিত্রে উর্মি শর্মা ও অস্মিত কুন্দরকে অভিনেতা বলেই মনে হয় না যেন। স্বল্প পরিসরে অরিজিৎ দত্তের উপস্থিতি ‘ডুবগাঁও’ শব্দটিকে আলাদা মাত্রা দিয়েছে।
সারাবছর ধরে অজস্র ছবি আসে যায়। বিনোদনমূলক ছবি মানুষকে আনন্দ দেয় ঠিকই কিন্তু ‘পরিক্রমা’র মতো সমাজ সচেতনতামূলক বাস্তবধর্মী ছবিরও প্রয়োজন রয়েছে। সহজ ভাষায় বলা গল্প, মনে রাখার মতো সিনেমাটোগ্রাফি, লালার করুণ কাহিনি অন্তত নিজের দেশ, নিজের পারিপার্শ্বিককে জানার জন্যই চাক্ষুষ করা অবশ্য প্রয়োজন।
