রসবোধ গোল্লায়, হাতে শুধু রসগোল্লা

গতকাল ‘ভবিষ্যতের ভূত’ ছবিটি মুক্তির দাবীতে মিছিল শেষের জমায়েতে বরুণ চন্দ একটা গল্প বললেন, “জওহরলাল নেহরু তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। সেই সময় তাঁকে নিয়ে প্রতিদিন খবরের কাগজে কার্টুন বেরত। সেই সব ছবি আঁকতেন বিখ্যাত শিল্পী আর কে লক্ষণ। নেহরু সেসব পড়তেন রোজই। একদিন সকালবেলা কাগজ খুলে তাঁকে নিয়ে আঁকা কোনও কার্টুন দেখতে পেলেন না নেহরু। সঙ্গে সঙ্গে ফোন ঘুরিয়ে তিনি নিজেই লক্ষণকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি ব্যাপার? আমাকে নিয়ে আজ কোনও কার্টুন নেই কেন? আমি কি তাহলে কিছুই করিনি?’”

লক্ষণ উত্তরে কি বলেছিলেন, সেটা বরুণবাবু জানাননি। বা হয়ত তাঁর জানা নেই। তাঁর গল্পটা কোনও রাজনৈতিক দলের পক্ষ বা বিপক্ষ থেকে করা নয়। আর সেটা প্রাসঙ্গিকও নয়। যেটা প্রাসঙ্গিক এবং যা প্রবীণ এই অভিনেতা বোঝাতে চেয়েছেন, তা হল বর্তমান রাজনৈতিক নেতৃত্বের রসবোধের চূড়ান্ত অভাব।

রাজনৈতিক কার্টুন আঁকা আজ এক লুপ্ত শিল্প। আমাদের ছোটবেলায়, আশির দশকেও প্রায় প্রতিটা বাড়ির দেওয়ালে, মাঠের পাঁচিলে, রকের ওপর আঁকা থাকত সেই সব মজার ছবি আর সঙ্গে জম্পেস সব সংলাপ। কাউকেই রেয়াত করা হত না সেই সময়ে। ডান-বাম সবাই একে অপরকে নিয়ে লিখত। দৃশ্যদূষণের ব্যাপারটা বাদ দিলে সাধারণ মানুষ কিন্তু মজাই পেত এগুলো দেখে।

তিন মূর্তি ও পায়ের তলায় সরষে

কিন্তু আজ যখন সারা পৃথিবী শিল্প, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি সবদিকেই কয়েকধাপ ওপরে উঠে এসেছে, তখন এদেশে মানুষের ভাবপ্রকাশের একটার পর একটা মাধ্যম বিপন্ন। রাজনৈতিক কার্টুন লক্ষণের common man-এর বৈশিষ্ট্য ছিল, যা পরে এক নামকরা মাখন প্রস্তুতকারী সংস্থার বিজ্ঞাপনেরও মূল সুর হয়ে ওঠে। সেই একই সুর আমাদের রোজের চেনা সমাজেও পাওয়া যেত। আমরা জানতাম হাসির কথায় হাসাটা আমাদের মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়ে।

কিন্তু দিন দিন এই চারপাশের সমাজটাই একটু একটু করে অচেনা হয়ে যেতে লাগল। এই ট্রেন্ডের সূচনা কয়েক দশক আগে। সর্বত্র একটা চিন্তাধারার মৌলবাদ শুরু হল। আমি কি দেখব, কি বলব, কি জানব সবটাই রাষ্ট্র বা স্থানীয় সমাজের মাথারা ঠিক করে দেবেন। মানে সেই হীরক রাজার দেশের মডেল। গান গাওয়া বন্ধ করার জন্য যেখানে চরণদাসের মুখ বেঁধে রাখা হয়েছিল। এ রাজ্যে কার্টুন আঁকার জন্য সে যুগে চাকরি গেছে, এ যুগে জেল হয়। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে যুদ্ধ চাই না বললেও ক্ষিপ্ত জনতার হাতে হেনস্থা হতে হয়। এটাই বর্তমান সময়। মৌলবাদ কি শুধুই তালিবানীদের একচেটিয়া সম্পত্তি নাকি?

তাশি গাঁওয়ে একদিন

আমরাও পারি মৌলবাদী হতে। আমরাও পারি মুখ বন্ধ করাতে। শুনেছি সত্যজিৎ রায়ের ‘জন অরণ্য’ ছবিটিও নাকি উত্তর কলকাতায় চলতে দেওয়া হয়নি। তাতে কি এসে গেল? দেশে বিদেশে আজও এই ছবিকে নিয়ে আলোচনা হয়। এখনও বাংলা কাল্ট ছবির তালিকায় জন অরণ্যের নাম ওপরদিকে রয়েছে আর থাকবে।

বছরখানেক আগের ঘটনাই ধরা যাক। হিন্দী ছবি পদ্মাবতী (পরে পদ্মাবত) কে আটকে দেওয়া হল। তার নাম বদল থেকে শুরু করে বেশ কিছু দৃশ্যও পাল্টাতে বাধ্য করা হল। নায়িকাকে নিয়ে নোংরা উক্তি করা, প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া, পরিচালককে আক্রমণ, কিছুই বাদ গেল না।  দেশের সরকার সব দেখেও চুপ। বিধর্মীর আঘাতে ধর্ম কলুষিত হচ্ছে এমনটা ইতিহাসে ঘটে থাকতে পারে, কিন্তু ছবির পর্দায় দেখানো নৈব নৈব চ। পারলে তারা খিলজির ধর্মটাও পাল্টে ফেলতেন। নিজের সময়ে দাঁড়িয়ে চারপাশে এত অনাচার অবিচার যাদের চোখে পড়ে না, তারা এক ঐতিহাসিক রাণীর সম্ভ্রম রক্ষা করতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন, যেখানে ইতিহাসটাও স্পষ্ট নয়। সেই সময় আমরা কি করছিলাম? না জোর গলায় বলছিলাম, ‘অশিক্ষিত লোকজনেরা বেকার ফুটেজ খাবার জন্য এসব করছে।’ দুদিন আগেও জানতাম না করণী সেনা বলে কিছু আছে। ‘আমাদের রাজ্যে অন্তত এই লেভেলের অসভ্যতামোগুলো নেই। শিল্প সংস্কৃতি নিয়ে একটা শিক্ষিত পরিমন্ডল আছে,’ আমি নিজেই বলেছি কত লোককে। ফেসবুকে কত মানুষ লিখলেন, বড় বড় কবি সাহিত্যিকরাও এই নিয়ে সরব হয়েছিলেন তখন।




আর আজ? আমাদের এই চেনা শহরে একটা ছবিকে চলতে দেওয়া হল না। হ্যাঁ মানছি, সেই ছবি স্যাটায়ারধর্মী। যেটুকু খবর পেয়ছি, বেশকিছু তীর্যক সংলাপও আছে তাতে। কিন্তু সে তো শিল্পের অঙ্গ। সাহিত্য সিনেমারও অঙ্গ। নতুন কিছু তো নয়। অনীক প্রথম পরিচালক যিনি এমন ছবি করলেন তাও নয়। ‘জানে ভি দো ইয়ারো’র মত কালজয়ী ছবি হয়েছে সমকালীন রাজনৈতিক পটভূমিকাকে কেন্দ্র করে। আর অজস্র নাটকের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম।

যে চরম অবিবেচনাবশত ‘পশুখামার’কে আটকে দেওয়া হয়েছিল, সেই একই কাজ করা হল ভবিষ্যতের ভূতকে নিয়েও। মানুষ পশুখামার দেখেননি? যারা দেখতে চেয়েছেন তারা ঠিকই দেখেছেন। এটাও দেখবেন। এভাবে তো আটকাতে পারবে না কেউ। আটকানো যায় না। একটা সমাজের মুখপাত্র হল তার শিল্প, তার সাহিত্য, তার সংস্কৃতি। তার নিজস্ব ভাষা থাকবে না? নিজের বক্তব্য থাকবে না? নাকি সে শুধু ঝকঝকে রোমান্টিসিজ়মের গল্প, টান টান থ্রিলার আর পুরোন ছবির রিমেক বানিয়ে যাবে? ব্যাঙ্গ বা সারকাজ়ম একটা শিক্ষিত সমাজের অপরিহার্য ভাবপ্রকাশের মাধ্যম। সেটাকে গলা টিপে মারতে চাইলে সমাজটাও যে মরে যাবে এ কথা কি বাঙালি বুঝতে পারছে না? বাঙালির একমাত্র গর্বের বস্তু বলতে তো ওটাই। তার শিক্ষা, তার ইন্টেলেক্ট, তার শিল্পবোধ। এইগুলো বাদ দিলে বাঙালির আর থাকলটা কি? শুধুই নস্টালজিয়া আর রসগোল্লা? দ্বিতীয়টাও তো প্রায় হাতছাড়া হতে বসেছিল। রসিকতাটুকু বাঙালির নিজস্ব শিক্ষাদীক্ষার অঙ্গ ছিল, সেটাও আর থাকল না। সোহাগ সেন যেটা বার বার বললেন, “বাঙালির সেন্স অফ হিউমারটাই নষ্ট হয়ে গেছে।” এ বড়  কঠিন সময়।

শব্দ যখন ছবি আঁকে

প্রবীণ রাজনৈতিক নেতা আজিজুল হকের কথায়, “একটা মানুষকে উলঙ্গ করে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দিলে তার যেমন মনে হবে, আজকেও ঠিক সেটাই হচ্ছে। এই কারণেই ছবিটাকে আটকানো হয়েছে। এইভাবে ছবি আটকে দিলে এরপর এই পরিচালকের সঙ্গে আর কোনও প্রযোজক কাজ করতে চাইবেন না। অর্থাৎ এইভাবে ওরা পরিচালককে ভাতে মারতে চাইছে।”

প্রকৃত শিক্ষিত মানুষের জন্য এ দেশের রাজনীতিতে কোনও জায়গা নেই, এ কথা বার বার প্রমাণিত হয়েছে বিভিন্ন সরকারের জমানায়। কিন্তু বিবেচনাবোধ তো শুধু শিক্ষার পরিচয় দেয় না, অভিজ্ঞতারও পরিচয় দেয়। এতদিনের অভিজ্ঞতায় সংশ্লিষ্ট মহলের এটুকু বোঝা উচিত ছিল যে নেগেটিভ পাবলিসিটি কিন্তু জনগণের ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করে। যে পরিমাণ নেগেটিভ পাবলিসিটি ভূতেরা পেল তাতে আজ যদি ছবিটি কোনও অনলাইন স্ট্রিমিং সাইটে দিয়ে দেওয়া হয় তবে তা হট কচৌরির মতই ব্যবসা করবে।

আমার মুক্তি আলোয় আলোয়

অর্থাৎ ব্যবসাটা মূল কথা নয়। সেটা অনীক এভাবেও করতে পারতেন। করছেন না, কারণ এভাবে শিল্পের কন্ঠরোধের বিরুদ্ধে তিনি প্রতিবাদ করতে চান। সাধারণ মানুষের একটা বড় অংশ তাঁর পাশে। নিজের আগ্রহেই কাল মিছিলে যোগ দিয়েছিলাম। মিডিয়ার অংশ হিসেবে নয়। কলকাতা শহরের ইতিহাসে একটা ছবি মুক্তির দাবীতে এইভাবে তারকা ও সাধারণ মানুষকে একসঙ্গে পথে নামতে দেখিনি কোনওদিন। অরাজনৈতিক কোনও দাবীতে মানুষের এই স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস হত না।

তবে এখনও সময় আছে। মজাটাকে মজা হিসেবে নিয়ে এখনও যদি ছবিটাকে প্রেক্ষাগৃহে ফিরিয়ে আনা যায় তাহলে নিজেদের সন্মানটাও বাঁচে আবার জনগণের কাছে হৃত গৌরবেও হয়ত খানিকটা মলম লাগানো যায়। মানুষ তো গরু-গাধা নয়। ফতোয়া দিয়ে তাদের কতদিন আটকে রাখা যাবে? একটু প্রাপ্তমনস্কতা দেখালে বাঙালির নিজস্বতার অহংকারকে হয়ত এখনও চাঙ্গা করা সম্ভব। নাহলে ভবিষ্যতে আবার কোন সংস্কৃতির ভূত মাথা চাড়া দেবে কে বলতে পারে।

তখন সবাইকে দাবিয়ে রাখা যাবে তো?

ছবি: প্রতিবেদক

Amazon Obhijaan



Like
Like Love Haha Wow Sad Angry
21

Swati

Editor of a popular Bengali web-magazine. Writer, travel freak, nature addict, music lover, foody, crazy about hill stations and a dancer by passion. Burns the midnight oil to pen her prose. Also a poetry enthusiast.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *