ঘরে ফেরার টানেই লুকিয়ে অপুর বাউন্ডুলে রোমান্টিসিজ়ম
ছবি: অভিযাত্রিক
পরিচালনা: শুভ্রজিৎ মিত্র
অভিনয়ে: অর্জুন চক্রবর্তী, আয়ুষ্মান মুখোপাধ্যায়, সব্যসাচী চক্রবর্তী, অর্পিতা চট্টোপাধ্যায়, শ্রীলেখা মিত্র, দিতিপ্রিয়া রায়, সোহাগ সেন, বরুণ চন্দ, তনুশ্রী শংকর, বিশ্বনাথ বসু
দৈর্ঘ্য: ২ ঘন্টা ১৯ মিনিট
RBN রেটিং: ৩.৫/৫
বাংলা সাহিত্যের কিছু অমর চরিত্র আছে। বাঙালি যতই আধুনিক হোক, যতই সে সপ্তাহান্তে পার্টি করুক, জিন্স-টপ-শর্টস ছাড়া আর কোনও পোশাকে অভ্যস্ত না হোক, যতই সে বিদেশে বেড়াতে ভালোবাসুক, তবু এই চরিত্রগুলো তাদের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে মিশে থাকে। এমনকি উত্তর-আধুনিক বাঙালিও শৈশবের সেই প্রিয় চরিত্রগুলোকে একই চেহারায়, একই রূপে ফিরে পেতে চায় বারবার। যেমন শ্রীকান্ত, যেমন অমিত-লাবণ্য, যেমন অমল, কুন্দনন্দিনী কিংবা রাধারানী। তেমনই একজন অপূর্ব রায়। বাঙালি পাঠক ও দর্শকের বড় কাছের চরিত্র অপু। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর সৃষ্ট এই চরিত্রের মাধ্যমে বাংলার মেঠো আলপথের ধারে বেড়ে ওঠা সহজ সরল গ্রাম্য জীবনকে পরম আদরে ছুঁয়ে গেছেন। আবার একই সঙ্গে তিনি সেই ঘোরতর বাউন্ডুলে জীবনের হাতছানিকেও সম্পূর্ণরূপে প্রশ্রয় দিয়ে গেছেন, যার স্বপ্ন বাঙালি আজন্ম লালন করে তার ব্যস্ত কেজো জীবনে। সেই নাগরিক বাউন্ডুলে অপুর পূর্ণবয়স্ক রূপই শুভ্রজিৎ এঁকেছেন তাঁর ‘অভিযাত্রিক’ ছবিতে।
সত্যজিৎ রায় তাঁর অপু ট্রিলজি শেষ করেছিলেন অপুর ফিরে আসা দিয়ে। যেন যাযাবর অপু অবশেষে ছেলে কাজলের টানে ঘরে ফিরল। কিন্তু গল্প তো সেখানে থেমে থাকে না। থেমে থাকেনি বিভূতিভূষণের অপু। আবারও সে বেরিয়ে পড়ে মনের তাগিদে। কাজলকে নিয়ে রেলগাড়িতে করে কাশী যাওয়া মনস্থ করে অপু। শুভ্রজিৎ এই ছবিকে পাঁচটি পরিচ্ছেদে ভাগ করেছেন। তার প্রথম ভাগ হলো রেলযাত্রা। ধূমলগড় এস্টেটের স্কুলমাস্টারির চাকরি নিয়ে চলেছে অপু, সঙ্গে রয়েছে কাজল। রেলগাড়ির কামরায় অপুর সঙ্গে দেখা হয়ে যায় শৈশব কৈশোরের বন্ধু ও প্রথম প্রেম লীলার। কিন্তু সে দেখা হওয়া যত আনন্দের হতে পারতো তা না হয়ে বড় বেশি বেদনা জাগিয়ে দিয়ে গেল অন্তর্মুখী অপুর মনে। বিভূতিভূষণের কল্পনায় চল্লিশের দশকের ট্রেনের কামরা, অতীত স্মৃতিচারণ আর দুটি ব্যথিত হৃদয়ের অব্যক্ত অনুভূতিকে মাত্র কয়েক মুহূর্তে সার্থকভাবে ছুঁয়ে গেলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
আরও পড়ুন: পাকদণ্ডীর পথে পথে দেওরিয়াতাল
পরের পরিচ্ছেদ কাশী। এখানে শুভ্রজিৎ এমন এক চরিত্রের অবতারণা করেছেন যা মূল উপন্যাসে না থেকেও দর্শকের হৃদয়কে জয় করে নেবে নিশ্চিতভাবে। ‘চাঁদের পাহাড়’ উপন্যাসের শঙ্কর বাঙালির ওই চিরকাল আঁকড়ে থাকা চরিত্রদেরই একজন। মূল উপন্যাসে ছিল এক বিদেশি ভূপর্যটকের চরিত্র। সেই জায়গায় একই লেখকের আর এক কালজয়ী চরিত্রকে ছবিতে নিয়ে এসে বাজিমাত করেছেন পরিচালক। অপু ও শঙ্কর, দুই চরিত্রের ওয়ান্ডারলাস্ট বা ভ্রমণপিপাসা মিলে গেল বেনারসের গঙ্গার ধারে। বরং কাজলকে নিয়ে অপুর ভেতরে যে দোটানা কাজ করছিল, নিজের স্বাভাবিক গতিময়তা থেকে খানিক বিরতি নিয়ে যে অনিশ্চয়তার মধ্যে সে দিন কাটাচ্ছিল, তা কেটে গেল শঙ্করের কথাতেই। অপুর প্রতিটা মনোলগে তার কল্পনার জগতের সঙ্গে অদ্ভুতভাবে মিশে থাকে ছোট্ট কাজল। ভাবনায় নিয়ত আনাগোনা করে অপর্ণা। অর্থাৎ যতই সে ছুটে বেড়াতে চাক ‘সিংহল সমুদ্র থেকে মালয় সাগরে’, তার অন্তরের সূত্র তাকে অনিবার্যভাবে জুড়ে দেয় কাজলের সঙ্গে। অপুর পুরোনো বাড়িতে পদার্পন ও সর্বজয়ার জায়গায় অন্য এক মহিলাকে উঠোন ঝাড় দেবার দৃশ্যে তার বিহ্বলতা দেখতে ভালো লাগে। তবে এই জায়গায় শৈশবের স্মৃতিচারণটুকুর যেন প্রয়োজন ছিল বলে মনে হয়। দর্শক যদি সত্যজিতের ছবিগুলি না দেখে থাকেন, এই জায়গায় তাঁদের পক্ষে মিলিয়ে নেওয়া কঠিন হবে।
আরও পড়ুন: সব কান্নার শব্দ হয় না, বেজে উঠল পটদীপ
তৃতীয় পরিচ্ছেদ কলিকাতা পর্ব নিয়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধর কারণে দেশের দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি, হাওড়া ব্রিজ তৈরির শেষ মুহূর্তের কাজ, স্বাধীনতা সংগ্রাম, ভারত ছাড়ো আন্দোলন, সবকিছুকে ছুঁয়ে গেছে অপু ও কাজলের কলকাতাবাসের দিনগুলো। এর পরবর্তী পরিচ্ছেদে রয়েছে নিশ্চিন্দিপুর। সম্ভবত ছবির সবথেকে মনোমুগ্ধকর পরিচ্ছেদ এটি। বাংলার চিরাচরিত ‘ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড়’-এর ইমেজারিকে সফলভাবে ধরে রাখে ছবির এই পর্ব। পরিবারকেন্দ্রিক পল্লীগ্রাম জীবনের বড় সুন্দর এক ছবি উঠে আসে এই শেষভাগে। যেখানে খোলামেলা বাড়ির দোতলার বড় গরাদওয়ালা জানলার পাশেই বেড়ে উঠতো আম কিংবা পেয়ারা গাছ, কীর্তনের আসরে শোনা যেত ‘হরি হরয়ে নম কৃষ্ণ যাদবায় নম, যাদবায় মাধবায় কেশবায় নম’, যেখানে শিশুরা দুগ্গাঠাকুরের চেয়ে বেশি মন দিয়ে দেখতো দেবদেবীর বাহন আর অসুরকে, যেখানে পাশের বাড়ির মানুষ ছিল নিজের লোকের চেয়েও বেশি আপন। গ্রামদেশের আন্তরিকতা ও সহজ সারল্যের ছোট-ছোট কোলাজে কাজলের শৈশব ও অপুর স্মৃতিচারণের সঙ্গে একাত্ম হতে সময় লাগবে না দর্শকের। রানুদি কিংবা সতুর মতো কেউ-কেউ থেকে যায় যেন কোথাও, যাদের নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে ফেরা যায় যে কোনওদিন। সময়টাই শুধু পাল্টে যায়। আগে যে অপু-দুর্গা ট্রেন দেখার আশায় ছুটে যেত, তারাই একদিন আকাশে প্লেন উড়ে যেতে দেখে উচ্ছ্বসিত হয়। তবু সেই উৎসাহ যেন একইরকম থেকে যায় বরাবর।
অপুদের নিশ্চিন্দিপুর ছাড়ার রেশ নিয়েই শেষ হতে পারতো ছবিটা। বাকি অংশ আলাদাভাবে পঞ্চম পরিচ্ছেদের অন্তর্গত না করে শেষাংশের সঙ্গে যুক্ত করা যেত। এই জায়গায় ‘অভিযাত্রিক’ কিছুটা প্রলম্বিত লাগে। কিছু অসঙ্গতি, যেমন রেলগাড়ির খোলা কামরায় হাওয়ার দাপটের অভাব, ১৯৪২-এর প্রেক্ষাপটে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপস্থিতি, তুলসীমঞ্চে প্রদীপ দেওয়ার বিশেষ মন্ত্র, এরকম সামান্য কিছু ত্রুটি থাকলেও তাকে উপেক্ষা করাই যায় ছবির চিত্রনাট্য ও অভিনয়ের গুণে।
আরও পড়ুন: শেষের সেদিন, উপস্থিত ছিলেন শুধু মহেশ ও ড্যানি
রঙের ব্যবহার যেভাবে আমাদের মনের নানা অনুভূতিকে ফুটিয়ে তুলতে সাহায্য করে, তার চেয়েও বোধহয় কিঞ্চিৎ বেশি তা ফুটে ওঠে রঙহীনতায়। সম্পূর্ণ সাদাকালোয় ধরে রাখা ‘অভিযাত্রিক’ তার অন্যতম প্রমাণ। সাদাকালোর ব্যাপ্তি অসামান্যভাবে ধরা পড়েছে চিত্রগ্রাহক সুপ্রতিম ভোলের প্রতিটি ফ্রেমে। ক্যামেরার দৃষ্টিকোণ বহু ক্ষেত্রে অপুর বড়বেলাকে মিলিয়ে দিয়েছে তার শৈশবের সঙ্গে। বিক্রম ঘোষের অভিযাত্রিক থিম আগেই দর্শক শ্রোতাদের মন জয় করেছে। ছবির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিক্রমের সুর প্রতিটি দৃশ্যে ভালোলাগার রেশ রেখে যায়। সাহেব চট্টোপাধ্যায়ের খোলা গলায় গাওয়া ‘আকাশ ভরা সূর্য তারা’ গানটি মনে থেকে যাবে অনেকদিন। অনবদ্য লেগেছে উজ্জ্বয়িনী মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে কীর্তনও।
আরও পড়ুন: নব্বইয়ের ‘সত্যান্বেষী’, বাদ পড়লেন ব্যোমকেশ
অভিনয়ে প্রত্যেকেই যথার্থ চরিত্র হয়ে উঠেছেন বলা যায়। অর্জুনের জন্য কোনও প্রশংসাই যথেষ্ট নয়। নস্ট্যালজিয়া প্রিয় বাঙালির প্রিয় চরিত্র হয়ে ওঠা খুব একটা সহজ কাজ ছিল না। তবু যেন অবলীলায় সেই চরিত্র হয়ে উঠেছেন তিনি। অপু হয়ে ওঠার জন্য কোথাও এতটুকু অতিঅভিনয় করতে হয়নি তাঁকে।
বলা হয় শিশুরা স্বাভাবিক অভিনেতা। কাজলরূপী আয়ুষ্মান সেই কথাই প্রমাণ করেছেন। অসামান্য অভিনয়ে অচিরেই তিনি উপন্যাসের কাজল হয়ে উঠেছেন। ভালো লাগে অপর্ণারূপী দিতিপ্রিয়াকেও। একটিও সংলাপ না বলে নিজের ছাপ রেখে গেছেন তিনি। সব্যসাচী তাঁর নিজের মতোই। যদিও শঙ্করের চরিত্রটিকে কিছুটা অন্তর্মুখী হিসেবেই জেনে এসেছে পাঠক তবু সম্ভবত সব্যসাচীর নিজস্ব ছায়াকেই এই চরিত্রে চেয়েছিলেন পরিচালক। সেই ভূমিকায় তিনি সম্পূর্ণ সফল। লীলার চরিত্রে অর্পিতার পরিণত অভিনয় মন ছুঁয়ে যায়। ছোট-ছোট চরিত্রে ভালো লেগেছে তনুশ্রী, রূপাঞ্জনা, সোহাগ ও বরুণকে। রাধিকাচারণের ভূমিকায় সুন্দর মানিয়ে গেছেন বরুণ। চরিত্রটির ম্যানারিজ়ম দেখতে ভালো লাগে।
অসম্ভব ভালো লেগেছে সতু আর রানুদির ভূমিকায় শ্রীলেখা ও বিশ্বনাথকে। দুই অভিজ্ঞ অভিনেতা স্বল্প পরিসরেও প্রমাণ করেছেন সুযোগ পেলে তাঁরা কী করতে পারেন। কাজলের হাত ধরে বলা সতুর শেষ সংলাপগুলো বড় মায়াময় শুনতে লাগে। ওই দুই ছত্রেই ছবির মূল কথা যেন বলা হয়ে যায়।
সেই কথার সঙ্গে সুর মিলিয়েই বলতে ইচ্ছে করে এত বড় পৃথিবীর যেখানেই যাও না কেন, জানবে এই দেশের এককোণে তোমার নিজের ভিটে আছে। যেখানে তোমার আপনজনরা থাকেন। শুধু অপু বা কাজল নয়, আমাদের সকলেরই যেন সারাজীবনের সব ক্লান্তির শেষে সেই শান্তির নিশ্চিন্দিপুরে ফিরতে ইচ্ছে করে যেখানে বাঙালির সনাতন আটপৌরে জীবন বেঁচে রয়েছে আজও। ঘরে ফেরার টানে যেখানে ফিরে এলে সত্যিই ‘ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন’। সেই ঘরোয়া বাঙালির মনের কথাই বলতে চেয়েছেন শুভ্রজিৎ, যেখানে অপুকে অবলম্বন করে নিজ-নিজ নিশ্চিন্দিপুরে একাকার হয়ে যাওয়া যায়।