প্রবীর-বিজয়ের চেনা মেজাজে মগজাস্ত্রের ছোঁয়া
ছবি: দশম অবতার
পরিচালনা: সৃজিত মুখোপাধ্যায়
অভিনয়ে: প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, অনির্বাণ ভট্টাচার্য, জয়া আহসান, যিশু সেনগুপ্ত
দৈর্ঘ্য: ২ ঘণ্টা ৩৪ মিনিট
RBN রেটিং ★★★★★★★☆☆☆
‘পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতম, ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।’ এ কথা আমরা প্রত্যেকেই জানি, অনেকেই বিশ্বাসও করি যে জগৎকে দুষ্কৃতি ও অন্যায়ের হাত থেকে মুক্ত করতে যুগে-যুগে বিষ্ণুর বিভিন্ন অবতারের আবির্ভাব ঘটেছে। পুরাণমতে চারটি যুগের মধ্যে ন’জন অবতারের আবির্ভাব ঘটে গেছে। বাকি রয়েছে শুধু কল্কি অবতার। কলি যুগের অবসান হবে কল্কির হাত ধরেই। তিনি কবে আসবেন কেউ জানে না। আন্দাজ করা যায় মানুষের পাপের ঘড়া পূর্ণ হলে কল্কি আবির্ভূত হবেন ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা করতে। সেই কল্কি কাহিনীর সূত্র ধরেই সৃজিত শুরু করলেন তাঁর কপ ইউনিভার্সের ছবি।
২০০০ সালের পরের ঘটনা। শহরে ঘটে চলেছে একের পর এক খুন। পদ্ধতি অভিনব। অপরাধী কোনও চেনা ছকে খুন করে না। অথচ তার সিরিয়াল কিলিংয়ের প্রমাণ রেখে যায়। এই অদ্ভুত হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করতে লালবাজার দুঁদে সিরিয়াল কিলার স্পেশালিস্ট গোয়ন্দা প্রবীর রায়চৌধুরীকে (প্রসেনজিৎ) নিয়োগ করে। সহকারী হিসেবে থাকে বিজয় পোদ্দার (অনির্বাণ)। একে-একে তিনটে খুন হয়ে যাওয়ার পরে মানসিকভাবে অসুস্থ এক ব্যক্তিকে খুনি বলে শনাক্ত করে মনোবিদ মৈত্রেয়ী (জয়া)। কিন্তু তাতে কি বাকি খুনগুলো আটকানো যায়? নিজেকে ঈশ্বর ভেবে ফেলা সেই ব্যক্তির শাস্তি হবে কি? নাকি আরও বড় কোনও খেলা চলছে এই সবকিছুর পিছনে?
আরও পড়ুন: এত ‘অরণ্য’ কেন?
২০১১ সালে মুক্তি পাওয়া ‘বাইশে শ্রাবণ’ যে প্রবীর রায়চৌধুরীকে সৃষ্টি করেছিল এই ছবির গল্প তারও বছর দশেক আগের। ‘বাইশে শ্রাবণ’, ‘ভিঞ্চিদা’ এবং পরবর্তীতে ‘দ্বিতীয় পুরুষ’ও মিলিতভাবে জন্ম দিয়েছে এই ছবির। সৃজিতীয় ইউনিভার্সের নিয়ম মেনেই প্রবীর থেকে বিজয় সকলেই পাঞ্চলাইনের ওপর নির্ভর করে আসাযাওয়া করে। সকলেই তুখোড় স্মার্ট। এতটাই যে মৃত্যুর মুখে হাত-পা বেঁধে ফেলে রাখলেও নিজেদের সিগনেচার লাইন আওড়াতে ভোলে না। কেউ বলে ‘বাবু নয় স্যার’, তো কেউ বলে ‘স্যার নয় ইন্সপেক্টর’। তবে বিভিন্ন খুনের পদ্ধতিতে যে অভিনবত্ব দেখানো হয়েছে এবং তার সঙ্গে বিষ্ণুর যে সব রূপের মেলবন্ধন ঘটানো হয়েছে তার তুলনা কমই পাওয়া যায়। বিশেষ করে প্রথম ও চতুর্থ খুনের পদ্ধতি এবং তার পৌরাণিক যোগাযোগ চমকে দেবার মতোই। সেদিক দিয়ে দেখলে এ ছবি সার্থক থ্রিলার। এই বিষয়ে পরিচালকের দক্ষতা সর্বজনবিদিত এবং তার যথেষ্ট প্রমাণ এ ছবিতেও রয়েছে। পরিচালক সৃজিত বলেই কারও মনে প্রশ্ন জাগতে পারে শুরু থেকেই খুনির পরিচয় দিয়ে দেওয়া হলো কেন? আবার তাঁর গল্প বলার ধরনের সঙ্গে যাঁরা পরিচিত, তাঁরা জানেন এরপরেও গল্প মোড় নেবে সেই হোয়াইডানইট হয়ে হুডানইটের জটিল প্রশ্নেই।
তবু দশ অবতারের জটিল ব্যাখ্যা, বিভিন্ন পুরাণের উল্লেখ, তেত্রিশ কোটির অর্থ, তাত্ত্বিক আলোচনা এবং সংস্কৃত শ্লোক আউড়ে দর্শকদের চামচ-ফিড করার যে চেষ্টা করা হলো তা কিঞ্চিৎ জ্ঞানের পর্যায়েই পড়ে। প্রবীর রায়চৌধুরীর মতো মাস চরিত্র এতে করে কিছুটা বেশি ভারী হয়ে উঠলেন না কি? কেস সলভ করা মানেই তো এমন নয় যে পুলিশকে সব জানতে হবে। জানাবার জন্য থাকে অন্যান্য দপ্তর এবং বিশেষজ্ঞেরা। এদিকে একটু নজর দিলে আরও সিরিয়াস হয়ে উঠতে পারত প্রবীর-পোদ্দার জুটির জার্নি। রহস্য একটা সময় কিছুটা প্রত্যাশিত হয়ে উঠলেও শেষের চমকটুকু ধরে ফেলা যায় না, আর তাই সেই অংশটুকু সুন্দর অভিনয়ের জন্যই মনে রাখা যায়।
আরও পড়ুন: ₹৫০ কোটি হাঁকলেন সানি
ছবির বিশেষ কিছু দৃশ্য মনে থেকে যায়। তার মধ্যে অন্যতম হাওড়া ব্রিজের ওপর কল্কিরূপে ঘোড়ার চড়ে খোলা তলোয়ার হাতে যিশুর দৌড়ে বেড়ানো এবং আপাত পরিষ্কার এবং নগ্ন মডেলদের শিরশ্ছেদ করার দৃশ্য। এছাড়াও বিশ্বরূপের ঘরের ভেতরের অজস্র কাগজের কাটিং কিংবা দশাবতার বোর্ড ইত্যাদি মনে রাখার মতো। প্রবীর ও বিজয়ের একজোট হয়ে বিশ্বরূপকে তাড়া করার দৃশ্য সত্যিই রোমাঞ্চকর। দুজনের আলাপ এবং সংঘাত, দুটি দৃশ্যই উপভোগ্য। জয়ার সঙ্গে অনির্বাণের রসায়ন মন্দ নয়, তবে প্রবীর-বিজয়ের রসায়ন দুর্দান্ত।
অভিনয় নিয়ে বিশেষ কিছু বলার নেই কারণ প্রত্যেকেই অভিজ্ঞ অভিনেতা। ছবির সবথেকে সিনিয়র ও মূল চরিত্র হিসেবে প্রসেনজিতের ফিটনেস দেখলে অবাক হতে হয়। কুড়ি বছর পিছিয়ে গিয়ে তিনি নিজেকে যেভাবে প্রেজ়েন্ট করেছেন, তার জন্য কোনও প্রশংসাই যথেষ্ট নয়। চেজ় সিনেও তিনি অবাক করেছেন। অনির্বাণ বরাবরের মতোই উজ্জ্বল, বিশেষ করে ক্লাইম্যাক্স দৃশ্যে। অনুতাপের দৃশ্যে সেই পুরনো অনির্বাণকে ফিরে পাওয়া যায় যেন, দর্শক হিসেবে এও কম প্রাপ্তি নয়। নরমসরম আবেগি চরিত্রে জয়া মানানসই এবং সুন্দর। উল্টোদিকে মৈত্রেয়ী চরিত্রের ভাঙাগড়াও তিনি ফুটিয়েছেন দক্ষতার সঙ্গে। একটি বিশেষ দৃশ্যে তাঁর সংলাপ সুচিত্রা সেনের এক বিখ্যাত দৃশ্য মনে করাবে। এই জায়গায় জয়া সত্যিই জ্বলে উঠেছেন।
এবং যিশু। তিনি যে নিজেকে কতটা এবং কীভাবে বদলে ফেলেছেন তা না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। যিশুর নিজস্বতা হারিয়ে পর্দা জুড়ে তাঁর চেহারায় হাবেভাবে সর্বত্র শুধু বিশ্বরূপ থেকে গিয়েছে। যেমন অনবদ্য তাঁর লুক তেমনই অপাপবিদ্ধ লেগেছে তাঁর চরিত্রকেও।
অনুপম রায়ের সুরে ও তাঁর নিজের গলায় ‘আমি সেই মানুষটা আর নেই’, অরিজিৎ সিংহ ও শ্রেয়া ঘোষালের কণ্ঠে ‘বাউন্ডুলে ঘুড়ি’, এবং রূপম ইসলামের কণ্ঠে ‘আগুনখেকো’, তিনটি গানই জনপ্রিয়তা পেয়েছে। প্রতিটি গানই শ্রুতিমধুর। তবে ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্তের সুরে ও অজয় চক্রবর্তীর কণ্ঠে শীর্ষসঙ্গীত ‘জয় জগদীশ হরে’ গানটির উপস্থাপনা এক ভাবগম্ভীর পরিবমন্ডল রচনা করে যা সত্যি অতুলনীয়।
সৌমিক হালদারের চিত্রগ্রহণ প্রত্যাশিতভাবেই বেশ ভালো। বিশ্বরূপের বৃদ্ধের মেকআপে সোমনাথ কুণ্ডুর কাজ প্রশংসনীয়। থ্রিলার ছবির ভেতরে পরতে-পরতে চারটি চরিত্রের উঠে আসা অন্যভাবে এই ছবিকে আর এক চতুষ্কোণে পরিণত করে যা আড়াই ঘণ্টার সময়সীমায় দর্শককে আনন্দ দেবে। একটু বেশি সিনেম্যাটিক হলেও আশা করা যায় পুজোর মুখে তারকাখচিত ছবি দর্শক আনুকূল্য থেকে বঞ্চিত হবে না।