বোকা বানিয়ে দেয় ক্লাইম্যাক্স, কাটে না বিস্ময়বোধ

ছবি: অন্তর্ধান

পরিচালনা: অরিন্দম ভট্টাচার্য

অভিনয়ে: পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, তনুশ্রী চক্রবর্তী, মমতা শংকর, রজতাভ দত্ত, মোহর চৌধুরী, সুজন নীল মুখোপাধ্যায়, হর্ষ ছায়া, সুনীতা সেনগুপ্ত, অক্ষয় কাপুর, কুমারজিৎ খান

দৈর্ঘ্য: ১ ঘন্টা ৪৬ মিনিট

RBN রেটিং: ৩.৫/৫

‘থ্রিলার’ শব্দটা বাঙালির বড় প্রিয়। ইতিহাস সাক্ষী, যখনই কোনও গল্প, উপন্যাস, ছবি কিংবা ধারাবাহিকে রহস্যের গন্ধ পাওয়া গিয়েছে, সিংহভাগ বাঙালি তার স্বাদ নিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। খুনজখম, চুরিডাকাতি, হারিয়ে যাওয়া বা অপহরণ—রহস্য যে কোনও ধাঁচের বা যে ফ্লেভারেরই হোক না কেন—সামাজিক, পারিবারিক, মনস্তাত্বিক, রোমান্টিক এই সমস্ত শব্দের পিছনে একটা ‘থ্রিলার’ জুড়ে দিলেই হলো। বাঙালি দর্শক শুধু ওই থ্রিলারের লোভেই বসে পড়বে ছবি দেখতে। এই থিওরি মেনে যখন বছরে প্রায় সত্তর শতাংশ ছবিকেই থ্রিলার বলে দেগে দেওয়া হচ্ছে, সেই সময় ‘অন্তর্ধান’কে নিয়ে বিশাল কোনও আগ্রহ হয়তো তৈরি হবে না। তবে ছবিটার প্রতি আগ্রহের একটাই কারণ থেকে যায়, তা হলো পরিচালকের নাম। তাঁর আগের দুটি থ্রিলারে অরিন্দম যে দক্ষতা দেখিয়েছেন, তার পরে ‘অন্তর্ধান’ নিয়ে অন্যরকম এক উত্তেজনা ছিলই। সেই উত্তেজনা যে তাঁর ছবির ক্ষেত্রে সার্থক, তা আবারও প্রমাণ করলেন পরিচালক।




ছবির কাহিনী কসৌলি শহরের। যেখানে ভিজ়িটিং প্রফেসর হিসেবে এসেছে অনির্বাণ। সঙ্গে স্ত্রী তনুশ্রী (তনুশ্রী) ও তেরো বছরের মেয়ে জিনিয়া (মোহর)। সাইকেল নিয়ে ছোট্ট পাহাড়ি শহরে ঘুরে বেড়ায় জিনিয়া। নিজের ইচ্ছে মতো পুরোনো বইয়ের দোকানে গিয়ে বই পাল্টে আনে। মা তাকে এই ব্যাপারে বেশ স্বাধীনতাই দেয়। তবে সতর্ক থাকতেও বলে। এই বয়সে একটু তো সাবধানে থাকতেই হয়। তবু শেষরক্ষা হয় না। বন্ধুদের সঙ্গে এক্সকার্শনে গিয়ে হঠাৎ করেই উধাও হয়ে যায় জিনিয়া। বন্ধুদের বাড়ি-বাড়ি গিয়ে খোঁজ করেও জানা যায় না সে কোথায়। এমনকি এক্সকার্শনটাই নাকি বাতিল হয়ে গিয়েছিল, এমনও জানা যায় বন্ধুদের থেকে। তাহলে কি জিনিয়াকে কেউ অপহরণ করল?

তিনদিন পার হয়ে গেলেও মুক্তিপণ চেয়ে অনির্বাণের কাছে কোনও ফোন আসে না। তদন্তে নেমে দুঁদে ক্রাইম ব্রাঞ্চ অফিসার নীলাদ্রি সেন (রজতাভ) ও তার দুই সহকারী প্রায় নাকানিচোবানি খেয়ে যায়। তবে দুই প্রতিবেশী জানায় যে তারা জিনিয়াকে একটা সাদা গাড়িতে উঠতে দেখেছে। অনির্বাণের বন্ধু দম্পতি (নীল ও সুনীতা) তনুশ্রী ও অনির্বাণের পাশে থাকে, কিন্তু কোনও সুরাহা করতে পারে না। পাশের বাড়ির মিসেস অপরাজিতা রায় (মমতা শংকর) তাঁর তন্ত্র সাধনার দ্বারা অনির্বাণদের সাহায্য করার চেষ্টা করেন, যদিও এসবে নীলাদ্রি বা অনির্বাণ কারোরই বিশ্বাস নেই।

আরও পড়ুন: শেষের সেদিন, উপস্থিত ছিলেন শুধু মহেশ ও ড্যানি

হঠাৎই নীলাদ্রির হাতে আসে কয়েকটি সূত্র। ইনসমনিয়ার রোগী নীলাদ্রির রাতে ঘুম হয় না, ফলে সে সারাদিন হাই তোলে। তবে কাজের জায়গায় সে বেজায় কড়া অফিসার। সহায়ক অফিসার হরজিন্দরের সাহায্যে সূত্রগুলোকে খতিয়ে দেখতে গিয়ে বেশ বড়রকমের গোলমালের আঁচ পায় নীলাদ্রি। সেই গোলমালে জড়িয়ে যায় স্থানীয় এক নেতাও। যদিও প্রমাণ পাওয়া যায় না কিছুই। এর পরের অংশটুকু ছবির জন্য তোলা থাক।

থ্রিলারের ভরা বাজারে আজকাল বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দু’একটা ঘটনা দেখে গল্পের শেষটা আন্দাজ করে নেওয়া যায়। কাহিনীর গতিপ্রকৃতিই বলে দেয় এরপর কী ঘটতে চলেছে। হাতে গোনা কয়েকটি ছবির ক্ষেত্রে শেষটা বোঝা না গেলেও, ক্লাইম্যাক্সের ঠিক আগেই যেন গল্পটা মাথায় এসে যায়। কালেভদ্রে এমন কোনও ছবি আসে যার ক্লাইম্যাক্স একেবারে মন্ত্রমুগ্ধ করে দেয়। এমনকি সবটা জানার পরও গল্পের অন্তিম মুহূর্তটাও কেমন যেন বোকা বানিয়ে দিয়ে যায়। ঠিক সেটাই করলেন অরিন্দম। যা কিছু হতে পারে, সবরকম সম্ভাবনাকে মাথায় রোপণ করার পরেও এই ছবির ক্লাইম্যাক্স দেখে হতবাক হতেই হয়। অথচ গল্পের মধ্যেই ছিল তার সূত্র। ছবির শেষ মুহূর্ত অবধি চলে শুধু অবাক হওয়ার পালা। এতটা চমক শেষ কবে বাংলা ছবিতে পাওয়া গেছে মনে করা মুশকিল।

আরও পড়ুন: নব্বইয়ের ‘সত্যান্বেষী’, বাদ পড়লেন ব্যোমকেশ

‘বোম্বাইয়ের বোম্বেটে’ ছবিতে জটায়ুর গল্প নিয়ে তিনঘন্টার ছবিকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ফেলুদা বলেছিল, দেড় ঘন্টা লাগবে জট পাকাতে আর বাকি দেড় ঘন্টা ছাড়াতে। অর্থাৎ এই হলো গড়পড়তা সিনেমার ফর্মুলা। এ ক্ষেত্রে সেই ফর্মুলা না মেনেও যে জট পাকানো চলেছে ছবির দ্বিতীয়ার্ধেরও অনেকটা জুড়েই, তা যেন এক ঝটকায় খোলা হয়ে গেল শেষ দশ মিনিটে। প্রথমার্ধে কাহিনী কিছুটা ধীর লয়ে এগোলেও, দ্বিতীয়ার্ধে তা প্রায় বুলেট গতিতে ছুটেছে। সেই গতিতে দর্শকের সাধ্য নেই অন্যদিকে তাকায়। স্ক্রিন ছেড়ে কোনও দরকারে মোবাইলে চোখ রাখার কথাও মনে থাকে না এই সময়ে। এমনভাবে দর্শককে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রাখার জন্য অরিন্দমকে  কোনও জবরদস্ত পাঞ্চলাইন কিংবা মহান পরিচালকের দেখিয়ে যাওয়া কোনও দৃশ্যের নকল করতে হয়নি। স্বাভাবিক ছন্দে গল্প এগিয়েছে। প্রথমার্ধের মাঝামাঝি জায়গা থেকেই জিনিয়ার আচমকা উধাও হয়ে যাওয়ায় সৃষ্ট টেনশন গোটা ছবি জুড়ে ধরে রেখেছেন পরিচালক।

বাংলায় ভালো থ্রিলারের অভাব বলে যারা হাহুতাশ করেন তাঁদের জন্য ‘অন্তর্ধান’ সুখবর। পৌনে দু’ঘন্টা সময় ধরে টানটান সাসপেন্স দিয়ে দর্শককে এক জায়গায় বসিয়ে রাখা, এবং অন্য কিছু ভাবতেও না দেওয়া, মুখের কথা নয়। অরিন্দম এখানে একশো ভাগ সফল।

আরও পড়ুন: বাইপোলার ডিসঅর্ডার থেকে চরম অবসাদ, হোমসে ‘ডুবে’ গিয়েছিলেন জেরেমি

তনুশ্রীর লিপে ছবিতে একটি ঘুমপাড়ানী গান আছে, যেটি গেয়েছেন উজ্জ্বয়িনী মুখোপাধ্যায়। অসম্ভব সুন্দর লেগেছে শুনতে। গানটি যখন শোনানো হয়, সেই সময় ছাড়া একেবারে শেষে গিয়েও তা গভীর অর্থবহ হয়ে ওঠে, যা দর্শকের মনে এক মায়ের আকুতিকে পৌঁছে দিতে বাধ্য।

অভিনয়ের ক্ষেত্রে শুরুতেই বলতে হয় তনুশ্রীর কথা। সন্তানহারা মায়ের ভূমিকায় তিনি অনবদ্য। কোথাওই তাঁকে ছবির চরিত্র থেকে আলাদা করা যায় না। পরমব্রত যথারীতি ভালো, তবে তেরো বছর বয়সী মেয়ের বাবার চরিত্রে এখনও তাঁকে খুব একটা মানানসই লাগে না।

আরও পড়ুন: সব কান্নার শব্দ হয় না, বেজে উঠল পটদীপ

রজতাভর জন্য কোনও প্রশংসাই যথেষ্ট নয়। নীলাদ্রির থেকে তাঁকে আলাদা করা যায় না। ঘুমহীনতায় ভোগা একা একটি মানুষ, যিনি সারাক্ষণ মেয়েকে মিস করেন, আবার কাজেও তুখোড়, গোটা ছবি জুড়ে দাপিয়ে অভিনয় করলেন রজতাভ। কেন যে কয়েক ডজন বাংলা ছবিতে তাঁকে বোকা-বোকা ভিলেনের চরিত্রে বা সস্তা হাস্যরসের উদ্রেক করতে ডাকা হয় কে জানে!

মিসেস রায়ের ভূমিকায় মমতা শংকরের পরিমিত অভিনয় আবারও বুঝিয়ে দেয় তিনি কোন শ্রেণীর অভিনেত্রী। কোথাও এতটুকু বাড়াবাড়ি না করেও অপরাজিতা চরিত্রের গভীরতাকে ধরে রাখলেন তিনি। প্রথম ছবি হিসেবে ছোট্ট জিনিয়ার ভূমিকায় মোহরের অভিনয় যথাযথ। মিষ্টি দেখতে লেগেছে তাঁকে। নীল, সুনীতা দুজনেই চরিত্রের সঙ্গে মানিয়ে গিয়েছেন। ছোট ভূমিকায় হর্ষকে দেখতে ভালো লাগে।

তবে অবাক করেছেন দুই সহায়ক অফিসারের ভূমিকায় অক্ষয় ও কুমারজিৎ। দুজনেই যে যাঁর জায়গায় রজতাভর সঙ্গে যোগ্য সঙ্গত করে গেছেন। কুমারজিতের স্বাভাবিক অভিনয় ও অক্ষয়ের বুদ্ধিদীপ্ত অভিব্যক্তি ছবির ক্লাইম্যাক্সকে আরও উপভোগ্য করে তোলে। ভবিষ্যতে এঁদের আরও বড় চরিত্রে দেখার আশা রইল।

রাতুল শংকরের আবহ ছবির সঙ্গে মানানসই। সম্পাদনা প্রশংসনীয়।



টানটান থ্রিলার দেখতে হলে কাজ সেরে সময় হাতে নিয়ে বসা দরকার, এ কথা সকলেরই জানা। তবে এ ছবির ক্ষেত্রে উল্টোটাই বলা যায়। হাতে কাজ থাকলেও সেদিকে মন দেওয়ার বিশেষ সুযোগ পাবেন না দর্শক, যদি একবার তিনি গল্পের মধ্যে ঢুকে যান। কাজেই এ ছবি প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে দেখতেই হবে।  

গল্পের বাঁধুনি এবং সমস্ত জটিলতার অঙ্কের পরিষ্কার সমাধান যে কোনও থ্রিলারকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার অপরিহার্য অংশ। অরিন্দমের প্রতিটি ছবির গল্পে এই বাঁধুনি থাকেই, ‘অন্তর্ধান’-এও তার অন্যথা হয়নি। তবে ক্লাইম্যাক্স দৃশ্যটি এয়ারপোর্টের খোলা লাউঞ্জে না করে বন্ধ ঘরে করা যেত। সুদূর হিমাচলে এত বড় লাউঞ্জে কোনও যাত্রী বাংলা বুঝবে না এমনটা নাও হতে পারে। তবু ছবির শেষে প্রতিটি অঙ্ক স্পষ্টভাবে মিলে যাওয়ার পরেও যেন বিস্ময়বোধ কাটে না। 



Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Swati

Editor of a popular Bengali web-magazine. Writer, travel freak, nature addict, music lover, foody, crazy about hill stations and a dancer by passion. Burns the midnight oil to pen her prose. Also a poetry enthusiast.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *