উপরি পাওনা অভিনয়ের মাস্টারক্লাস

ছবি: মানিকবাবুর মেঘ 

অভিনয়ে: চন্দন সেন, দেবেশ রায়চৌধুরী, নিমাই ঘোষ, ব্রাত্য বসু, অরুণ গুহঠাকুরতা

পরিচালনা: অভিনন্দন বন্দ্যোপাধ্যায়

দৈর্ঘ্য: ১ ঘণ্টা ৩৭ মিনিট 

RBN রেটিং ★★★★★★★★☆☆

মালবিকা দাশগুপ্ত: মানিকবাবু (চন্দন) একটা মেঘ দেখতে পান। সেই মেঘ নাকি তাঁকে অনুসরণও করে। দু’কামরার ভাড়া বাড়ির বাসিন্দা মানিকবাবুর একাকী জীবনে যখন একটি অ্যালার্ম ঘড়ি, গাছপালা, পিঁপড়ে আর মাকড়সা সঙ্গী, তখনই মেঘ আসে তাঁর জীবনে। প্রথম-প্রথম মেঘটাকে খুব ভয় পেতেন মানিকবাবু। পালিয়ে আসতেন। কিন্তু ক্রমশ সেই মেঘই হয়ে উঠল তাঁর সঙ্গিনী, কথা বলার দোসর।



এ এক অন্যরকম প্রেমের গল্প। মেঘের সঙ্গে নিভৃতে কথা বলেন মানিকবাবু। কখনও ছাদে দাঁড়িয়ে, কখনও খোলা মাঠে শুয়ে। সেই যে, ‘মেঘ দেখতাম ছাদের ঘরে…’ মেঘকে আর বার্তাবহ না করে তারই প্রেমে পড়েন মানিকবাবু। 

কিন্তু মেঘ? এক সময় তো সে বৃষ্টি হয়।
‘আর হ্যাঁ, শোন—এখন আমি
মেঘ নই আর, সবাই এখন
বৃষ্টি বলে ডাকে আমায়।’
বলেই হঠাৎ এক পশলায়
চুল থেকে নখ—আমায় পুরো
ভিজিয়ে দিয়ে—
                           অন্য অন্য
বৃষ্টি বাদল সঙ্গে নিয়ে
মিলিয়ে গেল খরস্রোতায়
মিলিয়ে গেল দূরে কোথায়
দূরে দূরে…।’

মানিকবাবুও ভিজে গেলেন। তাঁর একলা ঘরের চৌহদ্দিতে মেঘের ছায়া পড়ল না আর। মানিকবাবুর একাকীত্ব, শয্যাশায়ী বাবার (নিমাই) মৃত্যুতে তাঁর আরও একলা হয়ে যাওয়া। তারপর মেঘের পার্সোনিফিকেশন। সবটার একটা মনস্তাত্ত্বিক ব্যখ্যা দেওয়াই যায়। কিন্তু মনস্তত্ত্ব ছাপিয়ে এই ছবি কখন যে নিটোল প্রেমের গল্প বলতে শুরু করেছে, তা দর্শক নিজেও হয়তো টের পাবেন না। 

অভিনয়ে আসা যাক। চন্দন একাই অনবদ্য। শুরুর দিকের একলা জীবন, গাছেদের সঙ্গে সহবাস। তারপরের নবোদ্ভুত প্রেমের উল্লাস। এত কম সংলাপে শুধু শরীরী অভিব্যক্তি দিয়েও যে ফুটিয়ে তোলা যায়, চন্দন তা করে দেখালেন। নতুন-নতুন প্রেমে পড়লে প্রেমিক যেমন নিজেকে সুন্দর করে প্রেমিকার কাছে উপস্থিত করতে চায়, মানিকবাবুও বৈশাখ মাসে স্যুট পরে ঘুরে বেড়ান। দোকানদার কালি (দেবেশ) তাকে উন্মাদ বললে তার কিছু আসে যায় না। পুরো ছবি জুড়ে শুধুই চন্দনের অভিব্যক্তি। সত্যি কথা বলতে কী, অভিব্যক্তিই এই ছবির সংলাপ। ২০২১ সালে মুক্তি পেয়েছিল ‘মানিকবাবু মেঘ’। রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ কয়েকটি দেশ ঘুরেছে। এই ছবির জন্য রাশিয়ায় সেরা অভিনেতার পুরস্কারও পেয়েছেন চন্দন।

আরও পড়ুন: জ়োরাম্বো হতে পারলেন না মোগাম্বো

অনাবশ্যক সংলাপ এ ছবিতে ব্যবহার করা হয়নি। তেমনই নেই কোনও অনাবশ্যক গান। এমনকী যন্ত্রসঙ্গীতের ব্যবহারও সীমিত। সঙ্গীত ব্যবহারে এত নিয়ন্ত্রণ সাম্প্রতিক বাংলা ছবিতে দুর্লভ। অভিনন্দন এবং সুরকার শুভ্রজিৎ মুখোপাধ্যায় এ কারণে প্রশংসার দাবি রাখেন। একদম শেষে অনির্বাণ ভট্টাচার্যের গাওয়া ‘তোমার আমার গল্প’-এর ব্যবহার ছবিকে অন্য মাত্রা দিয়েছে।

নিমাই, দেবেশ ও অরুণ যে যার ভূমিকায় অনবদ্য। একটি ছোট দৃশ্যে ছাপ রেখে গেলেন ব্রাত্য। তবে একজনের কথা আলাদা করে না বললেই নয়। ঝগড়ুটে বাড়িওয়ালির ভূমিকায় সুপ্রীতি দেবী। তাঁকে ছবিতে দেখা যায় না। শুধু তাঁর গলা শোনা যায়। প্রায় সংলাপহীন ছবিতে, তিনিই একমাত্র বাঙ্ময়। এবং তিনি তাঁর কণ্ঠ সম্পদের যথাযথ ব্যবহার করেছেন। 

আরও পড়ুন: সিক্যুয়েলে নেই দীপিকা

অর্জুন সিংহের কথা আলাদা করে বলতেই হয়। কম বাজেটের ছবিতেও যে এত নিখুঁত ক্যামেরার কাজ করা যায়, এ ছবি তার প্রমাণ। আলাদা করে বলতে হয় ছবির সম্পাদক অভ্র  বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথাও। যে কোনও ছবিই সঠিক সম্পাদনার গুণে আলাদা মাত্রা পায়। গোটা ছবিতে নিজের মুন্সিয়ানার সাক্ষর রেখেছেন অভ্র।

বড় বাজেট ছবির মতো ঢক্কানিনাদ নেই। প্রায় নিঃশব্দে, কোনও ঝকঝকে বাণিজ্যিক প্রচার ছাড়াই হাতে গোনা কয়েকটি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছে অভিনন্দনের ছবি। যেখানে বহু তারকা সম্বলিত ছবি পঞ্চাশজনের বেশি দর্শক পায় না, সেখানে প্রায় পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে ‘মানিকবাবুর মেঘ’ (Manikbabur Megh) কিছুটা হলেও বাংলা সিনেমার প্রতি ভরসা ফিরিয়ে দেয় বই কী। উপরি পাওনা অভিনয়ের মাস্টারক্লাস।




Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *