ঝকঝকে দার্জিলিং, মন ভালো করা রিইউনিয়ন
ছবি: আবার কাঞ্চনজঙ্ঘা
পরিচালনা: রাজর্ষি দে
অভিনয়ে: কৌশিক সেন, শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়, অর্পিতা চট্টোপাধ্যায়, তনুশ্রী চক্রবর্তী, গৌরব চক্রবর্তী, রাহুল বন্দ্যোপাধ্যায়, পদ্মনাভ দাশগুপ্ত, রূপঙ্কর বাগচী, রিচা শর্মা, বিদীপ্তা চক্রবর্তী, প্রিয়াঙ্কা পাল, দেবলীনা কুমার, সোহিনী গুহ রায়, অসীম রায়চৌধুরী, রনিতা দাস, অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায় ও দেবশ্রী গঙ্গোপাধ্যায়
দৈর্ঘ্য: ২ ঘন্টা ৩২ মিনিট
RBN রেটিং: ৩/৫
সিনেমা হোক বা সিরিজ়, ইদানিংকালে মানুষের জীবনের কালো, অন্ধকার দিকগুলোকে পর্দায় তুলে ধরার একচেটিয়া প্রয়াসে দর্শকদের একাংশ উৎসাহী হলেও, অনেকে সেই একই কারণে ক্লান্ত। সুস্থ স্বাভাবিক পারিবারিক জীবনেও সমস্যা, অশান্তি, জটিলতা, হিংসার কালো মেঘ ঘনিয়ে আসা অস্বাভাবিক নয়। তবে সেই নিয়েও যে একটা নিটোল গল্প বলা যেতে পারে তা আজকাল কম পরিচালকই মনে রাখেন। বহুদিন পর সেরকমই এক মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারের আপাত সাধারণ কিছু টানাপোড়েনের গল্প বলার চেষ্টা করলেন রাজর্ষি। প্রেক্ষাপটে রইল শৈলশহর দার্জিলিং।
দেব পরিবারের পাঁচ সন্তান। ত্রিদিব (কৌশিক), সুদেব (পদ্মনাভ), সেমন্তী (অর্পিতা), দেবেশ (রাহুল) আর রোহিত (গৌরব)। পরিবারের বড়ছেলে ও বড়বউ যেমন হয় ত্রিদিব ও রিনি (বিদীপ্তা) সেরকমই। আলাদা থাকলেও সকলকে আগলে রাখার চেষ্টা করে। যদিও ছেলে সুনয়নের (অনিন্দ্য) সাম্প্রতিক গাড়ি দুর্ঘটনা নিয়ে দুজনেই বেশিমাত্রায় চিন্তিত। সুদেবের মেয়ে ঋতজার (রনিতা) সমস্যা নিয়ে সবসময়েই টেনশনে থাকে তার মা ঋতাঙ্গনা (দেবশ্রী)। দেবেশ বাংলার রাজনীতিতে পরিচিত নাম। সে দেহরক্ষী নিয়ে ঘোরে। স্ত্রী রুচিরার (তনুশ্রী) সঙ্গে তার বিয়েটা প্রেমের হলেও, তাতে এখন ভাটার টান। ছোটছেলে রোহিত (গৌরব) মুম্বইয়ে স্ক্রিনরাইটার। দেব পরিবারের একমাত্র মেয়ে সেমন্তী (অর্পিতা) বাড়ির অমতে সুমিত্রকে (শাশ্বত) বিয়ে করে দিল্লি প্রবাসী। এদের সকলের মধ্যে খুব একটা যোগাযোগ হয় না। তাই বড়দিনে ত্রিদিবের উদ্যোগে সকলে মিলে দার্জিলিংয়ের বাড়ি অভিলাষে বেড়াতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এই বাড়িকে ঘিরেই গল্প শুরু। নস্টালজিয়া ও পারিবারিক রিইউনিয়নের আনন্দের মাঝেই উঠে আসে নানা অপ্রীতিকর প্রসঙ্গ। রোহিতের নব্য বিবাহিতা স্ত্রী অ্যাঞ্জেলিনার (দেবলীনা) আগমনে প্রাথমিকভাবে সকলে খুশি হলেও, সমস্যা আরও জটিল হয়ে ওঠে বাড়ি বিক্রি নিয়ে চার ভাইয়ের মতবিরোধে। হতাশ হয় সেমন্তী, সে অনেক আশা নিয়ে এসেছিল এ বছরের বড়দিন এখানে কাটাবে বলে। এই হলো আপাতদৃষ্টিতে দেব পরিবারের নিটোল গল্প।
তবু কিছু প্রশ্ন থেকে যায়।
সেমন্তী বহুবছর পর কলকাতার বাড়িতে পা রাখল। সুমিত্রকে কেউ সেভাবে চেনেই না। অথচ ঋতজা তার পিসেমশাইকে নিয়ে পাগল। যদি মেনেও নিই সফল সাংবাদিক সুমিত্রর দর্শন, চিন্তাধারা ও ভাবমূর্তি ঋতজাকে প্রভাবিত করে, তাহলে তা নিছকই হিরো ওয়ার্শিপ, এ বয়সে যা খুব স্বাভাবিক। এ ক্ষেত্রে ভক্তি ও মুগ্ধতা মিশে যায়। কিন্তু প্রেম তার থেকে অনেক আলাদা। যেখানে সেমন্তীর সঙ্গে ঋতজার দেখাই হলো সেই ছোটবেলার পর, তখন এমন তো হতে পারে না যে মেয়েটি শৈশব থেকেই পিসেমশাইকে দেখে আকৃষ্ট হয়েছে। তাহলে ঋতজার মা বা অন্যান্যরা এই সামান্য ব্যাপারকে এত সিরিয়াসলি নেবেন কেন?
আরও পড়ুন: বেহিসেবী জীবনযাপন, আজ স্মৃতির অতলে সৌমিত্র
দেবেশের বন্ধু দেবমাল্য (রূপঙ্কর) তার দ্বিতীয়া স্ত্রী ও মেয়ে আতিশাকে নিয়ে সকলের সঙ্গে দার্জিলিং যায়।দেবেশ তাদের আমন্ত্রণ জানায়নি। রুচিরার আমন্ত্রণেই তারা ছুটি কাটাতে যায়। এদিকে সুনয়নের সঙ্গে আতিশার বিয়ে দিতে দেবমাল্য এত ব্যস্ত কেন তার কোনও ব্যাখ্যা পাওয়া গেল না। সুনয়নের অতীত সকলেরই জানা, কারণ থানা পুলিশ কোর্টের কথা কয়েকবার সকলের মুখেই শোনা যায়। এরকম একটি ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে কেন কেউ দিতে চাইবে, তা পরিষ্কার নয়। বিশেষত আতিশা যেখানে সবে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ছে সেখানে পঞ্চাশের ওপর বয়সে দ্বিতীয়বার বিয়ে করা তার আধুনিক বাবা কলেজে পড়া মেয়ের কেরিয়ারের চিন্তা না করে বিয়ের জন্য তদ্বির করতে সটান দার্জিলিং চলে যাবে, এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়।
এছাড়াও যে দেবেশের নানা অদ্ভুত আচরণে বাড়ির সকলে বিরক্ত, সেখানে শুধু সে চায় না বলেই বাড়ির কেউ, এমনকি বড়ভাই ও বৌদিও বোনের সঙ্গে এতদিন কোনও যোগাযোগ করেননি, এটা ত্রিদিবের ভাবমূর্তির বিপরীতে দাঁড়ায়। উপরন্তু যে বাড়ির শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে দেবেশ বা রোহিত অভিলাষা বিক্রির পরিকল্পনার তীব্র প্রতিবাদ করে, সেই একই বাড়ির ছেলে হয়ে বড় দুই ভাইয়ের মধ্যে এই মূল্যবোধ দেখা যায় না। অথচ টাকার দরকার সকলেরই। ত্রিদিব তো ভাইবোনদের থেকে চেয়েও নিতে পারত। অভিলাষের সব ম্যাজিক আর মিরাকলের সাক্ষী হয়েও সে কীভাবে ওই বাড়ি বিক্রির কথা ভাবতে পারে? ছবির চিত্রনাট্যে এসব প্রশ্নের উত্তর নেই। শেষে গিয়ে পরিষ্কার হয় না সুদেবের সেই হারিয়ে যাওয়া বাক্স রহস্যও।
আরও পড়ুন: জটায়ুর সাহস
তবু সব মিলিয়ে দেব পরিবারের গল্প মন ছুঁয়ে যায়। তা যতটা না চিত্রনাট্যের জোরে, তার চেয়ে অনেক বেশি অভিনেতাদের মুন্সিয়ানায়, এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। শাশ্বত ও অর্পিতা দুজনেই এই ছবির প্রাণ। ছবির গল্প অনুযায়ী তো বটেই, অভিনয়েও দুজনেই মন জয় করবেন দর্শকদের। কোনও প্রশংসাই যেন এই দুজনের জন্য যথেষ্ট নয়। এছাড়া কৌশিক, বিদীপ্তা, পদ্মনাভ, অনিন্দ্য, রূপঙ্কর প্রত্যেকেই পর্দায় বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠেছেন।
তাঁর প্রথম ছবিতে দেবশ্রী যথেষ্ট ভালো কাজ করেছেন। অবাক করেছেন রনিতা। হাসি, কান্না, অভিমান, আদর, কষ্ট সবকিছুকে খুব সুন্দরভাবে নিজের বয়সের সমতুল্য করে তুলে ধরেছেন তিনি। অবাক করেছেন গৌরবও। নিজেকে ভাঙতে তাঁর এমন একটা ছকভাঙা ফ্রাস্ট্রেটেড চরিত্রই দরকার ছিল। চেনা গৌরবের খোলস ছেড়ে তাঁকে বার করে আনার কৃতিত্ব অবশ্যই তাঁর নিজের এবং পরিচালকের।
রাহুল এই ছবিতে দুর্দান্ত। বরাবরের সুঅভিনেতা রাহুলের চরিত্রটি মোটেও ভালো লোকের নয়, আর এখানেই তিনি বাজিমাত করেছেন। দুশ্চরিত্র দেবেশের ভূমিকায় তিনি সম্পূর্ণভাবে সফল। এরপরে দর্শক যদি তাঁকে ঘৃণাও করেন তবে তা সাফল্যেরই নামান্তর হবে। তনুশ্রী প্রতিবারেই অবাক করেন, এবারেও তার অন্যথা হয়নি। রুচিরাকে তাঁর থেকে আলাদা করা যায়নি কোথাও।
ছবির মূল বক্তব্য ভারী সুন্দরভাবে দেখিয়েছেন রাজর্যি। সমস্ত মিরাকল আর ম্যাজিক আসলে লুকিয়ে থাকে সম্পর্কের মজবুত বাঁধনে। তবে বড়দিনের পার্টিতে সেমন্তীর নিজে থেকে সুমিত্র ও ঋতজার হাত মিলিয়ে দেওয়াটা চোখে লাগে। সবসময় বোধহয় দুই আর দুই যোগ করে চার করে দেওয়া ভালো দেখায় না। মানুষ চলে গেলেই তার জায়গাটা পূরণ হয়ে যাবে এমনটা সব ক্ষেত্রে হয় না। জোর করে তা করাও যায় না।
আরও পড়ুন: নব্বইয়ের ‘সত্যান্বেষী’, বাদ পড়লেন ব্যোমকেশ
দার্জিলিং, কাঞ্চনজঙ্ঘা, ম্যাল, কেভেন্টার্স সবকিছু খুব সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে চিত্রগ্রহণে। ঝকঝকে সিনেমাটোগ্রাফি দর্শকের মন ভালো করে দিতে বাধ্য। ছবিতে খালি গলায় গান গেয়েছেন অর্পিতা ও বিদীপ্তা। দুজনেই সুগায়িকা, সুন্দর লেগেছে তাঁদের গানের মুহূর্ত।
ছবির গানগুলির মধ্যে অনুপম রায়ের গাওয়া ‘টয় ট্রেন’ শুনতে ভালো লাগে। জয়তী চক্রবর্তীর গাওয়া ‘দেখো সখা ভুল করে ভালবেসো না’ গানটি ছবির ওই মুহূর্তে অসাধারণ শুনতে লাগে। তনুশ্রী খুব সুন্দর লিপ দিয়েছেন গানটিতে। রূপঙ্করের গলায় ‘মেঘ বলেছে যাব যাব’ ছবির আবেগঘন মুহূর্তে এক অন্য অনুভূতি এনে দেয়। দর্শকাসনে বসে অনেকেরই চোখ ভিজে যেতে বাধ্য।
আরও পড়ুন: কলকাতায় কেতন-রাজ, ‘তদন্তে’ চিরঞ্জিত
সাবর্নী দাসের পোশাক পরিকল্পনা যথাযথ ও সময়োপযোগী। প্রত্যেককে দেখতে ভালো লেগেছে। বিশেষত অর্পিতা ও তনুশ্রীর থেকে যেন চোখ ফেরানো যায় না।
ছবির দৈর্ঘ্য আর একটু কম করা যেত। চাইলেই কিছু চরিত্রকে ছেঁটে ফেলে চিত্রনাট্যকে আরও একটু মেদহীন করা যেত। আড়াই ঘণ্টা দৈর্ঘ্য পারিবারিক গল্পের পক্ষে একটু বেশিই। তবে অবশ্যই ছবির ফিল গুড মুডের কারণে হাতে সময় থাকলে হলে গিয়ে মন ভালো করে আসাই যায়, এ ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই।