অনন্তকাল অপেক্ষা, অনিশ্চয়তাও

ছবি: অনন্ত

পরিচালক: অভিনন্দন দত্ত

অভিনয়ে: ঋত্বিক চক্রবর্তী, সোহিনী সরকার

দৈর্ঘ: ১ ঘণ্টা ৫০ মিনিট

RBN রেটিং: ৩.৫/৫

‘সখী, ভালোবাসা কারে কয়!
সে কি কেবলই যাতনাময়।’

ভালোবাসার খোঁজ চলছে সেই কোন যুগ থেকে। কারও কাছে এই অনুভূতি খুব সহজ, গড়িয়ে যাওয়া জলের মতো। আবার কারও কাছে তা কঠিন, কোনও মূক মানুষের মনের ভাব প্রকাশের চেষ্টার মতো। একমাত্র কবিরাই ব্যক্ত করতে পেরেছেন এই ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে কত শত আবেগের কথা। অথচ সেই সহজ ব্যাখ্যাগুলি দিতে মানুষ খুব চেনা কোনও রাস্তাতেও বারবার হোঁচট খায়। অভিনন্দন তাঁর প্রথম ছবির বিষয় হিসেবে এই ভালোবাসাকেই বেছে নিয়েছেন। তাঁর এই ভালোবাসার গল্পে জড়িয়ে আছে এক অনন্তকাল অপেক্ষা, অনিশ্চয়তাও। আছে কল্পনা, আছে সত্যও। আর এই সবকিছু দিয়েই তিনি বুনেছেন ‘অনন্ত’।



মা-বাবাকে হারিয়ে শুভ (ঋত্বিক) একা হয়ে যায়। সাতমহলা বড় বাড়ির নীচের তলায় এখন শুধু গোটা কতক ভাড়াটে। একটা দোকানে কাজ ছিল, অনভ্যাসে সেটাও গেছে। বাড়িজুড়ে এখন শুধু শুভর মায়ের টুকরো কিছু স্মৃতি, কয়েকটা ঝরা পাতা, ভোকাট্টা ঘুড়ি। বাড়ির পাশের ফাঁকা জায়গায় নতুন ফ্ল্যাটবাড়ি তৈরির কাজে আড়ম্বর, উড়ন্ত কয়েকটা পায়রা, আর মাঝেমধ্যে আসা একজন বন্ধু। জীবনে যেন শুভর কোনও তাড়া নেই। ঘুম ভাঙলে জানলা দিয়ে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা, ইচ্ছে হলে চা–খাবার খাওয়া, রান্না করা। শুভর বন্ধুও অবাক হয়ে জানতে চায়, সারাদিন বসে থাকতে-থাকতে ওর বিশেষ অংশে ব্যথা হয় কী না! তবে দিনে একটা নির্দিষ্ট সময় আসে, তখন শুভ রোদ্দুর ছুঁতে চায়, আনন্দ পায়, হাসে।

আরও পড়ুন: শেষের সেদিন, উপস্থিত ছিলেন শুধু মহেশ ও ড্যানি

গল্পের অন্য প্রান্তে আছে মিষ্টু (সোহিনী)।  স্কুলের চাকরি, মদ্যপ বাবা, মায়ের স্মৃতি, আর কল্পনার রোরো নদী, এইটুকুই তার জীবনের সম্বল। অবশ্য মিষ্টুর বাপের ইচ্ছে মাতাল বন্ধু সোমনাথের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেওয়ার। তা সে যতই মাতাল হোক, বাবা তো, মেয়ের প্রতি দায়িত্ব কী কম। কিন্তু ওই যে কল্পনার রোরো নদী, সেখানে পা ডুবিয়ে মিষ্টু ভাবতো মায়ের কথা। ‘মিষ্টু নদীতে যাস না, জলে পড়ে যাবি। মিষ্টু জঙ্গলে যাস না, হারিয়ে যাবি।’ তারপর হঠাৎ দরজায় জোরে কড়া নাড়ার শব্দ, নেশার ঘোরে বাবার চিৎকার. ‘এই মিষ্টু, বাথরুমে এতক্ষণ কী করছিস?’

এই দুটি মানুষের বাস্তবেও দেখা হয় রোজ। মিষ্টু যখন স্কুলে যায়, তখন শুভ বাড়ির দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে চা খায়। মিষ্টু যখন ফেরে তখন বিড়ি ধরিয়ে ট্রেন দেখতে যায় শুভ। কারও কোনও কথা থাকতো না একে অপরের সঙ্গে। তবু অনেক কথা থাকতো মনে-মনে। একমাত্র কল্পনাতেই ওরা সুখী। একজন নদী, অনেক গভীর। অন্যজনের জল নেই, চড়া পড়ে গেছে।

আরও পড়ুন: রাতের কলকাতায় বিপদের মুখে বনি-কৌশানি

বিষয় নির্বাচনে প্রথম ছবিতেই বড় ঝুঁকি নিয়েছেন অভিনন্দন। এ ছবিটা সর্বজনীন দর্শকের নয়। এই ছবির দর্শক পরিমিত, নির্দিষ্ট। হয়তো জেনেবুঝেই এগিয়েছেন পরিচালক। তবে অভিনেতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে তিনি মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। খুব বলিষ্ঠ অভিনয় দক্ষতা ছাড়া ‘অনন্ত’ হওয়া মুশকিল ছিল। সেক্ষেত্রে ঋত্বিক ও সোহিনীকে নিয়ে তিনি বাজিমাত করেছেন।

এই ছবি সংলাপ নির্ভর নয়। নিস্তব্ধতা, স্থির দৃষ্টি, কিছু সুর, শব্দও ছবিতে ভীষণ ভালো সংলাপের ভূমিকা নেয়। সেটাই করে দেখালেন অভিনন্দন। ছবির আবহসঙ্গীতের দায়িত্ব অসাধারণ সামলেছেন ময়ূখ-মৈনাক। সাউন্ড ডিজ়াইনে অনিন্দিত রায় ও আদীপ সিং মানকির দক্ষতাও কুর্নিশযোগ্য। না বলেও যে কত কথা বলা যায়, ‘অনন্ত’ তার অনবদ্য দলিল।

আরও পড়ুন: নির্বাক কৌশিক, বলবেন একা অপরাজিতাই

ছবিটির শুটিং হয়েছে উত্তর কলকাতা ও সিকিমের রোলেপে। কল্পনা ও বাস্তবের দৃশ্যগুলি খুব দক্ষতার সঙ্গে মেশানো হয়েছে। সেটা অনুভব করার জন্য দর্শককে বেশ ধৈর্য নিয়ে ছবিটি বুঝতে হবে। সময় দিতে হবে নিজেকে, জোর দিতে হবে কল্পনায়।

হয়তো এই কারণেই কিয়দাংশ দর্শকের মনে হতে পারে ‘অনন্ত’ বড্ড মস্তিষ্ক ঘেঁসা। সেটা ভুল নয়। কারণ ছবি বলতে মানুষের সাধারণ ধারণা বা বোধের থেকে ‘অনন্ত’ কিছুটা আলাদা। এখানে প্রেম অধিকাংশ কল্পনাতেই। সেই কল্পনাকে ছোঁয়ার অবকাশ দর্শকের হাতেই রেখেছেন পরিচালক। ছবিতে আবার যাকে বলে কাঁচা বাংলার ব্যবহারও আছে বিপ শব্দের পরিবর্তে। সেদিক থেকে ছবিটি যথেষ্ট সাবালক। তাই ভাবতে হবে, একটু ভাবা প্র্যাকটিস করে ছবিটি দেখতে যেতে হবে।

কল্পনার দরজা খুলে শুভ খুঁজে পেয়েছিল রোরো নদী। আর মিষ্টু?




Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Angana

A traveler and a lover with a musical heart. An avid reader and writer. Reads anything that falls on her hands. Has an analytical mind and is highly opinionated

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *