দক্ষিণে বড় পরিচালকেরা নিজের ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করে, কোন ছবি দেখবে: শাশ্বত
বাঙালির ঘরের ছেলে তোপসে হোক কিংবা পরবর্তীকালে লালবাজারের দুঁদে গোয়েন্দা শবর দাশগুপ্ত বা স্পেশাল অফিসার অনিমেষ দত্ত, সব চরিত্রেই বাজিমাত করেছেন তিনি। তবে ইদানিং বাংলার চেয়ে হিন্দি বা দক্ষিণী ছবিতে বেশি বিচরণ করছেন শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় (Saswata Chatterjee)। সম্প্রতি একটি বাংলা ছবিতে বেশ অন্যরকম এক চরিত্রে দেখা গেল তাঁকে। অন্যদিকে বড় বাজেটের দক্ষিণী ছবিতে কাজ করছেন কমল হাসান (Kamal Hassan), প্রভাস (Prabhas), দীপিকা পাড়ুকোনদের (Deepika Padukone) সঙ্গে। এই মুহূর্তে বাংলা ছবির বাজার থেকে শুরু করে অন্যান্য সর্বভারতীয় কাজ নিয়ে মন খুলে কথা বললেন শাশ্বত। শুনল রেডিওবাংলানেট
মানসীদির (সিংহ) ‘এটা আমাদের গল্প’ ছবিতে মিঃ শর্মার চরিত্রটা তুমি নাকি নিজে থেকেই করতে চেয়েছিলে?
শাশ্বত: এই চরিত্রটা আসলে আমার খুব পছন্দ হয়েছিল। বয়স্ক চরিত্র তো আগেও করছি। অঞ্জনদার (দত্ত) ছবিতে বাবার চরিত্র করেছি কত কমবয়সে। এছাড়াও একটা টেলিফিল্মে আমি কুশল চক্রবর্তীর বাবা হয়েছিলাম। কাজেই সেটা কোনও নতুন ব্যাপার নয়। কিন্তু এই চরিত্রের একটা জিনিস আমার ভালো লেগেছিল যে বয়স যাই হোক না কেন আমার জীবনটা আমার। সমাজ কী ভাববে ভেবে বসে থাকলে চলবে না, আমার যেটা ভালো লাগবে আমি সেটাই করব। কারণ আমার জীবনটা কীভাবে কাটবে সেটা সমাজ ঠিক করে দেবে না। এই ব্যাপারটা আমার খুব পছন্দ হয়েছিল চিত্রনাট্য পড়ে। সেজন্যই করতে চেয়েছিলাম।
তার মানে এত ছবিতে এতরকম ভূমিকায় অভিনয় করার পরেও এখনও কিছু নতুন ধরনের চরিত্রে রয়ে গেছে যা তুমি করতে চাও
শাশ্বত: হ্যাঁ নিশ্চয়ই। যেমন অনেক বছর ধরে একজন মূক ও বধিরের চরিত্রে অভিনয় করতে চাইছি। কিন্তু কেউ এরকম চরিত্র দিচ্ছে না। সেখানে এত কথা বলতে হতো না। শুধু এক্সপ্রেশন দিয়ে সম্পূর্ণ অভিনয়টা করতে পারতাম। জানি না পাব কিনা।
ইদানিং তুমি বাংলায় কম কাজ করছ আর হিন্দি বা দক্ষিণী ভাষার ছবিতে বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছ, এমন একটা কথা শোনা যাচ্ছে
শাশ্বত: একেবারেই না। বরং বাংলা থেকে আমি সেই কিকটা পাচ্ছি না। যে ধরনের চরিত্রে এখন এখানে আসছে তাতে বছরে পাঁচ-ছ’টা করে ছবি কে ‘না’ বলতে হচ্ছে কারণ সেগুলো পছন্দ হচ্ছে না। আসলে এই ইন্ডাস্ট্রিতে টাকাপয়সা এত কমে গেছে যে বড় প্রযোজকেরা একসঙ্গে না এগোলে ভালো কিছু হবে না।
আরও পড়ুন: বায়োপিক নয়, পরিচালক মৃণাল সেনকে পাওয়া যাবে অঞ্জনের ছবিতে
পুজোর সময় বা নতুন বছরে একইসঙ্গে তিনটে বা চারটে করে বড় ব্যানারের ছবি মুক্তি পাচ্ছে এখন। এটাকে কী বলবে?
শাশ্বত: বড় প্রযোজকেরা একে অপরের দর্শক কাটছে এছাড়া আর কীই বা বলব! অনেকে বলেন যার যে ছবি ভালো লাগবে সে সেটা দেখবে। কিন্তু আগে আমরা কত টাকা দিয়ে একটা ছবি দেখতাম আর আজ সেই খরচটা কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে সেটাও তো ভাবতে হবে। মাল্টিপ্লেক্সে গিয়ে একাধিক ছবি দেখার সামর্থ্য কতজন মানুষের আছে? আমি নিজে এমন মানুষ দেখেছি যারা বলছে ছেলেমেয়েরা যদি নিয়ে না যায়, এত দাম দিয়ে টিকিট কেটে মাল্টিপ্লেক্সে যাওয়া সম্ভব নয়। আবার কেউ সরাসরি বলে দিচ্ছে এত টাকা দিয়ে সিনেমা দেখতে পারেব না। তাও একটা ছবি যদি বা দেখা যায়, চারটে দেখা কখনওই সম্ভব নয়। তার ওপর আছে পপকর্ন আর কোল্ড ড্রিংকের খরচ। এর সঙ্গে রয়েছে পার্কিংয়ের খরচ। বিক্রি বাড়াবার জন্য আড়াই ঘণ্টার ছবির মাঝে একটা আধঘণ্টার ব্রেক! ফলে পার্কিং বেড়ে ৪ ঘণ্টা হয়ে যাচ্ছে। এখন এগুলোই আসল ব্যবসা, ছবির চেয়েও বড় হয়ে গেছে এগুলোই। একটা ছবির টিকিটের দামের চেয়ে আনুষঙ্গিক খরচ হয়ে যাচ্ছে মধ্যবিত্তের সাধ্যের বাইরে। যারা ইন্ডাস্ট্রি চালান বলে মনে করেন তাদের একটু ভেবে দেখা দরকার।
তাহলে কি বাংলার চেয়ে ভালো চরিত্রের অফার বাইরে থেকেই পাচ্ছ?
শাশ্বত: পাচ্ছি বলেই তো করছি। অনেক হিন্দি ছবিও আমি না করেছি। ‘কহানী’র (Kahaani) পর টানা চারবছর আমি হিন্দিতে কাজ করিনি। ‘জগ্গা জাসুস’ (Jagga Jasoos) করি তার চারবছর পর। রনবীর কপুর (Ranbir Kapoor) আমাকে প্রথম দেখায় জিজ্ঞাসা করেছিল, দাদা চার সাল লাগ গয়া দুসরা হিন্দি পিকচার করনে মে, আফটার বব বিশ্বাস! আমি ওকেও বলেছিলাম সমস্যাটা। আমি যদি সেই সময় নওয়াজ়উদ্দিন সিদ্দিকির মতো একটানা ২৬টা ছবিতে সই করতে পারতাম, তাহলে ব্যাপারটা অন্যরকম হতো। কিন্তু তখন অনেক চরিত্রই আমার পছন্দ হয়নি। তখন সরাসরি না বলতে পারতাম না। বলতাম, ডেট নেই। আর কিছু ছবির ক্ষেত্রে সত্যিই ডেট ছিল না কারণ বাংলায় অনেকগুলো কাজ শেষ করতে হতো।
আরও পড়ুন: আবারও কানে ‘মন্থন’
‘জগ্গা জাসুস’-এর দ্বিতীয় ভাগ কি আসবে এবার?
শাশ্বত: ওটা অনেক বড় ছবি হবে। তাই এক্ষুণি হচ্ছে না। পরে হবে। এখন ‘মেট্রো ইন দিনো’র কাজ চলছে। জগ্গা একটা ফেয়ারি টেল ছবি ছিল। কম মানুষ দেখেছেন, কিন্তু যারা দেখেছেন এবং বুঝেছেন তারা জানেন ওটা কী। একটা ছবি যে স্ক্রিপ্ট ছাড়া হতে পারে, এটা না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। পুরো ছবিটা অনুরাগের (বসু) মাথায় ছিল। চিত্রনাট্য ধরে কাজ করার দরকারই পড়েনি। এই ছবিতেও তাই করছে ও। এবার গিয়ে দেখলাম সিনের আগে ও সংলাপ লিখে দিচ্ছে। অদ্ভুত একটা মানুষ। ওর মাথাটা খুব পরিষ্কার।
‘রকি এন্ড রানী’ ছবিতে টোটাদার (রায়চৌধুরী) অভিনীত চরিত্রে কাজ করার প্রস্তাব প্রথমে তোমার কাছে এসেছিল
শাশ্বত: হ্যাঁ। যশরাজ ফিল্মসের শানু শর্মা আমাকে ফোন করে জানালেন, করণ জোহর আপনাকে চাইছেন। আমি তো শুনেই লাফিয়ে উঠেছিলাম। জিজ্ঞাসা করলাম, চরিত্রটা কীসের। উনি বললেন একটাই চাহিদা, কথক ত্থক নাচতে হবে। আমি বললাম, আমার ভেতরে নাচ জিনিসটাই নেই তো কত্থক কী করে করব? উনি বললেন, আপনি দেড় মাসের ট্রেনিং করলেই পারবেন। আমি বললাম, এটা ক্লাসিক্যাল ড্যান্স, এটা ভেতরে না থাকলে আসা অসম্ভব। কোন ছোট্টবেলা থেকে ক্লাসিক্যাল ড্যান্স শিখলে তবে সেটা পারফর্ম করা যায়। এটা আমি পারব না।
অপরাজিতা আঢ্যর সঙ্গে
ছবিটা এতবড় হিট হলো। কোথাও কি একটু আফসোস রয়ে গেল?
শাশ্বত: একটুও না। আমি টোটার জন্য ভীষণ খুশি। ওর এই দিকটা যেভাবে সামনে এল, এখানে তো কেউ ওকে এরকম চরিত্রে ভাবেইনি। দারুণ করেছে ও কাজটা। আমি ওর জন্য গর্বিত।
ইদানিং বড় অভিনেতারা অনেকেই রাজনীতিতে আসছেন। তুমি কখনও ভেবেছ ব্যাপারটা নিয়ে? তুমি চাইলে নিশ্চয়ই নির্বাচনে টিকিট পেয়ে যেতে
শাশ্বত: কেন পাব না! আমাকে তো সেন্ট্রাল থেকে অনুরোধও করেছিল। মিঠুনদা (চক্রবর্তী) পর্যন্ত বলেছিল, তুই একবার হ্যাঁ বললেই আমি সব ব্যবস্থা করে দেব। কিন্তু ওটা আমি বুঝি না। আমি মনে করি সবকিছুর একটা প্রস্তুতি লাগে। তোপসে দিয়ে শুরু করে তারপর আমি ধীরে-ধীরে অজিত বা তারও পরে শবর দাশগুপ্ত হতে পেরেছি। একদিনে কেউ আমাকে এই চরিত্রগুলো দেয়নি। সেরকমই রাজনীতির কিছুই না শিখে না জেনে আমি ভোটে দাঁড়িয়ে যাব! এটা হয় নাকি? এখানেও সকলে জানে আমি রাজনীতির লোক নই। আমার সকলের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক। কিন্তু কেউ জোর করেনি আমাকে রাজনীতিতে আসতে। কারণ ওটা আমাকে দিয়ে হবে না।
আরও পড়ুন: হাতাহাতির গল্প শোনালেন অপরাজিতা
সম্প্রতি ‘কল্কি’ (Kalki) ছবিতে কমল হাসানের সঙ্গে কাজ করলে যেটা তোমার স্বপ্ন ছিল। কেমন লাগল?
শাশ্বত: ওটা স্বপ্নই। প্রথম দেখা হতে যখন পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলাম শুধু মুখ নড়তে দেখলাম, শুনতে পাইনি কিছু। পরে জানলাম উনি বলেছেন, অ্যায়সা মত করো। এতই কম কথা বলেন উনি! ওঁর প্রতি ওদের গোটা ইন্ডাস্ট্রির যে সম্মান সেটা ভাবা যায় না। কমলজি শুট করবেন, প্রভাস সেদিন শুটিং দেখবে বলে সারাদিন সেটে বসে রইল। এটা এখানে আমরা ভাবতে পারি! এখানে আমরা অভিনেতারা একে অপরের ছবিই দেখে উঠতে পারি না। ‘আরআরআর’-এর ‘নাটু-নাটু’ অস্কারের স্টেজে পারফর্ম করা হবে, এ খবর যখন এল, সেই মুহূর্তে কাজ থামিয়ে ওখানে গানটা চালিয়ে গোটা ইউনিট এক রাউন্ড নেচে নিল। ওটা কিন্তু ওদের ছবি নয়। তবু নিজেদের ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে কী পরিমাণ গর্ব আর ভালোবাসা ওদের মধ্যে আছে ভাবতে পারবে না! ওখানে তো বড় পরিচালক নিজের ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করে, কোন ছবি দেখবে। ওখান থেকে ওরা বুঝতে পারে সাধারণ মানুষ কোন ছবিটা দেখছে। সেই ড্রাইভারকে নিয়েই ছবিটা দেখে আসেন তিনি। এই পারস্পরিক সম্মান যেখানে আছে সেই ইন্ডাস্ট্রি এগোবে না তো কে এগোবে?
বাংলার এই মুহুর্তের কাজগুলো নিয়ে কী বলবে?
শাশ্বত: এখন তো তবু কিছু ভালো কাজ হচ্ছে। ‘প্রজাপতি’ বা ‘টনিক’-এর মতো কাজ হয়েছে এখানে। কিন্তু ছবিগুলোকে তো চলতে দিতে হবে। সেই সুযোগটাই থাকছে না।
আরও পড়ুন: সত্যজিতের আরও দুটি ছবি সংরক্ষণের কাজ শুরু
কী ধরনের ছবি বেশি হওয়া দরকার মনে হয়, ক্লাস নাকি মাস?
শাশ্বত: আগে মাস, তারপর ক্লাস। ক্লাস ছবি করার জন্য অর্থ মাস থেকেই আসবে। সাধারণ মানুষ প্রেক্ষাগৃহে না গেলে একটা ক্লাস ছবির জন্য টাকা আসবে কোত্থেকে? আর সিনেমা মানে তো বিনোদন। এমন তো নয় যে সকলে ফেস্টিভ্যালের ছবি ছাড়া দেখেন না। একটা সিনেমা এসেছে সেটা শুধু বিনোদনের জন্যই দেখব, এই ব্যাপারটাই এখন হারিয়ে গেছে। সবাই অপেক্ষায় থাকে কবে ওটিটিতে আসবে তখন দেখব। ভালো ছবি হলে, সেই ছবি যদি হিট করে, দর্শক ঠিকই আসবেন। সবার আগে সেরকম ছবি তৈরি করতে হবে।
কল্কিতে দীপিকার সঙ্গেও কাজ করলে কিছুদিন আগে। সেই অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
শাশ্বত: ওর সঙ্গে আমার এবারেও একসঙ্গে সিন ছিল। সেই সূত্রে রনবীর সিংয়ের সঙ্গেও আলাপ হয়ে গেল। ও পুরো পাগল ছেলে, বউয়ের শুটিং দেখতে এসেছে। নিজেই এগিয়ে এসে হ্যান্ডশেক করল। বলে নাকি বিগ ফ্যান আমার! দীপিকার সঙ্গে কাজের ব্যাপারে আর কী বলব, ওর সঙ্গে কী না করেছি আমি এই ছবিতে! চুলের মুঠি ধরে টেনে নিয়ে যাওয়া থেকে অত্যাচার করা সব। কিন্তু একটুও রেগে যায়নি তার জন্য। আমি তো এই ছবির খলনায়ক। যে আসল ভিলেন ছিল সে আমাকে মেরে দিয়েছিল। ওরা সেখান থেকে চিত্রনাট্য পাল্টে আমাকে আবার বাঁচিয়ে তুলল, আর যে আমাকে মেরেছিল, তাকে মেরে দিল। আমি হয়ে গেলাম মেন ভিলেন। দীপিকা সারাদিন বসে থাকত, কখন তার শট হবে কেউ জানে না। আমার শট হয়ে যাচ্ছে পরের পর। ওকে কেউ ডাকছে না। সেই নিয়ে কোনও তাপ উত্তাপ নেই। চুপচাপ বসে আছে সারাদিন এসে। সকাল সাড়ে দশটায় এসে প্রথম শট দিচ্ছে বিকেল পাঁচটায়। ওরা এরকমই। সাংঘাতিক প্রোফেশনাল।
দক্ষিণী ছবিতে কাজ করতে গিয়ে ভাষা নিয়ে কতটা সমস্যায় পড়লে? ম্যানেজ করলে কীভাবে?
শাশ্বত: সে এক সাংঘাতিক সমস্যা! প্রতিটা সংলাপের মানে আর উচ্চারণ ওরা ইংরেজিতে লিখে দিচ্ছে ঠিকই কিন্তু তাতে তো বুঝতে পারছি না কোন শব্দের কী অর্থ! আমার সহকারী যে ছিল, সেই ছেলেটিকে আমি মেকআপ ভ্যানে ডাকতাম। ওকে বলতাম, তুমি এই সংলাপটা বললে কীভাবে বলতে দেখাও। কারণ ডায়লগের কোন জায়গায় জোর দিতে হবে সেটা তো আমাকে জানতে হবে। আমি প্রথমেই বলেছিলাম, ওদের ভাষা আমি একটুও জানি না এভাবে অভিনয় করব কী করে! ওরা বলল, আপনার এক্সপ্রেশনটা আমাদের চাই। ভাষা কোনও সমস্যা হবে না। কিন্তু তবু, হিন্দিতে অভিনয় করার সময় তো জানি আমি কী বলছি। দক্ষিণের ভাষা সত্যিই খুব কঠিন। এরপর এরকম কাজ এলে সত্যি দু’বার ভেবে দেখব।