আমার নিজের পছন্দের অনেক কিছুই ‘অথৈ’-এ মিশে রয়েছে: অর্ণ

উইলিয়ম শেক্সপিয়রের ট্র্যাজেডি মানেই ষড়রিপুর খেলা, লোভলালসার লীলাভূমি, ক্ষমতা দখলের সংঘর্ষ। পৃথিবীর বহু ভাষায় সেইসব নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে। বাংলায় দীর্ঘদিন ধরে ‘ওথেলো’ অবলম্বনে মঞ্চে অভিনীত হয়ে চলেছে ‘অথৈ’। অর্ণ মুখোপাধ্যায়ের (Arna Mukherjee) পরিচালনায় মঞ্চ থেকে পর্দায় এসেও তার জয়যাত্রা অটুট রয়েছে। জুনে মুক্তি পেয়ে এখনও  প্রেক্ষাগৃহে ছবিটি দেখতে ভিড় করছেন দর্শক। ‘অথৈ’কে মঞ্চ থেকে পর্দায় নিয়ে আসার কারণ কী ছিল? এক বৃষ্টির দুপুরে অ্যাকাডেমির গ্রিন রুমে টিম রেডিওবাংলানেট-এর মুখোমুখি হলেন অর্ণ

প্রশ্ন: শেক্সপিয়রের নাটককে অনেকে অনেকভাবে ব্যাখ্যা এবং উপস্থাপন করেন, ‘ওথেলো’কেও করা হয়েছে। ‘অথৈ’ করার সময় তুমি এই আদিবাসী প্রেক্ষাপট কেন বেছে নিলে? 

অর্ণ: ছবিটা আমার ‘অথৈ’ নাটক থেকেই করা। এই নাটক যখন লেখা হয় তখন রোহিত ভেমুলার ঘটনাটা সদ্য ঘটে গেছে। এখন যেমন ট্রেন দুর্ঘটনা জ্বলন্ত ইস্যু, কাগজে বারবার এই নিয়ে লেখালেখি চলছে, এরকম এক একটা সময় আসে যখন বিশেষ কোনও ইস্যু গুরুত্ব পায়। সেই সময় দলিত ইস্যু নিয়ে নানারকম কথা উঠে আসছিল। সেই চিন্তাভাবনা থেকে ‘অথৈ’ লেখা। তবে আজকের দিনেও এটা কিছু কম প্রাসঙ্গিক নয়। অনেকের ধারণা পশ্চিমবঙ্গে প্রচুর সংস্কৃতিমনষ্ক মানুষ বাস করেন তাই এখানে এরকম কিছু নেই। কিন্তু আমি রিসার্চ করতে গিয়ে বুঝেছি, বর্ণবাদ বা জাতপাতের এই ব্যাপারগুলো জন্মের আগে থেকে আমাদের রক্তে রয়ে গেছে। আমরা মানি বা না মানি, আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে সেটা আছে। এটাকে এক অর্থে সভ্যতার জেনেটিক ডিসঅর্ডার বলা যায়।



প্রশ্ন: কিন্তু এখানে দলিত ইস্যুকে দেখাতে গিয়ে একজন দলিতকেই ভিকটিম হিসেবে দেখানো হচ্ছে, যে কিনা এই পরিমাণ শিক্ষিত হয়েও শেষে গোগোর হাতের খেলার পুতুল হয়ে ওঠে। এই গল্প একজন প্রান্তিক মানুষকে সাহস দেওযার বদলে তো আরও ধাক্কা দেবে

অর্ণ: সেটা আমার দায় নয়। আমি আমার মতো করে গল্প বলব। আমি মনে করি আমার মেধা, মনন, বুদ্ধি এই সবকিছুর দায় আমার নিজের কাছে। আমি যেভাবে অ্যাপ্রোচ করতে চাইব, সেভাবেই করব। সেটা কাকে কীভাবে আঘাত করছে সেটা দেখা আমার কাজ নয়। বরং এই গল্প আমার মনে হয় প্রান্তিক মানুষের পক্ষেই বলা। একজন স্বতন্ত্র মানুষের অপরাধকে শুধুমাত্র তার অপরাধ বলা চলে না। এখানে সমাজ বা পরিস্থিতির ভূমিকা অনেকটাই তাকে নিয়ন্ত্রণ করে। আমার শিক্ষায় বা বেড়ে ওঠায় যদি নীতিবোধ থাকে তাহলে সেটা আমাকে এমনিতেই নিয়ন্ত্রিত করবে। গল্পের মাধ্যমে করতে হবে না। 

প্রশ্ন: অভিনয়ের ক্ষেত্রে ছবিতে দু’রকম স্টাইল রয়েছে। একটা তো অবশ্যই নাটকের স্টাইল, অন্যটা হলিউডি। প্রায় প্রতিটি দৃশ্যে এই দুটো জিনিস ঘুরেফিরে আসে। বিশেষ করে গোগোর চরিত্রে অনির্বাণের (ভট্টাচার্য) অভিনয়ে ব্যাপারটা আরও স্পষ্ট। এই হলিউডি ধারাকে কি সচেতনভাবেই রাখা হয়েছে? 

অর্ণ: একদম তাই। আমার নিজের পছন্দ বা ভালোলাগার অনেক কিছুই এই ছবিতে মিশে রয়েছে। একটু অন্যভাবে বোঝাই, আমি যেমন মদ্যপান করি না। ছবিতে অথৈও সেটাই বলছে। এমন নয় যে সব ছবিতেই আমি আমার নিজস্ব নীতিবোধ চরিত্রের সঙ্গে মিলিয়ে দিচ্ছি। এ ক্ষেত্রে সেটা হয়ে গেছে। কিন্তু সব ছবির ক্ষেত্রে এমনটা নাও হতে পারে। যেমন আমি ছোটবেলা থেকে হলিউড ছবির ভক্ত। মার্টিন স্করসেসে থেকে ক্রিস্টোফার নোলান, আমি এদের ছবির অন্ধ-ভক্ত বলতে পারো। এমনকি ‘ডার্ক নাইট’, মানে ব্যাটম্যান ট্রিলজি এবং জোকারের যে অবস্থান, সেই একই জিনিষ আমি এখানেও খুঁজে পাই। 

আরও পড়ুন: ‘সোলজার ২’-এর সম্ভাবনা, থাকবে কি প্রিটি-ববি জুটি?

প্রশ্ন: ‘ওথেলো’ নাটকে সবথেকে উল্লেখযোগ্য বিষয় হিসেবে কোনদিকটার কথা তুমি বলবে, যেটা এই নাটককে বেছে নেওয়ার অন্যতম কারণ বলা যায়

অর্ণ: আমার মতে ‘ওথেলো’ শেক্সপিয়রের লেখা অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাটক। এমনকী আমি ‘হ্যামলেট’-এর থেকেও ‘ওথেলো’কে এগিয়ে রাখব। দুর্ঘটনাকে সমাপতন হিসেবে দেখাবার যে জাস্টিফিকেশন এই নাটকে আমি পেয়েছি, তেমন আর কোথাও পাইনি। এই যে ওথেলো চক্রান্তের আঁচ পেয়েও শেষ পর্যন্ত সন্দেহকেই বয়ে নিয়ে বেড়ায়, এই যে ডেসডিমোনা বিনা প্রতিবাদে সবকিছু মেনে নেয়, এগুলো দুর্ভাগ্য ছাড়া তো আর কিছু নয়। আর এখানে শুধুমাত্র ওথেলো বা অথৈ এবং দিয়ার ট্র্যাজেডি নয়, তার চেয়েও বড় এটা ইয়াগো বা গোগোর ট্র্যাজেডি। এমনকী রাদু, মুকুল, মিলি সকলেরই ট্র্যাজেডি। জীবন থেকে এরা যা চেয়েছে কেউই পায়নি। এমনকি ডিউক অর্থাৎ ডেসডিমোনার বাবা যে ওই সন্দেহের বীজ পুঁতে দিয়ে যায়, সেও তো যন্ত্রণার কারণেই বলছে যে ও তোমার সঙ্গেও এটাই করবে।  

প্রশ্ন: কিন্তু যে ভুল সপ্তদশ শতাব্দীতে ডেসডিমোনা করছে, সমস্ত অপবাদ মেনে নিয়ে, সেই একই ভুল ২০২৪-এ দিয়া কেন করবে? একবারও সে কোনও প্রতিবাদ করবে না? 

অর্ণ: দেখো, দিয়া একজন রুচিশীল শিক্ষিত মানুষ। সে এতটাই অভিমানী যে শেষ দিন অবধি কখনও মুখ ফুটে বলছে না যে তুমি আমাকে ভুল বুঝছ। বড়জোর বলবে, মুকুলের সঙ্গে আমি শুয়েছি কিনা জানতে চাইছ তো? অথৈয়ের ওপর তার এতটাই আস্থা যে ফোনের লকও সে নিজেই খুলে দেয়। বুঝতে পারছে অথৈ ওকে সন্দেহ করছে কিন্তু নিজেকে সে নামতে দেয়নি শেষ অবধি। ডেসডিমোনা অত্যাচারিত ছিল, কিন্তু এখানে দিয়া ভিকটিম। অত্যাচারিত নয়। এমনিতে ও কিন্তু সিঁদুর পরে না, শেষদিন সেটাও পরেছে। কোথাও সে বুঝতে পারছে সব শেষ হয়ে আসছে। ওই শেষ অপেক্ষাতেই সেটা স্পষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু নিজেকে সে ছোট করেনি। 

আরও পড়ুন: চলচ্চিত্র উৎসবে নয়া ভূমিকায় প্রসেনজিৎ?

প্রশ্ন: ছবিতে বারবার কাকতাড়ুয়ার একটা রেফারেন্স এসেছে। এটা কি অথৈয়ের দিদিমার মৃত্যু বা ছোটবেলার কোনও ট্র্যাজেডিকে ফিরিয়ে আনে ওর কাছে? 

অর্ণ: শেক্সপিয়রের সমস্ত লেখায় ভুডুইজ়মের একটা প্রচণ্ড প্রভাব রয়েছে। সেই কারণেই ওটাকে একটা মেটাফর হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। যেটা একটা দুঃস্বপ্নকে বোঝায়। অথৈ আর গোগোর প্রথম ধূমপান, প্রথম খারাপ ছবি দেখা, মানে সমাজের চোখে যা কিছু অনৈতিক সেই সবকিছুর শুরু ওই কাকতাড়ুয়ার সামনে, সেটাই ওকে তাড়া করে বেড়ায়। 

প্রশ্ন: বিশাল ভরদ্বাজের ‘ওমকারা’, যেটা ‘ওথেলো’ অবলম্বনে, সেখানে ডলি বা ডেসডিমোনাকে যে উপহার দেওয়া হচ্ছে সেটা একটা কোমরবন্ধ, যেটা গল্পের প্রধান অনুঘটক হয়ে ওঠে। মূল গল্পে সেটা ছিল একটা রুমাল। উত্তর ভারতীয় সংস্কৃতিতে কোমরবন্ধের মতো গয়না খুব স্বাভাবিক লেগেছিল দেখতে। অথচ অথৈ দিয়াকে তার মায়ের সেলাই করা রুমাল দিচ্ছে। এটা আদিবাসী প্রেক্ষাপটে কতটা যুক্তিযুক্ত? 

অর্ণ: আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই এটা রেখেছি। আমি জানতাম এই প্রশ্নটা উঠবেই। এরকম একজন মহিলাকে আমি নিজে দেখেছি সেলাই করতে। রুমাল সেলাই হয়তো নয় কিন্তু শৌখিন সেলাই করতেই দেখেছি ওইরকম দলিত প্রজাতির এক মহিলাকে। সেখান থেকেই আমার মাথায় এসেছিল ব্যাপারটা। কাজেই সেটা স্বাভাবিক একটা বিষয়। 

আরও পড়ুন: ‘রামায়ণ’-এ কুণাল কপূর

প্রশ্ন: যেহেতু ছবিটা নাটক থেকে করা তাই দেখতে বসে মনে হয় অথৈ দিয়ার বাড়িটাকে স্টেজ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে কারণ প্রায় সমস্ত উল্লেখযোগ্য ঘটনাই ঘটছে এই বাড়ির সামনে। এছাড়া ছবির ভাষা অনেকটাই নাটকের মতো, সিনেমার মতো নয়। এটা কেন? 

অর্ণ: না শুধু বাড়িটা নয়, বরং পুরো ভিনসুরাকেই আমি স্টেজ হিসেবে ব্যবহার করেছি। যে কারণে আমি অন্য কোনও চরিত্র দেখাইনি। আর এখানে নাটকের ভাষা নয়, সিনেমার ভাষা দিয়েই ছবিটা তুলে ধরেছি তার কারণ যে মুহূর্তে ক্যামেরা চলে আসে, সেটা আর নাটক থাকে না। নাটকে একটা বাড়ি দেখানো মানে হয়তো সেই বাড়ি দিয়ে আমি অন্য কিছু বোঝাতে চাইছি, যেখানে কল্পনা করার একটা জায়গা থাকছে দর্শকের জন্যে। কিন্তু সিনেমায় বাড়ি মানে বাড়িই। অন্যান্য সমস্ত কিছুই আমাকে বুঝিয়ে দিতে হবে। এখানে নাটক নেই, শুধু সিনেমাই আছে। 

প্রশ্ন: এতবার মঞ্চে অভিনয় করা নাটক নিয়েই ছবি করতে ইচ্ছে হলো কেন? অন্য কোনও গল্পও তো আসতে পারত। নাটককে সিনেমায় পরিবর্তিত করতে গিয়ে চিত্রনাট্যের কাজ কতটা চ্যালেঞ্জিং ছিল? 

অর্ণ: কোনও কারণ সেভাবে ছিল না। ইচ্ছে হয়েছিল এটা নিয়ে ছবি করার তাই করেছি। তবে চিত্রনাট্য লেখার কাজটা বেশ কঠিন ছিল। যেহেতু প্রথমবার করেছি তাই সেটা অবশ্যই চ্যালেঞ্জিংও। পরে মনে হয়েছে আমি যেভাবে করতে চেয়েছিলাম সেটা হয়তো পুরোটা পারিনি। 

আরও পড়ুন: সঞ্জয় দত্তের ভিসা জটিলতা, শুটিং নিয়ে অনিশ্চয়তা

প্রশ্ন: ‘অথৈ’ তিনঘণ্টার নাটক। সেখানে ছবিতে আড়াই ঘণ্টার মধ্যে পুরো ব্যাপারটা আনতে হয়েছে। দৈর্ঘ্য কমাতে অসুবিধা হয়নি? 

অর্ণ: দৈর্ঘ্য কমানোর কোনও চেষ্টাই করিনি আমি। চিত্রনাট্যও যেমন পুরোটা লিখেছি সেভাবে শুটিংও পুরোটাই করা হয়েছে। ছবির দৈর্ঘ্য অনুযায়ী রেখে পরে কিছুটা অংশ বাদ দেওয়া হয়েছে। সেটা হয়তো পরে ওটিটিতে ছবিটা এলে আবার জুড়ে দেওয়া হবে। 

প্রশ্ন: ‘ওমকারা’তেও ছবির প্রেক্ষাপট ছিল গ্রাম এবং গল্প সেখানকার অশিক্ষিত গ্রাম্য লোকজনকে নিয়ে। সেখানে অথৈ একজন ডাক্তার। কিন্তু সে থাকে এমন একটা গ্রামে যেখানে ভালো হাসপাতাল নেই। ওথেলোর গল্পই কি তাহলে গ্রাম্য প্রেক্ষাপট দাবি করে? 

অর্ণ: না, এমন একেবারেই নয় যে গ্রামের প্রেক্ষাপট ছাড়া ছবিটা করা যেত না। অনায়াসে শহরেও করা যেতে পারত। আসলে আমি নিজে শহরতলীতে বড় হয়েছি। গ্রামকে মফস্বল হয়ে উঠতে দেখেছি, মফস্বলকে শহর হয়ে উঠতে দেখেছি। সেই কারণেই গ্রামের প্রেক্ষাপটে করার কথা মনে হয়েছিল। এছাড়া অন্য কোনও কারণ ছিল না। 

ছবি: RBN আর্কাইভ




Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Swati

Editor of a popular Bengali web-magazine. Writer, travel freak, nature addict, music lover, foody, crazy about hill stations and a dancer by passion. Burns the midnight oil to pen her prose. Also a poetry enthusiast.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *