অলিন্দ যুদ্ধের তিন নায়ক স্মরণে
ছবি: ৮/১২
পরিচালনা: অরুণ রায়
অভিনয়ে: কিঞ্জল নন্দ, অর্ণ মুখোপাধ্যায়, রেমো, শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়, খরাজ মুখোপাধ্যায়, গুলশনারা খাতুন, অনুষ্কা চক্রবর্তী, শঙ্কর দেবনাথ, দেবরাজ মুখোপাধ্যায়, সুস্নাত ভট্টাচার্য
দৈর্ঘ্য: ১ ঘণ্টা ৩৮ মিনিট
RBN রেটিং: ৩.৫/৫
দিনটা ছিল ৮ ডিসেম্বর, ১৯৩০। পরপর গুলির শব্দে হঠাৎই কেঁপে উঠল শহর কলকাতার প্রাণকেন্দ্র রাইটার্স বিল্ডিংস চত্বর। তিন অকুতোভয় তরুণ বিপ্লবীর গর্জে ওঠা পিস্তলের সামনে ততক্ষণে লুটিয়ে পড়েছেন ইন্সপেক্টর-জেনারেল লেফটেন্যান্ট কর্নেল এনএস সিম্পসন। রাইটার্স মুড়ে রাখা ব্রিটিশ পুলিশ কি ছেড়ে দেবে? ছুটল পাল্টা গুলি। শুরু হলো এক অসম লড়াই, ইতিহাসের পাতায় যা ‘অলিন্দ যুদ্ধ’ নামে পরিচিত। একসময় গুলি ফুরিয়ে গেলে শহীদ হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন বিনয় বসু, বাদল গুপ্ত ও দীনেশ গুপ্ত। একজন কামড় বসাল পকেটে রাখা পটাশিয়াম সায়ানাইডের ক্যাপসুলে, অন্য দুজন কপালে বন্দুক ঠেকিয়ে চাপ দিল ট্রিগারে।
ছবির শুরু মাস্টারদা সূর্য সেনের চট্টগ্রাম অভিযানের ঘটনার পর। চট্টগ্রামসহ বাঙালি বিপ্লবী ও গুপ্তদলের আখড়া হিসেবে মার্কামারা জায়গাগুলোয় চিরুনিতল্লাশী চালাচ্ছে পুলিশ। সামান্যতম সন্দেহ হলেই তুলে নিয়ে যাচ্ছে তরুণ-তরুণীদের। নারী-পুরুষ ভেদাভেদ না করে অকথ্য অত্যাচার চালাচ্ছে ব্রিটিশ শাসক। এই ভয়ঙ্কর অত্যাচারের কান্ডারী ইন্সপেক্টর লোম্যান। একের পর এক অপরাধের ফলে শিশুপালের মতোই তারও পাপের ঘড়া পূর্ণ হতে মৃত্যুদণ্ডের সাজা শোনায় বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের গুপ্ত আদালত। এই কাজের জন্য হেমচন্দ্র ঘোষ (শাশ্বত) ও তাঁর সহবিপ্লবী সুখময় (শঙ্কর) বেছে নেন মেডিক্যাল কলেজে পাঠরত তরুণ বিনয়কে (কিঞ্জল)।
আরও পড়ুন: বিলুপ্তির পথে টোটো, ঢাকায় রাজাদিত্যর নতুন তথ্যচিত্র
এদিকে মেজর গুপ্তর (দেবরাজ) তৎপরতায় ব্রিটিশদের মনে ভয়ের জন্ম দিতে সক্ষম হয়েছে অন্যান্য বিপ্লবীরা, যাদের মধ্যে বাদল (অর্ণ) অন্যতম। লোম্যান হত্যার পর কিছুটা বিনয়েরই ইচ্ছায় রাইটার্সে ঢুকে সিম্পসনকে হত্যা করার পরিকল্পনা করা হয়। সঙ্গী হিসেবে বিনয় পেয়ে যায় দুই ‘মারতে অথবা মরতে ভয় না পাওয়া’ বিপ্লবী বাদল ও দীনেশ (রেমো)। তার পরের কাহিনী সকলেরই জানা।
বিপ্লবী হেমচন্দ্র বলেছিলেন, সশস্ত্র বিপ্লবের দুটি ধাপ হয়। প্রথম ধাপে ক্ষেত্র প্রস্তুত করা হয়, এবং পরের ধাপে বিপ্লব সংঘটিত হয়। এই কথাটিকে মাথায় রেখেই ‘৮/১২’-এর চিত্রনাট্য লিখেছেন অরুণ । প্রথমার্ধে রয়েছে ব্রিটিশ শাসকের তীব্র অত্যাচার ও তৎকালীন ভারতের আর্থসামাজিক দুরবস্থার ছবি। এই অর্ধে অনেকটা বিপ্লবের আগুন পুঞ্জিভূত করার কাজটি করেছেন অরুণ। দ্বিতীয়ার্ধে সেই বিপ্লব রূপ পেয়েছে রাইটার্স অভিযানে। ব্রিটিশ শাসকের নখ-দাঁত বের করা নগ্ন, ভয়ঙ্কর রূপ তুলে ধরেছেন পরিচালক। শোনা যায় হেমেন গুপ্ত পরিচালিত ‘৪২’ ছবির খলনায়ক বিকাশ রায়কে দেখে জনৈক দর্শক জুতো ছুঁড়ে মেরেছিল। ‘৮/১২’-তেও রাজনৈতিক বন্দীদের ওপর, বিশেষ করে মহিলাদের ওপর ব্রিটিশ পুলিশের নির্যাতন পর্দায় বেশিক্ষণ সহ্য করা যায় না। মুখ ফিরিয়ে নিতে হয় অন্যদিকে। শুধু কানে আসা শব্দেই বুকটা যেন মুচড়ে ওঠে। তার কয়েকটি দৃশ্য পরেই বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের গোপন সভায় সেই অত্যাচারী শাসককে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হলে দর্শকও যেন মনে-মনে সেই সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেন।
ছবির মূল তিন চরিত্রে কিঞ্জল, অর্ণ এবং রেমোর কাজ যথাযথ। তবু কয়েকটি দৃশ্যে বাদলরূপী অর্ণ যেন বাকিদের ছাপিয়ে গিয়েছেন। বরাবারের মতোই নজর কেড়েছেন শাশ্বত। টানটান উত্তেজনার এই ছবিতে কমিক রিলিফের জন্য এক বিশেষ চরিত্রে কিছুক্ষণের জন্য পর্দায় দেখা যায় খরাজকে। তাঁর পর্ব শেষ হতে সত্যিই মনে হয় অ্যাড্রেনালিনের জন্য এই কমিক রিলিফের প্রয়োজন ছিল।
অভিনয়ে বিশেষ উল্লেখের দাবী রাখেন শঙ্কর এবং কমলার ভূমিকায় গুলশনারা। এছাড়া, মেটিয়াবুরুজে যে সরযূ দেবীর বাড়িতে বিনয় জীবনের শেষ ক’টা দিন কাটানোর গল্প লোকের মুখে-মুখে ফেরে, সেই চরিত্রে অনুষ্কাকে ভালো লাগে। সুভাষচন্দ্র বসুর ভূমিকায় সুস্নাতকে আরও কিছুক্ষণ পর্দায় পেলে ভালো লাগত।
আরও পড়ুন: শেষের সেদিন, উপস্থিত ছিলেন শুধু মহেশ ও ড্যানি
রাইটার্সে অলিন্দ যুদ্ধের মতো ঘটনাকে নিয়ে ছবি হলেও কাহিনীকে দীর্ঘায়িত করেননি অরুণ। দৈর্ঘ্যে কম হলেও তা দর্শকের মনে দাগ কাটতে সক্ষম। তবে বিশেষ উল্লেখের দাবী রাখেন ছবির প্রোডাকশন ডিজ়াইনার তন্ময় চক্রবর্তী। প্রায় ১০০ বছর আগের কলকাতাকে তিনি যথাযথভাবে পুনর্নির্মাণ করেছেন। ১৯৩০-এ ব্যবহৃত গাড়িঘোড়া থেকে শুরু করে পথঘাট, সবকিছুই নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছেন। এছাড়া অলিন্দ যুদ্ধের সময়কার দৃশ্যায়নও অত্যন্ত চমৎকার। ছবির জন্য যথাযথ আবহ প্রয়োগ করেছেন সৌম্যঋত। রূপম ইসলামের গলায় ছবির শীর্ষসঙ্গীত ও অরিজিৎ সিংয়ের কণ্ঠে ‘স্বাধীন হবে দেশ’ শুনতে ভালো লাগে। সংলাপ ভৌমিকের সম্পাদনা ও গোপী ভগতের ক্যামেরা ছবিকে আরও বেশি বাস্তব করে তোলে। এই ছবিতে সূত্রধর তথা কথকের ভূমিকায় রয়েছেন সব্যসাচী চক্রবর্তী। তাঁর ব্যারিটোন ছবিতে একটি আলাদা মাত্রা যোগ করে।
আরও পড়ুন: শেষ যাত্রায় ব্রাত্য, পথ হেঁটেছিলেন মাত্র কয়েকজন
তবে অলিন্দ যুদ্ধের শেষে, তিন বিপ্লবীর পরিণতি কার্ডে না দেখিয়ে বিনয় ও দীনেশের শেষের সময়টুকু অন্তত দেখানোই যেত।
স্বাধীনতা সংগ্রামে সশস্ত্র বিপ্লবের অন্যতম বিখ্যাত অধ্যায়, বিনয়-বাদল-দীনেশের রাইটার্স অভযান নিয়ে ছবি করেছেন অরুণ। অনেক আগেই এই নিয়ে ছবি হওয়া উচিত ছিল। তবু শেষ পর্যন্ত যে হলো, তার জন্য পরিচালককে সাধুবাদ।