নায়ক শহর কলকাতা

ছবি: শাহজাহান রিজেন্সি

পরিচালনা: সৃজিত মুখোপাধ্যায়

অভিনয়ে: আবির চট্টোপাধ্যায়, স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, অঞ্জন দত্ত, মমতা শংকর, অনির্বাণ ভট্টাচার্য, রুদ্রনীল ঘোষ, পল্লবী চট্টোপাধ্যায়, কাঞ্চন মল্লিক, সুজয় প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, রিতিকা সেন

দৈর্ঘ্য: ২ ঘন্টা ৩৬ মিনিট

RBN রেটিং: ৩/৫

‘He that goes soonest has the least to pay.’ যে লাইনগুলো লেখককে তার চৌরঙ্গী উপন্যাস লিখতে প্রেরণা দিয়েছিল, সেই লাইনগুলোই শোনা গেল সমীরণ ওরফে স্যাম বোসের গলায়। শুরুতেই পরিচালক তার মূল চরিত্র রুদ্রর মুখ দিয়ে বলিয়ে নেন এই গল্প চৌরঙ্গীর নয়, বরং বলা যায় চৌরঙ্গীর মত। তাই চৌরঙ্গীকে, মানে উপন্যাস  ও ১৯৬৮ সালের একই নামের ছবি, উভয়কেই মাথা থেকে সরিয়ে রেখে দেখা উচিত এই ছবি। তাতে একটাই সুবিধা হল, পুরোনো ছবির ব্যাগেজটা আর থাকে না। যে কোনও ছবি নতুন করে তৈরি হলে, সেটি দেখতে যাওয়ার সময় নিজের সঙ্গে একটা আপোষ করে নেওয়া জরুরী। নাহলে নতুন ছবিটা দেখার কোনও মানে হয় না। তবু তুলনা আসবে, আসবেই। বাঙালি নস্টালজিক জাত, তারা পুরোনো ছবিটাকে সামনে রেখে কাটাছেঁড়া করবে না, এমন তো হতেই পারে না।




ছবির প্রেক্ষাপট পাল্টালে নাম পাল্টানোটাও জরুরী ছিল। তাই শঙ্কর হলেন রুদ্র, স্যাটা হলেন স্যাম, অনিন্দ্য হল অর্ণব, করবী হলেন কমলিনী, ন্যাটাহরি হলেন নিটিগ্রিটি আর গোমেজ় হলেন গায়ত্রী। তবে মার্কোপোলো থেকে মকরন্দ করার সময় অঞ্জন দত্তকে মাথায় রেখে বিদেশী প্রেক্ষাপটটা হয়ত না পাল্টালেও চলত। কারণ অঞ্জন ওই প্রেক্ষাপটেই সাবলীল। ধুতি পাঞ্জাবি পরে ‘আয়ে না বালম’ গাওয়াটা তার পক্ষে বেশ বেমানান লাগলো। তবে মকরন্দরূপে সাজপোশাকে একটু অনভ্যস্ত লাগলেও অঞ্জন আবারও প্রমাণ করলেন তিনি যেমন তেমন অভিনেতা নন। ইদানিং নানান চরিত্রে নিজেকে যেন নতুনভাবে মেলে ধরার একটা জেদ দেখা যাচ্ছে তাঁর মধ্যে। মকরন্দ-মালার গল্পটা আর একটু পরিষ্কার হলে ভাল লাগত। শেষ অবধি সেটা অসম্পূর্ণ রয়ে গেল।

যে মৃত্যু আজও রহস্য

ছবিতে সাততারা হোটেলের ঝাঁ চকচকে ব্যাপারটা বেশ প্রতিয়মান। তবে হোটেল কর্মচারীরা সাধারণত আরও বেশি সাজানো হাসি ও ঝকঝকে কথাবার্তা পেশ করতে অভ্যস্ত। এখানে সেই ব্যাপারটা একটু যেন হালকা। পল্লবী যেটুকু পর্দায় এসেছেন চরিত্রের প্রয়োজন মিটিয়েছেন। 

মমতা শংকরকে অভিনন্দন এমন সাহসী একটি চরিত্রে অভিনয়ের জন্য। অভিনন্দন সৃজিতকেও, এই চরিত্রে ওঁর মত একজন জাত অভিনেত্রীকে বেছে নেওয়ার কথা ভাবার জন্য। একদিকে সোনাগাছির ওয়েলফেয়ারের চিন্তা অন্যদিকে রাতের অন্ধকারে শাহজাহান রিজেন্সিতে অভিসারিকারূপে যাতায়াত, এই দুই বিপরীতমুখী রূপকে অসম্ভব ভালভাবে ফুটিয়েছেন মমতা। ঋতুপর্ণার চরিত্রটির প্রয়োজনীয়তা খুব একটা না থাকলেও নিজ অভিনয় গুণেই তিনি রেশ রেখে গিয়েছেন। 

তিন মূর্তি ও পায়ের তলায় সরষে

ভালো লেগেছে কাঞ্চনকেও। এই ধরণের চরিত্রের প্রতি ঠিক যতটা ঘৃণা জন্মানো উচিত ঠিক সেই অনুপাতেই তিনি নিজেকে মেলে ধরেছেন ধেনো বা ধনঞ্জয়ের চরিত্রে। বরুণের চরিত্রে রুদ্রনীল নিজেকে আবারও এক শক্তিশালী চরিত্রাভিনেতারূপে প্রমাণ করলেন।

এবার নিটিগ্রিটি। এখানেও সৃজিতের অভিনন্দন প্রাপ্য। নিতাই ব্যানার্জীর চরিত্রে সুজয়কে ভেবে বাঙালিকে অনেক কিছু শেখালেন তিনি। সুজয় তার সবকটি দৃশ্যে অনবদ্য। নিজের মত করেই চরিত্রকে ছাপিয়ে গেছেন তিনি। ছবির শেষে যে কজন ছাপ রেখে যান সুজয় তার অন্যতম। পুরুষ সমকামী মানেই যে তারা পুরুষ দেখলে ঝাঁপিয়ে পড়েন না, এ কথা বাঙালি সমাজকে এত স্পষ্ট করে কেউ কখনও বুঝিয়েছেন বলে মনে হয় না। খুব অল্প কথায় নিটিগ্রিটি বুঝিয়ে দিয়েছেন মধ্যবিত্ত বাঙালির এবার সেকেলে ধ্যানধারণা ছেড়ে একটু বড় হওয়া প্রয়োজন। ভাল লাগলো বাংলা ছবি প্রাপ্তবয়স্ক হচ্ছে দেখে।

রক্তবরণ মুগ্ধকরণ

কমলিনী গুহ ওরফে স্বস্তিকার অভিনয় ক্ষমতা নিয়ে কিছু বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে চেহারায় বয়সের ছাপটা যেন একটু বেশীই চোখে পড়ে। বলিউড যদি চরিত্রের প্রয়োজনে ওজন বাড়াতে বা কমাতে পারে, তাহলে আমরা পারি না কেন? গল্পে করবীকে কোথাও পরিষ্কারভাবে দেহোপজীবিনী বলা হয়নি। তার কাজটাও সেই যুগের নিরিখে হয়ত তেমন ছিল না। কিন্তু এখানে শুরুতেই সেটা পরিষ্কার করে দেওয়া হল। বাঙালিকে একটু বেশি সাহসী করে দেবার জন্য কি? কমলিনী চরিত্রের গভীরতাকে প্রত্যাশা মতই রূপ দিয়েছেন স্বস্তিকা। সঙ্গে নামী ওয়েব সিরিজ় থেকে বাদ পড়ার রাগও পুষিয়ে নিয়েছেন ‘দুপুর নাতজামাই’-এর প্রসঙ্গ এনে।

অনির্বাণ ওরফে অর্ণব সরকার, অল্প সময়ের জন্য এসে এত সহজে চরিত্রের সঙ্গে মিশে গেলেন যা সত্যিই প্রশংসার যোগ্য। অনির্বাণ তার চোখকে কাজে লাগিয়ে অনেক কঠিন চরিত্রকে সহজ করে নেন, এই জিনিস আবার দেখা গেল। যদিও চরিত্রটির স্বচ্ছতার অভাব দেখা গেল কয়েক জায়গায়। একটা গোটা ক্রিকেট টিম কেনার সমস্ত দায়িত্ব তার মা বাবা তার কাঁধে দিলেন, যে কিনা ব্যবসা সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানে না। আবার যার চরিত্রে এত গভীরতা, যে এত দিকে ছড়িয়ে পড়তে চায়, ট্র্যাভেলগ লিখতে চায়, ছবি তুলতে চায়, গিটার বাজাতে চায়, অমন উদ্দাম প্রেমে পাগল হয়ে ব্যবসায়িক সভায় নিজের বিয়ের ঘোষণাও করে ফেলে, সে কি করে প্রেমিকার মৃত্যুর পরে আবার হাসিমুখে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে পারে?  যে চরিত্র এমন অসাধারণ আবেগে ‘কিচ্ছু চাইনি আমি’র মত গান গাইতে পারে, তার কাছে আর একটু নির্ভীকতা আশা করাই যেত।

সত্যজিৎ ও রেলভূত

এবার মূল দুই চরিত্র। স্যাম বোসের ভূমিকায় আবির। গল্পে যিনি গোটা হোটেলের প্রাণ, সেই অভিনেতার চলাবলায় আরও একটু প্রাণ আশা করি যায়। এমন সুদর্শন একজন অভিনেতা যত তাড়াতাড়ি নিজের নামের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসে চরিত্র হয়ে উঠবেন বাঙালির প্রাপ্তির ভাঁড়ার তত তাড়াতাড়ি ভরে উঠবে। সুপ্রীতা মিত্রকে (রিতিকা) কোনওভাবেই আবিরের সঙ্গে মানানসই লাগেনি। আর শহরের অভিজাত হোটেলের রিসেপশনিস্টকে বাইরের দুনিয়ায় নিয়ে যেতে হলে তাকে সাজগোজের শিক্ষা দিতে হয় এটা ঠিক মানা যায় না।

সবশেষে রুদ্রর চরিত্রে পরমব্রত, যিনি নিজেকে বাঙালি মধ্যবিত্তের মুখপাত্র বলে বর্ণনা করছেন, অর্থাৎ ‘নো উচ্চাকাঙ্ক্ষা, নো চটকদারী, নো লোভ।’ কিন্তু তাই বলে বাঙালিকে টেকসই বোঝাতে গিয়ে যে আরশোলার সঙ্গে তুলনা দিলেন সেই চরিত্র এত নড়বড়ে কেন? ছবির সিংহভাগ জুড়ে পরম ভীতু ও আত্মবিশ্বাস শূন্য এক ইন্টার্ন হয়ে রয়ে গেলেন। অথচ তিনি এই কাজে যোগ দেওয়ার আগে, শাড়ি আইসক্রিম অ্যাকোয়াগার্ড থেকে শুরু করে নানান জিনিসের সেলসম্যানশীপে দক্ষ ছিলেন। অর্থাৎ পুরোদস্তুর বেচুবাবু। যে কাজে আত্মবিশ্বাসটাই মূলধন সেখানে ওনার সাদামাটা আনস্মার্টনেস বেশ চোখে লাগলো। ছবির শেষে যে পরমব্রতকে দেখা গেল সেই চেহারাটা আরও একটু আগে দেখা গেলে ছবিটা আরও বিশ্বাসযোগ্য হত। 

শেষে এটাই বলার, কালজয়ী উপন্যাস বা কাল্ট ছবি ফিরিয়ে আনার দুঃসাহস বেশ কয়েকবার দেখালেন সৃজিত। এইজন্য তাঁর ধন্যবাদ প্রাপ্য। তবে ১৯৬৮ সালের ছবিটি যাঁরা দেখেছেন, তাঁদের তুলনায় উপন্যাসটির পাঠক সংখ্যা স্বাভাবিক কারণেই অনেক কম। চৌরঙ্গীর নায়ক একা স্যাটা বোস নন। একটা গোটা শহরের উচ্চকোটির মানুষের খোলনলচে ঘেঁটে দেখেছিলেন শংকর। তাঁর উপন্যাসের নায়ক শহর কলকাতা । এই দ্বিতীয় কাজটিই করলেন সৃজিত।

Amazon Obhijaan



Like
Like Love Haha Wow Sad Angry
11

Swati

Editor of a popular Bengali web-magazine. Writer, travel freak, nature addict, music lover, foody, crazy about hill stations and a dancer by passion. Burns the midnight oil to pen her prose. Also a poetry enthusiast.

One thought on “নায়ক শহর কলকাতা

  • খুব সাবলীল এবং সুন্দর বিশ্লেষণ !!! যাঁরা ছবিটি দেখেননি বা দেখার অবকাশ পাননি, তাঁদের জন্য এই লেখাটি আপাতদৃষ্টিতে অনুভব করার জন্য যথেষ্ট।

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *