মনে করিয়ে দেয়, আরও বেঁধে থাকা প্রয়োজন
ছবি: ৫ নং স্বপ্নময় লেন
পরিচালনা: মানসী সিংহ
অভিনয়ে: চন্দন সেন, খরাজ মুখোপাধ্যায়, অপরাজিতা আঢ্য, অর্জুন চক্রবর্তী, অন্বেষা হাজরা, পায়েল মুখোপাধ্যায়
দৈর্ঘ্য: ২ ঘণ্টা ৬ মিনিট
RBN রেটিং ★★★★★★★☆☆☆
স্বপ্ন! শব্দটার একটা ভার আছে বৈকি। প্রত্যেকদিন নতুন সূর্যের সঙ্গে এ শহরও যেন নতুন স্বপ্ন নিয়েই সকাল দেখে। একটা আবেগী, পরিপাটি মন থাকলেই স্বপ্ন নিয়ে বাঁচা যায়। ঠিক যেমনটা ‘৫ নং স্বপ্নময় লেন’ (5 No. Swapnomoy Lane)। মানসী সিংহের দ্বিতীয় ছবি জুড়ে শুধুই স্বপ্নের মায়াজাল।
উত্তর কলকাতার এক যৌথ পরিবারের ছবি দিয়েই শুরু ‘৫ নং স্বপ্নময় লেন’-এর ইতিকথা। বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণের ছবি এইসব যৌথ পরিবারে একটু অন্যরকম, বলা বাহুল্য। কিন্তু কীরকম? এই কংক্রিট আর ফ্ল্যাট কালচারের কালে আমরা মনে রেখেছি কী? ব্যস্ত জীবনের এই ইঁদুরদৌড়ে আমাদের কখনও কী মনে হয়নি সেই যৌথ দিনগুলোয় ফিরে যাওয়ার কথা? আমরা আদৌ কী নিজেদের মনের খোঁজ নিয়েছি? এইসব প্রশ্নের অবকাশ নিয়েই রাজপথে দাঁড়িয়ে ‘৫ নং স্বপ্নময় লেন’।
আরও পড়ুন: বাজিকা ভাষায় প্রথম ছবি, সেরা পরিচালকের পুরস্কার পেলেন আরিয়ান
চ্যাটার্জি পরিবার আর দি চ্যাটার্জি প্রেস, এই দুটি বিষয়ই ছবির মূলে। যে পরিবারটির অভিভাবক বড়দাদা। মায়ের জায়গা নিয়েছে বড়বৌদি। আর বাকি সবাই রয়েছে তাদেরই ভালোবাসার ছত্রছায়ায়। সেখানে বাদ যায় না পরিচারক সনাতন-শঙ্করী। যেখানে ঘরোয়া অনুষ্ঠানে বেজে ওঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত। বিশ্বকর্মা পুজোয় ছাদজুড়ে চাঁদিয়াল-ভোক্কাটায় মাতে বাড়ির কচিকাঁচারা। দুপুরের খিচুড়িভোগ সেরে চা-শিঙাড়ায় জমে ওঠে বড়দের সন্ধে। ঝলমলে এই পরিবারে অন্ধকার নেমে আসে বড়দার আচমকা মৃত্যুতে। এতকিছু কে সামলাবে বড়দার মতো করে? এই চিন্তা থেকেই নতুন বাঁকে এসে দাঁড়ায় চ্যাটার্জি পরিবার। যৌথপরিবার ভেঙে তৈরি হয় নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি। কিন্তু বাড়িটা? ওই স্বপ্নময় লেনটা? এতবড় একটা পরিবারের এতদিন ধরে একসঙ্গে থাকার সেইসব স্মৃতিরা? দুষ্টু (অন্বেষা) আর মিষ্টির (পায়েলপারিবারিক উকিলের) হাত ধরে কি স্বপ্নগুলো আবার এক হবে? কীভাবে হবে? সেই গল্পই বলবে মানসীর ছবি।
অভিনয়ে অন্বেষা ও পায়েল বেশ সাবলীল। তাদের শ্বশুর-শাশুড়ির চরিত্রে খরাজ ও অপরাজিতা নিঃসন্দেহে দাপুটে। পারিবারিক উকিলের চরিত্রে চন্দন ও তাঁর কৌতুকমাত্রা প্রশংসনীয়। একটি ক্যামিও চরিত্রে আছেন মানসী নিজে। তাঁর ও ফাল্গুনীর অভিনয় নজরকাড়া। তবু কোথাও যেন একটু অভাব থেকে যায়। হয়তো ৫১ জন নতুন শিল্পী এই ছবিতে একইভাবে নিজেদের সবটুকু উজাড় করে দিতে পারেননি। কিছুটা ফাঁক রয়ে গিয়েছে। ছবি কালেক্টিভ আর্ট বলে সেই ফাঁক একটু বেশিই চোখে পড়েছে।
আরও পড়ুন: বাস্তুচ্যুত প্রান্তজন, নর্মদা ‘পরিক্রমা’য় দেখালেন গৌতম
চিত্রনাট্য কোথাও-কোথাও আরও একটু জোড়ালো হলে ভাল হতো। হাত থেকে চলে যাওয়া সম্পত্তি অত সহজে কি ফেরত পাওয়া যায় আজকের যুগে? নাকি এককথায় কয়েক কোটি টাকা রোজগার করা যায়? এইসব সমীকরণ মেলাতে একটু যেন তাড়াহুড়ো করে ফেলেছেন পরিচালক।
তবে এই ছবি ট্যাবু ভাঙার কথা বলে নিঃসন্দেহে। না হলে আজকালকার দিনে ক’জন শাশুড়ি ভাবতে পারেন ক্যান্সার যোদ্ধাকে বৌমা করার কথা? ক’জন বৌমা পারে শাশুড়ির হাতে ছোটবেলার সেই হারমোনিয়াম ফিরিয়ে দিতে? বয়স্ক মানুষগুলো, যাদের কথা কেউ ভাবে না, তাদেরকে সঙ্গে নিয়েই জীবনের নতুন অধ্যায় লেখার কথা ক’জন ভাবে?
আরও পড়ুন: ২২ বছর পর মুক্তি পেতে চলেছে অনুরাগের ছবি
আবেগের বুনোট এ ছবিতে ভরপুর। সেই সবকিছু আরও প্রাণ পেয়েছে সুরকার জয় সরকারের সঙ্গীত আয়োজনে। ইমন চক্রবর্তী, অন্তরা মিত্র, লোপামুদ্রা মিত্র ও শ্রাবণী সেনের কন্ঠে প্রাণ পেয়েছে এই ছবির গান।
ছবির পরতে-পরতে জড়িয়ে আছে শহর কলকাতা। যার অনেকটাই চেনা। আরও বেঁধে থাকা প্রয়োজন, মনে করিয়ে দেয় ‘৫ নং স্বপ্নময় লেন’। সেজন্যই দর্শক হয়তো আরও বেশি করে জড়িয়ে যাবেন মানসী ও তাঁর দলবলের স্বপ্নে।