বহুদিন পর বাংলায় টানটান থ্রিলার
ছবি: চালচিত্র
পরিচালনা: প্রতিম ডি গুপ্ত
অভিনয়ে: পুষ্পরাগ টোটা রায়চৌধুরী, অনির্বাণ চক্রবর্তী, শান্তনু মাহেশ্বরী, ইন্দ্রজিৎ বসু, রাইমা সেন, স্বস্তিকা দত্ত, তনিকা বসু, প্রিয়া বন্দ্যোপাধ্যায়, জিয়াউল ফারুক অপূর্ব, ব্রাত্য বসু, দেবেশ চট্টোপাধ্যায়
দৈর্ঘ্য: ২ ঘণ্টা ৪ মিনিট
RBN রেটিং ★★★★★★★★☆☆
সত্যজিৎ রায় বলতেন, পর্দায় ‘হুডানইট’ গোত্রের কাহিনি দেখালে পরবর্তীকালে সেই ছবির গ্রহণযোগ্যতা কমে যায়, রিপিট ভ্যালু থাকে না। তবু সত্যজিৎ-ভক্ত থ্রিলারপ্রেমী বাঙালিই আবার ‘হানাবাড়ি’, ‘চুপি চুপি আসে’, ‘জিঘাংসা’, ‘চিড়িয়াখানা’, ‘বৈদুর্য রহস্য’-এর মতো ছবি একাধিকবার দেখে। তার অন্যতম কারণ ছবির নির্মাণ। অপরাধীর পরিচয় জানলেই গল্প শেষ হয় বটে, কিন্তু সেই পরিচয় জানাটাই গল্পের একমাত্র উদ্দেশ্য হয়ে থেকে যায় না। বরং ধাপে-ধাপে কীভাবে অপরাধীর কাছে পৌঁছনো গেল সেটাও সমান উপভোগ্য হয়ে ওঠে। প্রতিমের সাম্প্রতিক থ্রিলার ‘চালচিত্র’ (Chaalchitro: The Frame Fatale) ঠিক সেই কাজটাই করেছে।
ছবি সম্পর্কে একটু ধারণা দেওয়া যাক। হঠাৎ করেই কলকাতা শহরে একের পর এক মহিলা খুন হতে থাকে। এরা সকলেই অবিবাহিতা এবং একা থাকে। মৃত্যুর পরে খুনি মৃতদেহকে বেনারসি পরিয়ে, সাজিয়ে, চালচিত্রের মতো কোনও ফ্রেমে টাঙিয়ে রেখে যায়। এটাই খুনির সিগনেচার। লালবাজারের সুপারকপ সিপি কণিষ্ক চট্টোপাধ্যায় (টোটা) চমকে ওঠে খুনের প্যাটার্ন দেখে। পোড় খাওয়া ইন্সপেক্টর নাসেরের (অনির্বাণ) সঙ্গে কী যেন আলোচনা হয়, নতুন অফিসার রিতেশ (শান্তনু) বা বিশ্বরূপ (ইন্দ্রজিৎ) বুঝতে পারে না। এমন নৃশংস হত্যাকাণ্ড তারা আগে দেখেনি। কিন্তু কণিষ্ক দেখেছে কি? খুনের সূত্র পেতে অনেকটা বাধ্য হয়েই কণিষ্ককে পৌঁছতে হয় পাভলভ মানসিক হাসপাতালে।
বেশ কিছু থ্রিলার ছবি হুডানইট গোত্রের হয়েও শেষ পর্যন্ত দর্শকের মনকে টেনে নিয়ে যায় হোয়াইডানইটের দিকে। অর্থাৎ যেখানে অপরাধী কে জানার থেকেও বড় হয়ে দাঁড়ায় অপরাধের কারণ। সাহিত্যেও এরকম অজস্র উদাহরণ রয়েছে। বলা বাহুল্য উৎকৃষ্ট ক্রাইম থ্রিলার মানেই শুধু কে নয়, কেন জানা বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে কারণ একটা হত্যার পিছনে থাকতে পারে সুদূরপ্রসারী কোনও সামাজিক বা অর্থনৈতিক কারণ। এই কারণ বা মোটিভ একটার পর একটা হত্যাকাণ্ড ঘটে যাওয়ার জন্য কতটা যথোপযুক্ত, তা কঠিন হলেও অননুমেয় নয়। এই জায়গায় এসে বহু ছবির সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন জাগে যে মোটিভ কতটা জোরালো ছিল বা আদৌ তেমন পোক্ত ছিল কি না। এই ছবিতে দর্শকের হাতে তেমন কোনও সন্দেহ প্রকাশের অবকাশ দেননি প্রতিম। ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ডের পিছনে অপরাধীর মোটিভ এবং মোডাস অপারান্ডি (অপরাধ করার ধরন) দুটোই যথেষ্ট শক্তিশালী। এই দুটি যদি জমজমাট থ্রিলারের পূর্বশর্ত হয় তাহলে তৃতীয়টি অবশ্যই টানটান সাসপেন্স। এবং সেখানেও প্রতিম সফল। ঘটনার ঘনঘটা, ছোটখাটো সাবপ্লট সত্ত্বেও গল্পের মূল রাশ কখনও আলগা হতে দেননি তিনি।
আরও পড়ুন: বাজিকা ভাষায় প্রথম ছবি, সেরা পরিচালকের পুরস্কার পেলেন আরিয়ান
সাধারণত আধুনিক থ্রিলার ছবিতে করুণ রসের খুব একটা সুযোগ থাকে না। তবু এই ছবিতে পুতুল চরিত্রটি প্রায় একাই সেই কঠিন দায়িত্ব পালন করে আগাগোড়া। তনিকা বসুর অভিনয় প্রথম থেকে শেষ এতটাই মুগ্ধ করে যে বিশ্বাস হতে চায় না তিনি পর্দায় দেখা পুতুলের মতো বিশেষভাবে সক্ষম কেউ নন। তনিকার জন্য কোনও প্রশংসাই যথেষ্ট নয়। শান্তনুর রিতেশ চরিত্রটিকে শুরুতে মনে হয় একেবারেই আনকোরা নতুন, যাকে শেখাবার মধ্যে দিয়ে দর্শককেও শেখানো হবে তদন্তের খুঁটিনাটি। কিন্তু একইসঙ্গে ছোট-ছোট নানা জায়গায় ফার্স্ট বয় রিতেশের দক্ষতার সঙ্গে দর্শক একাত্মবোধ করতে থাকে। অবাঙালি চরিত্রে শান্তনুর স্বাভাবিক ভাঙা বাংলা শুনতে যেমন মিষ্টি লাগে তেমনই ভালো লাগে অপরাধীর অনুসন্ধানে তাঁর শরীরী ভাষা। বাংলা সেভাবে না জানলেও বাংলা ছবিতে শান্তনুর জায়গা হয়তো ভবিষ্যতেও থাকতে চলেছে।
ইন্দ্রজিৎ-প্রিয়ার রসায়ন বেশ ভালো। রহস্যের চাপ কাটাতে গল্পে এই রংবেরঙের চরিত্রগুলোর প্রয়োজন ছিল। স্বস্তিকা এবং রাইমা মূল দুই চরিত্রের বিপরীতে থেকে একে অন্যের চেয়ে আলাদা হয়েও গল্পের ব্যালান্স ধরে রাখেন। রাইমা শান্ত এবং কঠিন। স্বস্তিকা উচ্ছ্বল এবং সহজ। দুজনেই ছবিতে গুরুত্বপূর্ণ ভারসাম্য রেখেছেন। অপূর্বর চরিত্র ছোট। তবু এককথায় সত্যিই অপূর্ব তিনি। একই চরিত্রে থেকে কখনও সমবেদনা কখনও ঘৃণার উদ্রেক করা সহজ কাজ নয়। অপূর্ব সহজাত দক্ষতায় সামলে নিয়েছেন। উপরি পাওনা তাঁর গমগমে কণ্ঠস্বর। ছোট্ট চরিত্রে চমকে দিয়েছেন ব্রাত্য। স্বল্পসময় পর্দায় থেকেও নিজের দাপট বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি।
আরও পড়ুন: বাস্তুচ্যুত প্রান্তজন, নর্মদা ‘পরিক্রমা’য় দেখালেন গৌতম
এবার আসা যাক পুষ্পরাগের কথায়। আমরা যদিও টোটা নামেই ডাকতে অভ্যস্ত। তবু ইদানীং তিনি পোশাকি নামটাও ব্যবহার করছেন স্ক্রিনে, হিন্দি ছবিতে নিজের ছাপ রাখার পর থেকেই। তবে মেনে নিতে দ্বিধা নেই অভিনেতার নবজন্ম ঘটেছে। এমন নয় যে তিনি কয়েক বছর আগে এতটা দক্ষ ছিলেন না। তবে তাঁকে চিনে নেওয়া এবং উপযুক্ত চরিত্র দেওয়ার ক্ষেত্রে টালিগঞ্জ বরাবর কার্পণ্য করে এসেছে। টোটাকে এই ছবিতে দেখলে বোঝা যায় তিনি ছাড়া এই মুহূর্তে এই চরিত্রে কাজ করার আর কেউ ছিল না। বয়সোচিত অভিজ্ঞতা দিয়ে কণিষ্ক চরিত্রটিকে গড়ে নিয়েছেন টোটা।
এই ছবির আর এক চমক অনির্বাণের নাসের। ছবির পোস্টার দেখে মনে হতে পারে আবারও পুলিশের চরিত্রে অনির্বাণ। এই ভূমিকায় তো আগেও বহুবার দেখা গিয়েছে তাঁকে। ছবি দেখলে ভুল ভাঙবে। নাসেরের মতো চরিত্র হাজারে একটা তৈরি হয়। নাসের এবং পুতুলের মধ্যেকার প্রতিটি দৃশ্য দর্শকের স্মৃতিতে সম্পদ হয়ে থাকবে। যতটুকু পর্দায় থেকেছেন বড্ড বেশি মায়া রেখে গেছেন অনির্বাণ।
ছবির মেজাজের সঙ্গে মানানসই আলো, রং এবং সঙ্গীত। সম্পাদনাও যথাযথ। আসলে উপকরণের সবটাই ঠিকঠাক পরিমাপ মতো মিশিয়েছেন প্রতিম। তবে এ ছবির সবচেয়ে বড় উপকরণ অবশ্যই কাহিনি ও চিত্রনাট্য যা ছাড়া ভালো ছবি তৈরি করা যায় না। তবু এ কথা কম পরিচালকই বোঝেন।
বড়দিনের আবহে অনেকগুলো বাংলা ছবি মুক্তি পেয়েছে। তার মধ্যে প্রচারের জোরে অনেকটা এগিয়ে রয়েছে বেশ কিছু ছবি। সে তুলনায় ‘চালচিত্র’ একটু পিছিয়েই আছে বলা যায়। তবে ডিসেম্বরের শীতে সেরা থ্রিলার দেখতে চাইলে প্রচারের অপেক্ষায় না থেকে কাছাকাছি প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে এই ছবি দেখলে দর্শক ঠকবেন না, এ কথা হলফ করে বলা যায়।