শেষ গল্পে জমে গেল গেল তিনমূর্তির রসায়ন

সিরিজ়: ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি

সিজ়ন: ভূস্বর্গ ভয়ঙ্কর

পরিচালনা: সৃজিত মুখোপাধ্যায় 

অভিনয়ে: টোটা রায়চৌধুরী, অনির্বাণ চক্রবর্তী, কল্পন মিত্র, রজতাভ দত্ত, শাওন চক্রবর্তী, ঋদ্ধি সেন, দেবেশ চট্টোপাধ্যায়, অনিরুদ্ধ গুপ্ত

দৈর্ঘ্য: ২ ঘণ্টা ২৪ মিনিট (৬ পর্বে)

RBN রেটিং ★★★★★★★☆☆☆

বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ বলতে শুধুই পুজোগণ্ডাকে বোঝায় না। সাংস্কৃতিক পার্বণও আমাদের কিছু কম নয়। তার মধ্যে যেমন শীতে ক্রিসমাস আর বইমেলা আছে, তেমনই আছে ফেলুদা পার্বণও। অর্থাৎ বাৎসরিক একটা ফেলুদা না এলে ঠিক যেন ষোলকলা পূর্ণ হয় না। সেই ধারায় আপাতত যতি টানতে চাইছেন সৃজিত। অর্থাৎ তাঁর পরিচালনায় ‘ভূস্বর্গ ভয়ঙ্কর’ (Bhuswargo Bhoyonkawr) শেষ ফেলুদা ওয়েব সিরিজ় বলে জানিয়েছেন তিনি। কেমন হলো এবারের সিজ়ন?



যদিও সত্যজিৎ রায়ের লেখা মূল গল্পটি মোটামুটি সকলেরই জানা তবু বলে নেওয়া ভালো সৃজিত সেখানে বেশ কিছু নতুন উপাদান যোগ করেছেন। যদিও তাতে কাহিনি সেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। বাৎসরিক ছুটি কাটাতে ফেলুদা (টোটা), তোপসে (কল্পন) ও লালমোহনবাবু (অনির্বাণ) কাশ্মীর ভ্রমণে বেরিয়ে পড়ে। সেখানেই আলাপ হয় অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি সিদ্ধেশ্বর মল্লিক (রজতাভ) এবং তার সেক্রেটারি সুশান্ত বোসের (ঋদ্ধি) সঙ্গে। এই দলে রয়েছেন ডঃ মজুমদার (দেবেশ), সিদ্ধেশ্বরের ছেলে বিজয় (শাওন), সদ্য আলাপি জুয়াড়ি অরুণ সরকার (অনিরুদ্ধ) ও বেয়ারা প্রয়াগ। মজুমদারের সহায়তায় সিদ্ধেশ্বর প্রায়দিনই তার দেওয়া মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত মৃত আত্মাদের প্ল্যানচেট করেন এবং জানতে চান তার সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল কিনা। এইভাবে কিছুদিন চলার পর পহলগামে হটাৎ এক রাতে সিদ্ধেশ্বর খুন হয়ে যান। পুলিশ থাকলেও তদন্তের দায়িত্ব নেয় ফেলুদা। 

আরও পড়ুন: বাজিকা ভাষায় প্রথম ছবি, সেরা পরিচালকের পুরস্কার পেলেন আরিয়ান

এই ছিল মূল গল্প। এই গল্পের বিশেষ হেরফের হয়নি সিরিজ়ে। যেটুকু হয়েছে সেটুকুতে পরে আসছি। আগে বলা নেওয়া যাক গল্পের প্রেক্ষাপটের কথা। ১৯৮৯ সালের কাশ্মীরের প্রেক্ষাপট তৈরি করতে গিয়ে জঙ্গি সমস্যা আসতেই পারে। কিন্তু তাকে গল্পের অঙ্গ হিসেবে দেখিয়ে সিদ্ধেশ্বরের অপরাধীর তালিকায় ঢুকিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন বোঝা গেল না। উপরন্তু এই প্রসঙ্গে ‘বংশী চন্দ্রগুপ্ত’ নামে একটি চরিত্রের সৃষ্টিকে সৃজিতীয় চমক ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। গল্পের টানটান সাসপেন্স এর জন্য কিছুটা হলেও কমেছে। বিশেষ করে যারা মূল গল্পটি পড়েছেন—ধরে নেওয়া যায় বেশিরভাগ দর্শকই ফেলুদা গল্পের পাঠক—তারা অবধারিতভাবে হোঁচট খাবেন। লেখক নিশ্চয়ই সমকালীন কাশ্মীরের অস্থিরতা নিয়ে অবগত ছিলেন। কিন্তু যেহেতু ফেলুদা প্রধানত কিশোরপাঠ্য কাহিনি তাই অন্যান্য অনেক সামাজিক উত্থান-পতনের মতোই এই ঘটনার থেকেও ফেলুদাকে তিনি সরিয়ে রেখেছেন বরাবর। তবে যারা মূল গল্পটি পড়েননি, তাদের হয়তো এই ঘটনাবলি দেখতে মন্দ লাগবে না। 

Bhuswargo Bhoyonkawr

তবে পাঠকের মন্দ না লাগার অন্যতম কারণ হতে পারে সিরিজ়ে সত্যজিৎ রায়ের থ্রি মাস্কেটিয়র্স অর্থাৎ ফেলু-তোপসে-জটায়ু দুর্দান্তভাবে মানিয়ে গিয়েছেন। যেমন টোটা হয়ে উঠেছেন বইয়ের পাতা থেকে উঠে আসা ফেলুদা, তেমনই পর্দায় লালমোহন গাঙ্গুলিকে দারুণভাবে তুলে এনেছেন অনির্বাণ। আর সম্পূর্ণ জড়তা কাটিয়ে মানানসই তপেশরঞ্জন হয়ে উঠেছেন কল্পন। বয়স্ক বিচারকের চরিত্রে রজতাভ তাঁর শরীরী ভাষায় বয়সোচিত গাম্ভীর্য ফুটিয়ে তুলেছেন যা সত্যিই অবাক করে। ঋদ্ধি বরাবরের মতোই চরিত্র হয়ে উঠেছেন, তাঁকে মানিয়েছেও চমৎকার। সরকারের চরিত্রে অনিরুদ্ধ মানানসই। প্রয়াগ চরিত্রের অভিনেতাও প্রশংসার দাবি রাখেন।

সবশেষে যার কথা বিশেষভাবে বলা প্রয়োজন তিনি শাওন। বিজয় চরিত্রটিকে অসম্ভব এক ঔদ্ধত্য এবং স্টাইলের মিশেলে জীবন্ত করে তুলেছেন তিনি, যা দর্শককে তৃপ্তি দেবে। যতটুকু সময় তিনি পর্দায় থেকেছেন আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছেন। 

Bhuswargo Bhoyonkawr

এবার আসা যাক গল্পে থাকা একটি বিশেষ ঘটনা প্রসঙ্গে। গল্পে পরিষ্কার বলা আছে ছুরির আঘাতে মৃত্যু হয় মল্লিকের। পরে মাথায় পাথরের আঘাত করে আংটি খুলে নেওয়া হয়। কিন্তু সিরিজ়ে দু’ক্ষেত্রেই দেখানো হলো—যদিও তা ফেলুদার বর্ণনায়—আঘাতের আগে মল্লিক ঘুমোচ্ছেন। কোথাও স্পষ্টভাবে জানানো হলো না কার আঘাতে মৃত্যু হচ্ছে। অথচ তা জানানো রহস্য গল্পের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে জরুরি কারণ সেটা দিয়েই বোঝা যাবে হত্যাকারীর পরিচয়। অপরাধ যদিও দু’ক্ষেত্রেই সমান তবু ফলাফলের ওপর বিচার হয় কার অপরাধ বেশি শাস্তিযোগ্য। সেই অপরাধের হিসেব অধরা থেকে গেল সৃজিতের ব্যাখ্যায়। 

‘এরা তো দেখছি যেখানে ফাঁক পেয়েছে সেখানেই একটা করে কেল্লা গুঁজে রেখেছে’র মতো সিরিজ়ের প্রতি কোণে যেভাবে সত্যজিৎ রায়ের উল্লেখ ছড়ানো আছে তা দর্শক উপভোগ করবেন। হিমালয়ের রূপ বর্ণনায় গুপিবাঘার উল্লেখ, মার্তন্ড মন্দিরে গিয়ে বিরিঞ্চিবাবার উল্লেখ, সোনার কেল্লার অন্য সংলাপ, এরকম নানা জিনিস পাওয়া যাবে বিভিন্ন দৃশ্যে। বিজয়ের বন্ধুদের অনুরোধে পুরোনো গল্প বলতে গিয়ে ফেলুদার স্মৃতিতে উঠে আসা ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’, ‘সোনার কেল্লা’, ‘বাক্স রহস্য’, ‘গোরস্থানে সাবধান’, ‘হত্যাপুরী’ ইত্যাদি গল্পের ঝলক দেখতে মন্দ লাগে না। তবে চোখের পলক পড়লে হারিয়ে যাবে এমন দৃশ্য দেখে আশ মেটে না। দৃশ্যের পুনঃনির্মাণের ক্ষেত্রে আঞ্চলিক নাচগানের আসরে দাঁড়িয়ে ফেলুদার সিগারেট ধরানো ‘সোনার কেল্লা’য় রামদেওরা স্টেশনের গানের দৃশ্য মনে করিয়ে দেবে। এগুলো সত্যিই মন ভরিয়ে দেওয়ার মতোই। 

Bhuswargo Bhoyonkawr

এছাড়া টোটা ও অনির্বাণের মুখে কিছু মোক্ষম সংলাপ মজাদার এবং মনে রাখার মতো। যেমন দুটো অস্ত্রের ‘একটা খুলিতে আর একটা খুলিনি’ বা ‘আপনি না ক্রাইমের কুন্ডু ট্র্যাভেলস’ সংলাপগুলো বুদ্ধিদীপ্ত এবং মজারও। 

ওয়েব সিরিজ় হিসেবে স্মার্টফোনের জন্য তৈরি হলেও প্রিমিয়ার শোয়ে বড়পর্দায় পুরো গল্প সিনেমার মতো করেই দেখানো হয়েছে। ফলে কাশ্মীরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দৃশ্যায়ন নিয়ে বলার কিছু থাকে না। এ সিরিজ় সত্যিই বড়পর্দায় দেখার মতো। এমনকী বাড়িতে বড় টিভি স্ক্রিনে দেখলেও তা মন ভরাতে পারবে না। বড়মাপেই সৃজিত দেখিয়েছেন কাশ্মীরকে, এবং তা সত্যিই দৃষ্টিনন্দন হয়ে উঠেছে।

Bhuswargo Bhoyonkawr

আবহ সঙ্গীতের ব্যবহার গল্পের আগাগোড়াই শুনতে ভালো লাগে। সম্পাদনা যথাযথ। তবে একটাই আফসোস এবং প্রশ্নও। তিনটে পর্বের পর চতুর্থে এসে এতদিনে যখন টিম ফেলুদার রসায়ন জমে বেশ কুলফির আকার নিচ্ছে, সেই সময় সিরিজ়ের শেষ ঘোষণা করার খুব দরকার ছিল কি? ক্ষুধার্তকে এক থালা বিরিয়ানির লোভ দেখিয়ে মাত্র দেড় হাতা পরিবেশন করলে তার মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি সুবিচার করা হয় না বোধহয়, পরিচালক ভেবে দেখবেন আশা করি। 




Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Swati

Editor of a popular Bengali web-magazine. Writer, travel freak, nature addict, music lover, foody, crazy about hill stations and a dancer by passion. Burns the midnight oil to pen her prose. Also a poetry enthusiast.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *