‘কিছু বুদ্ধিহীন, অর্থহীন মিম আমার একেবারেই ভালো লাগেনি’
বাংলা টেলিভিশনের পর্দায় তিনি বিখ্যাত মেমবউ নামে। হিন্দি ধারাবাহিক ‘এক হাজ়ারো মে মেরি বেহনা হ্যায়’তে কাজ করার সময় হঠাৎ করেই চলে আসে বাংলায় ‘মেমবউ’ ধারাবাহিকের নাম ভূমিকায় অভিনয় করার সুযোগ। তারপর বহুদিন আর তাঁকে সেভাবে টেলিভিশনে দেখতে পাননি দর্শক। সেই মেমবউ খ্যাত বিনীতা চট্টোপাধ্যায়কে হঠাৎ করেই পাওয়া গেল রেডিওবাংলানেট-এর দরবারে। বিনীতা কথার থেকে হাসেন বেশি। জমে উঠল আড্ডা।
শুরু থেকেই শুরু করা যাক। সাংবাদিকতা নিয়ে পড়াশোনা, ছোটবেলা থেকেই কি সাংবাদিক হওয়ার ইচ্ছা ছিল?
আমার সাংবাদিকতা নিয়ে পড়াশোনার কোনও পূর্ব পরিকল্পনা ছিল না। আমার বাবা বৈজ্ঞানিক আর মা ভারতীয় সেনা বাহিনীর অফিসার। আমারও ছোটবেলায় ইচ্ছা ছিল আমি পড়াশোনা নিয়েই থাকব। সেই মতো মুম্বইতে ভূগোল নিয়ে ভর্তিও হয়েছিলাম। ইচ্ছা ছিল ‘ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক’-এর মতো কোনও সংস্থার সঙ্গে যুক্ত হব। কিন্তু আমার মায়ের কলকাতায় বদলির কারণে আমাকেও চলে আসতে হয়। তখন কলকাতার প্রায় সব কলেজেই ভর্তি শেষ। শেষ মুহূর্তে লোরেটো কলেজে ভর্তি হলাম তুলনামূলক ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে। পরে মাস কমিউনিকেশন নিয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পাশ করি।
সাংবাদিকতা থেকে অভিনয়, এই ট্রানজ়িশনটা কি ভাবে হলো?
এটা ভীষণ ইন্টারেস্টিং। কলেজের ফাইনাল ইয়ারের ফল বেরোনো আর স্নাতকোত্তরে ভর্তি হওয়ার মাঝে তিন মাসের একটা ফাঁকা সময় পাওয়া যায়। সেই সময় মুম্বইয়ের একটা বড় অনুষ্ঠানে আমি হেমা মালিনীর ওপর একটা পারফরম্যান্স করি। সেই অনুষ্ঠানে একটি হিন্দি বিনোদনমূলক চ্যানেলের কয়েকজন বড় কর্তা উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের আমার পারফরম্যান্স ভালো লেগে যায় এবং ওঁরা আমাকে অভিনয়ের সুযোগ দেন। তারপরেই ‘এক হাজ়ারো মে মেরি বেহনা হ্যায়’তে আমি অভিনয় করি।
আরও পড়ুন: ফেলুপুজো ও বাঙালির হা-হুতাশ
হিন্দি ধারাবাহিক থেকে বাংলায় এলে কেন?
বাংলা ধারাবাহিকে অভিনয় করাটা আমার কাছে ডেস্টিনি বলতে পারো। আমি হিন্দিতে ‘অশোকা’ ধারাবাহিকের কর্ভকী চরিত্রের জন্য যখন অডিশন দিচ্ছি, সেইসময় আমার কাছে হঠাৎ করেই ‘মেমবউ’ করার সুযোগ আসে। এই ধারাবাহিকটি আমার কাছে একটা বিরাট বড় সুযোগ ছিল কারণ আমি বুঝেছিলাম এটা সফল হলে শুধু কলকাতায় নয়, দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে থাকা সমগ্র বাঙালিদের কাছে তা জনপ্রিয় হবে। এবং হয়েওছিল তাই। বিদেশ থেকে অনেকেই আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে বলতেন মেমবউ তাদের খুব ভালো লাগছে। এই ধারাবাহিকে কাজ করে আমার বিদেশে গিয়ে শুটিং করার সুযোগ হয়েছে। এটা একটা বিশাল ব্যাপার নয় কি?
‘মেমবউ’-এ ক্যারল ব্রাউনের চরিত্রটা ঠিক কতটা কঠিন ছিল ফুটিয়ে তোলা?
ক্যারল একজন অ্যাংলো ইন্ডিয়ান যার মা ইংরেজ এবং বাবা ভারতীয়। আমাকে বলাই হয়েছিল আমার চরিত্রটা অনেকটা উত্তম কুমার-সুচিত্রা সেন অভিনীত ‘সপ্তপদী’র রীনা ব্রাউনের মত। তাই আমাকে ব্রিটিশদের মত ইংরেজি উচ্চারণ শিখতে হয়েছে। রীতিমতো বিদেশি মহিলাদের দিয়ে বাংলা উচ্চারণ করিয়ে সেগুলো রেকর্ড করে রাখতাম। সেগুলো বারবার শুনে তারপর অভিনয়ে কাজে লাগাতে পেরেছি।
এই ধারাবাহিক চলাকালীন তোমাকে অনেক সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়, তোমার ব্রিটিশ উচ্চারণে বাংলা বলা থেকে শুরু করে পরচুলা নিয়ে অনেক ট্রোলড হয়েছিল। সেগুলোকে তুমি কিভাবে নিয়েছ?
দেখো আমরা তো শিল্পী। আর যে কোনও শিল্পের সমালোচনাই ভালো হিসেবে ধরা উচিৎ। ক্যারল চরিত্রটার প্রতি সুবিচার করার জন্য যা করার দরকার ছিল, আমি সবটাই করেছি। দেখো, জীবনে চ্যালেঞ্জ না নিলে মজা নেই। একজন বাঙালি হয়ে দিনের পর দিন ওইরকম উচ্চারণে বাংলা বলা, সেটা কতটা চ্যালেঞ্জিং বলো তো? একটা বিদেশী মেয়ে যে সদ্য বাংলা শিখেছে, সে কি করে স্পষ্ট উচ্চারণে বাংলা বলবে? সেটা তো সম্ভব নয়। আর পরচুলার কথা যদি বলো, তাহলে বলি আমরা আর্টিস্ট। আমাদের যা সাজানো হবে আমরা তাই সাজবো। তাও তো পরের দিকে পরচুলার পরিবর্তে আমার নিজের চুলকে ব্লিচ করিয়ে অরিজিনাল লুক দেওয়া হয়। সবকিছুই আমি করেছি শুধুমাত্র ক্যারল চরিত্রটিকে ভালোবেসে। আর ‘মেমবউ’-এর জন্যই ২০১৭ সালে আমি বেস্ট অ্যাক্টর ফর কমেডি পুরস্কার পাই। সেদিন মনে হয়েছিল যে সমস্ত ট্রোল বলো, অপমান বলো, সবকিছুর জবাব দিতে পারলাম। আমরা অভিনেতারা যদি দর্শকদের থেকে ভালোবাসা পাই, তাহলে আর কিছুই চাই না।
তার মানে তোমার কেরিয়ার গ্রাফে এই ট্রোলিং একটা ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে বলতে চাও?
নিঃসন্দেহে। আরে বাবা যে কোনও প্রচার একজন শিল্পীকে পরিচিতি পেতে সাহায্য করে। আর যেখানে আমার চরিত্রটাই মজার ছিল, সেখানে এই মজাগুলো হওয়ায় আমারই ভালো হয়েছে। যারা চিনত না, তারাও চিনল। তবে হ্যাঁ, প্রচুর বুদ্ধিহীন, অর্থহীন মিম তৈরী হয়েছিল যেগুলো আমার একেবারেই ভালো লাগেনি। আবার কয়েকটা বেশ স্মার্টও ছিল। আমি রসবোধ কে সবসময় তারিফ করি।
আরও পড়ুন: ফাগুন লেগেছে বনে বনে
তুমি তো একজন পেশাদার সঙ্গীতশিল্পীও?
হ্যাঁ। ১২ বছর বয়স থেক আমি ধ্রুপদী সঙ্গীত শিখতে শুরু করি। তারপর কলেজে উঠে পশ্চিমী সঙ্গীত, অলটারনেটিভ রক, পপ মিউজিক এসবই শিখেছি। কলেজে পড়াকালীন পশ্চিমী সঙ্গীতের ওপর অনুষ্ঠানও করেছি বেশ কয়েকবার।
সম্প্রতি তোমার একটা গানের ভিডিও মুক্তি পেয়েছে ‘আপনা টাইম আ গ্যায়া’। এটা কি কোনওভাবে রণবীর সিংয়ের ‘আপনা টাইম আয়েগা’কে ট্রিবিউট জানিয়ে?
ট্রিবিউট তো বটেই। আসলে রণবীরের গানটা ছিল আশাবাদী। সেখানে বলা হয়েছিল, তুমি তোমার কাজ করে যাও, একদিন না একদিন ঠিক নিজের সময় আসবেই। আর আমি বলছি, আমাদের সময় এসে গেছে। এটাও একটা র্যাপ গান। এখানে আমার সঙ্গে গলা মিলিয়েছেন বিখ্যাত র্যাপার কবীরা। এই গানের কথাও ওরই। আমরা এই গানটায় নারীশক্তি ও যুবশক্তির ক্ষমতায়নের কথা বলেছি।
শুনলাম এই গানটা গাওয়ার পর মুম্বইতে তোমাকে নাকি ‘গলি গার্ল’ নাম দেওয়া হয়েছে?
হা হা। হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছ। মুম্বইতে রণবীর ‘গলি বয়’ আর আমি ‘গলি গার্ল’।
তোমার অভিনয়ের প্রসঙ্গে ফেরা যাক। ‘মেমবউ’-এর পর সেভাবে ধারাবাহিকে আর দেখা যায়নি তোমাকে। সম্প্রতি ছোটগল্প নির্ভর একটি সিরিজ়ে (‘সেকশন ৩০২’) অভিনয় করলে তুমি। এরপর আর আর কি করছ?
হ্যাঁ ‘মেমবউ’-এর পর একটা দীর্ঘ বিরতি নিয়েছিলাম। মুম্বই চলে যাই। এরপর ‘সেকশন ৩০২’-তে একজন দৃষ্টিহীন বন্দুকবাজের চরিত্রে অভিনয় করি। সম্প্রতি পরিচালক প্রীতম এম-এর ‘ক্লোন’ নামক একটি ছবিতে কাজ করছি। এই ছবিতে আমার বিপরীতে রাহুল বন্দ্যোপাধ্যায় রয়েছে। নচিকেতা চক্রবর্তীর কণ্ঠে গান থাকছে এই ছবিতে।
‘ক্লোন’-এর গল্পটা ঠিক কি নিয়ে?
বিজ্ঞানের একটা ধারা অনুযায়ী, পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষের একরকম দেখেন আরও সাতটি মানুষ আছে। তাঁরা হুবহু এক না হলেও, অনেকটাই একরকম দেখতে। এবং বিজ্ঞানসম্মত ভাবে এটাও প্রমাণিত হয়েছে যে এরকম এক দেখতে অন্তত দুটি মানুষের দেখা হবেই। এই বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাকে কেন্দ্র করেই তৈরি হচ্ছে ‘ক্লোন’। ছবি সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন রাজর্ষি সেনগুপ্ত। ছবিতে আমি আর রাহুল একই অফিসে চাকরি করি যাদের মধ্যে একটা প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এই ক্লোন নিয়ে পরবর্তীকালে রাহুলের জীবনে বেশকিছু সমস্যার সৃষ্টি হয় যা নিয়ে এই গল্পটা।
আরও পড়ুন: পাকদণ্ডীর পথে পথে দেওরিয়াতাল
তা তুমি এরকম নিজের কোনও ক্লোন পেয়েছ?
ওরে বাবা! ‘মেমবউ’-এর যখন প্রোমো বেরোয় তখন তো সবাই ধরে নিয়েছিল মোনালী ঠাকুর পরচুলা পরে অভিনয় করছে। অনেকেই আমাকে বলেছে এটা। এমনকি মোনালীদিও ফোন করে বলেছে যে আমাকে অনেকটা ওঁর মতোই দেখতে। তারপর সুরঙ্গনা বন্দ্যোপাধ্যায়কেও নাকি অনেকে বলেছে তাকে আমার মতো দেখতে। এছাড়া মুম্বইতেও অনেকে আমার সঙ্গে তাদের পরিচিত কারোর মিল পান। আমি নিজে আমার সঙ্গে প্রায় তিন-চারজনের মিল পেয়েছি।